প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

এই সময়ের ভিতর কবিতাযাপন—অন্য জানালায় খোলা হাওয়ার গান... | দীপক বেরা

বাতায়ন/শারদ/গদ্য/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | গদ্য
দীপক বেরা
 
এই সময়ের ভিতর কবিতাযাপন—অন্য জানালায় খোলা হাওয়ার গান...

"এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এর মতো প্রাসঙ্গিক কথা আর কী-ই বা হতে পারে! বিশেষত যখন কেউ প্রথাগত বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে চায়কবিতা সর্বগ্রাসী নয়কবি সর্বশান্ত করে না তাঁর সাধককে। বরংকবিতা মা অন্নপূর্ণার মতো সর্বদাত্রী। কবিতার নির্যাসে নবজন্মের পরাগরেণু লুকিয়ে থাকে।"

চারদিকে আতঙ্ক। মৃত্যুর আবহ। অনিশ্চয়তা। বিশ্বায়নের ঘোরলাগা এই সময়টা যতটা অস্থির, ঠিক ততটাই জটিল। এখনই একটু প্রতিশ্রুত জলের ভাবনায় ভীষণরকম চাগিয়ে উঠছে প্রাণটা। পরিবেশ ও পরিস্থিতির জেহাদে অস্তিত্ব সংকট এমনই

 যে, কেউ বলতে পারি না পৃথিবীর এই জ্বর ঘাম দিয়ে কবে ছাড়বে, কিংবা আদৌ ছাড়বে কিনা! সময়ের এই ক্ষয়াটে নিশ্বাস প্রতিনিয়ত শুষে নিচ্ছে আমাদের যাবতীয় ইতিবাচক অর্জন। বারবার শুধু বাঁকবদল— এই বদল বৈধ-অবৈধ, নৈতিক-অনৈতিক-এর ঊর্ধ্বে। আর্ত আবেদন আছে, উৎস সন্ধানের কোনো সাড়া নেই। ঠিক যে মুহূর্তে বসে এই লেখা, সেই জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবিতার পাঠ ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত, বিশেষত যেখানে অস্তিত্ব ঘিরেই সব প্রশ্নোত্তরের ঘোরাফেরা, সেখানে কবিতার কাব্যশরীরে জীবন ও জীবনের আনন্দের— এক কথায় জীবনানন্দীয় আভা কতটা খুঁজে পাওয়া সম্ভব সেই জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে অবিরত ঘুরপাক খায়, বারবার উঁকি দিয়ে যায়। ইয়েটস্ বলতেন কবিতা জলখাবার টেবিলের কথোপকথন নয়। কবি তাঁর কাব্যশরীরে যে জগত নির্মাণ করেন, তার ভাষ্যপাঠ, দৃশ্যকল্প সবটুকুই আলাদা। 'ফ্যানটাসমোগোরিয়া'! সেই অলীক জগতের সঙ্গে এই চূড়ান্ত বাস্তবতার সেতুবন্ধন ঘটবে কী করে? ভাবতে ভাবতেই কবি মলয় গোস্বামীর একটি কবিতার কয়েক লাইনের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জানি কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন। পরখ করবার সুযোগ সচরাচর ঘটে না। আজ পেলাম। ঠিক খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে যেন কবি বলেছেন—
 
"যারা ভেবেছিল মরে যাবে
তারা আশ্বস্ত হলো
নদীর পাড়ে গিয়ে দু'চারটে গান পিস দিয়ে গাইল
একদিন দেখা গেল বেশ কিছু প্রজাপতি উড়ছে...
তাদের ডানায় কারুকাজ..."
 
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এর মতো প্রাসঙ্গিক কথা আর কী-ই বা হতে পারে! বিশেষত যখন কেউ প্রথাগত বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে চায়, কবিতা সর্বগ্রাসী নয়, কবি সর্বশান্ত করে না তাঁর সাধককে। বরং, কবিতা মা অন্নপূর্ণার মতো সর্বদাত্রী। কবিতার নির্যাসে নবজন্মের পরাগরেণু লুকিয়ে থাকে। সেই সঞ্জীবনীর স্পর্শ কবি মলয় গোস্বামীর 'আমার ক্ষুধার্ত লেখা' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায়।
 
বাংলার প্রকৃতি তার ঋতুচক্রের পরিক্রমায় ব্যস্ত। সারাদিন মেঘলা আকাশ, ঝরিয়ে চলেছে অবিরাম টুপটাপ, রিমঝিম বৃষ্টির ধারা। ঋতুপর্বের নাচ সেরে কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে হঠাৎ উড়ে এল একটি পাখি। আসেই বা কেন, আবার কেন সে বারবার ফিরে যায়? চলে যায় ভাঙা পিয়ানোর পা নিয়ে অপর বসন্তে! কিন্তু থেকে যায় তার ধনুকের ছিলায় তৈরি করা কথারা। পারাপার চলতেই থাকে নিরন্তর। নদীর জলে সায়ং ভাসে। তারপর... জল ও জীবন ছুঁয়ে ভেসে ওঠে একটি আলোর হাঁসুয়া। আসলে একটি কাব্যগ্রন্থ কীভাবে শব্দে, বাক্যে, অলংকারে একটি আলোর অস্ত্র হয়ে ওঠে, তাকেই প্রত্যক্ষ করলাম এবং অন্য এক অনুভবের জগতে প্রবেশ করলাম।
 
আলো থাকলে ছায়া থাকবেই। একটা ছায়া ভয়হীন কিন্তু ভরকেন্দ্র থেকে আরও বহুকেন্দ্রিক ছায়াকে ধ্বনিতে নাচিয়ে তোলে। নিজেকে পরখ করে দেখার নির্দেশ পাঠায়। সেখানেই বস্তুর প্রতিসরন ঘটছে। কী প্রতিসরন ঘটছে এবং কীভাবে প্রতিসরন ঘটছে, ভাষা তার জানান দেয়, চিনতে সাহায্য করে।
একটি অংশে রয়েছে—
 
"ছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোড়ে
আমি
তার
হাতে
মন্দিরা তুলে দিয়েছিলাম, সে কিন্তু পোড়ে না"
....
 
এই 'আমি' এখানে ভরকেন্দ্র। চিরাচরিত যে 'আমি' তার অস্তিত্বের খোলস ছাড়িয়ে নতুন আমির রূপ ফুটিয়ে তোলার পথ দেখায়। রোদে মেপে, জলে শুইয়ে, জ্যোৎস্নার মোহ-মায়ায় ভিজিয়ে একেবারে আশরীর শৃঙ্গারের পূর্ব মুহূর্তে নিরাসক্ত করে তোলে। ধুলোয় ধুলো হয়ে শুয়ে থাকার মধ্যে তার প্রগাঢ়তা— সে ডুবে যাচ্ছে, গয়নাগুলো ভাসছে। এই গয়নাই রূপকের মাধুর্য। —গয়নাও বিষয়-আশয়। কিন্তু আসক্তি কতটা রইল, কতটা নির্লিপ্ত হল, সেটা বুঝে নিতে হবে কবিতার চরণ থেকে মননে, অনুভবে। হরিতে চরণ, নাকি চরণে হরি— বুঝতে বুঝতে হরিনাম সংকীর্তনে একটু অর্ঘ তুলে দেওয়া।
... যে গ্রন্থটি পড়ছিলাম, সেটি আসলে আটের দশকের স্বতন্ত্রচিহ্নিত কবি ও প্রাবন্ধিক উমাপদ কর-এর 'আলোর হাঁসুয়া' কাব্যগ্রন্থ।
 
এত অবিশ্রান্ত বর্ষার পরও কমছে না এতটুকু গ্রীষ্মীয় দহন। এই দহনই বহুমাত্রিক শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত। মাঝে মাঝে মনে হয় কবিগুরু কেন যে আবাহন করেছেন— "এসো হে বৈশাখ...", আবার বলেছেন— "খর বায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে..."...আর মানুষ এই দহন, সেই খরতাপ যুগ থেকে যুগান্তরে বহন করতে বাধ্য। এই বাধ্যতা এখন অভ্যাসনিষ্ঠই বটে। বিবাহিত এই সম্পর্ককেই বলে কিনা জন্ম-জন্মান্তরের গাঁটছড়া বা গাঁট-বন্ধন। এই দহন সইতে সইতে এক জীবনে কতজনের কত যে জন্মান্তর ঘটে এবং গদ্য-পদ্যে বিধৃত হয়ে শুদ্ধ কবিতায় তারা ঘর করে কে তার হিসেব রাখে! সময়ের দাবি মেনে এক জীবনেই হেঁটে যায় জন্মান্তর...
ছুটতে ছুটতে উদভ্রান্ত মানুষ দেখে সামনে দিক নেই— তারপর আরও একধাপ এগিয়ে অকপটে দেখে— কেউ আধুনিকতার নাগপাশে এক নিরপেক্ষ আত্মার নির্বাচনে বিভোর। মন কখনও বড্ড আপশোশে জানায়, "কান্নার আফসোস ঝুলন্ত ফুলের পরাগে"...
পুরাতনীর সাথে অর্বাচীনের মেলবন্ধনে স্বয়ংসিদ্ধ স্বভাবে রাম আসছে, সীতা যাচ্ছে। মাঝে ভুরি ভুরি বিভীষণ কথা। তারপরেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে— রিক্ত কিংবা রক্তাক্ত বেডকভার...
ফেসবুক-ট্যুইটার, খুন-ধর্ষণ, রাজনীতি, সমাজনীতির স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ যখন নির্মম সত্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়, তখন কবিতাই বলে— 'ভালোবাসা কোথায়' ? কবিতাই আবার বলে— 'বয়সের শেষ আসে/তবু প্রেম হয়'...
কে যে কার রসনা-রসিক— জীবন, সময়, নাকি কবিতা? কে কার নির্ভার? জীবন যে ক্রমাগত জিলিপির প্যাঁচে কিংবা কারুকাজে ঢুকে পড়ছে। অবশ্য আবার সময়ের তীব্র ঝটকায় এক লহমায় ছিটকে পড়ে, আবার খোলা জানালা পেলেই ঢুকে পড়ছে পাশের বাড়ির শীতল উত্তাপ! গুমোট ঘরে ফ্যানের হাওয়ায় তখন ঘুরপাক আর ঘুরপাক।
এভাবেই হেঁটে চলেছে পথ, পথের সঙ্গে যাপন আর যাপনচিত্রে পড়ে পাওয়া বা গড়ে ওঠা সম্পর্ক। সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক সংঘাত-সঙ্কট-সমস্যা। টুকরো টুকরো হচ্ছে প্রতিদিনের অর্জন। তবু সমাধান চাই। পড়ে যাব জেনেও জীবন চায়— বাজি, ভেলকিবাজি, ডিগবাজি। জীবন চায় উত্তরণ। আছে অনুসন্ধান প্রবৃত্তি। কিছু পাওয়ার খোঁজ, বরং বলা চলে খুঁজতে খুঁজতে কিছু প্রাপ্তিযোগ। সেই প্রাচীন গুহাযুগ থেকে আজকের বহুতল ডিজিটালে আমার আমিকে টেনে এনে কেবলই খোঁজ আর খোঁজ...। ওই যে একটি মূল্যবান কথা আছে—
'যেখানে দেখিবে ছাই
উড়াইয়া দেখ তাই
পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন'
তবে হ্যাঁ, অবশ্যই পাওয়া যায় অর্জিত অভিজ্ঞান, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের অভিঘাতে গড়ে ওঠা আত্মচেতনার এক পিঠ, অপর পিঠে পরচেতনা— স্বতঃস্বাভাবিক বলেই বিশ্বাস স্থান করে নেয়। হাত ধরে থাকে প্রেম-সমর্পণ-অভিমান-বিরোধ-অস্বীকরণ।
 
যে লেখা শুরু ঘরবন্দি এক সকালবেলায়, তা শেষ করতে করতে অপরাহ্ণ গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। ঠিক সেই মুহূর্তে কবি আশিস মিশ্র-র "শেষ বিন্দু' কবিতার কয়েকটি লাইন—
 
'তার কাছেই তো লুকনো রয়েছে
কবির শেষ বিন্দুটি;
তুমি থেকে আকাশ অবধি তার চলাচল
কখনো সে শৃঙ্খল কখনো শৃঙ্খলহীন।"
 
কবিতায় এক ধরনের বাঁধনহারা আবেগ। কবিতাযাপনের এই অবিস্মরণীয় দিনটিতে আমারও সেই কবিময়তার আভাটুকুর অপেক্ষায় থাকা...
 
কবিগুরু বলেছেন— "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া"... —হতে পারে আমার আমিকে বাইরে এনে অনুসন্ধান। আবার যা দুর্জ্ঞেয়, তাকে দেশ সমাজের সামনে টেনে আনা। আসুন সবাই খোলা জানালার গান শুনে পথে এসে দাঁড়াই— পথের পরিচয়ই আসলে জীবনের এক আশ্চর্য পথিকৃৎ।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)