বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
সুচরিতা
চক্রবর্তী
ঈশ্বরের
চুম্বন
"নন্দিনীর কপালের গভীর চুম্বনের ক্ষত রক্ত পলাশকে হার মানায়। যেন রজকিনীর কপাল জুড়ে লেপটে থাকা মেটে সিঁদুর, যেন গরম লাভা কপাল বেয়ে নামছে এ পৃথ্বীলোক পুড়িয়ে দেবে বলে। চতুর্দিক থেকে ধেয়ে এলো দর্পণ। চতুর্দিক থেকে বিদ্রূপ। এ ক্ষত কোথায় লুকোবে নন্দিনী?"
আজ দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির পাশে বসেছে নন্দিনী। লাজুক পায়রাটির মতো শান্ত অথচ চোখে হাজার আলোর উদ্ভাস খড়িমাটি দিয়ে আলপনা আঁকছিল নিঃশব্দ বয়ানে। ঋতুচক্রে কিছু মেঘ এসে জুটে গেল মাথার ওপর। রিমঝিম ঝরঝর এ সমর্পণ প্রেমেরই ইঙ্গিত। নন্দিনীর ওষ্ঠপ্রান্তের হাসিতে কেটে যাচ্ছে ভ্যান গঘের নৈঃশব্দ্য। মনে হলো ভোরের আলো আদিগন্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঐশ্বরিক প্রেম।
ঐশ্বরিক বটে! এই দিব্য
পুরুষকে নন্দিনী ঈশ্বর ছাড়া অন্য কিছুই ভাবেনি এযাবৎকাল। এখন পাখিদের ফেরার সময়, ঘরে ঘরে শাঁখ বাজার সময়, এখন আজানের সময়। আশ্চর্য আনন্দমুখর সন্ধিক্ষণে পাশাপাশি বসে নন্দিনী ও ঈশ্বর।
স্পর্শ কাঙালির মনে হলো যেন
কয়েক জন্ম ছিল মহেঞ্জোদারোর ভগ্নস্তূপে। হাতে-গায়ে-মুখে
মাটি লেগে আছে খরা লেগে আছে।
সন্ধে ঘন হয়ে
এলো আর নন্দিনীর কাছে ঈশ্বরও। বেগতিক বৃষ্টি এলে যেমন সপসপে ভিজে যেতে হয় সাপুড়ের
বীণের কাছে সাপ, যেমন মাথা নোয়ায় মাহুতের কাছে দামাল হাতি, তেমনই নন্দিনী ঈশ্বরের বুকে মাথা রেখেছিল। ঠিক তখনই আকাশ
থেকে হাজার হাজার চারা গাছ নেমে এলো মহেঞ্জোদারোর ভগ্নস্তূপে। এত আলো কতদিন দেখেনি
খরাক্লিষ্ট দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া নন্দিনী। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া পায়ের ওপর দিয়ে বয়ে
যাচ্ছে শান্ত সোঁতা। নন্দিনী চিৎকার করে বলল, আরো আমার আরো অক্সিজেন চাই আমার আরো গাছ চাই তুমি আমাকে দিতে পারো-না ঈশ্বর?
ঈশ্বর নন্দিনীর কপালে ঠোঁট
রাখলেন। দীর্ঘ চুম্বনের পর ঈশ্বর তাকালেন আকাশের দিকে। চাঁদ ঢলে যাচ্ছে পশ্চিমে।
এখন বন্ধন মুক্তির সময়। নন্দিনীর কপালের গভীর চুম্বনের ক্ষত রক্ত পলাশকে হার
মানায়। যেন রজকিনীর কপাল জুড়ে লেপটে থাকা মেটে সিঁদুর, যেন গরম লাভা কপাল বেয়ে নামছে এ পৃথ্বীলোক পুড়িয়ে দেবে
বলে। চতুর্দিক থেকে ধেয়ে এলো দর্পণ। চতুর্দিক থেকে বিদ্রূপ। এ ক্ষত কোথায় লুকোবে
নন্দিনী?
ঈশ্বর এগিয়ে গেলেন পূবের
দিকে। এক এক করে চূর্ণ হচ্ছে দর্পণ। এতটুকু রক্তাক্ত না হয়ে ঈশ্বর মিলিয়ে গেলেন
পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে।
জড়িবুটি পলিমাটি প্রলেপেও
নন্দিনী লুকোতে পারছে না ঈশ্বরের চুম্বন ক্ষত।
আজ ঈশ্বরের পাশে বসেছিলো
নন্দিনী আজ তাঁকে ছুঁয়ে দেখেছিল নন্দিনী আজ রাতজাগা পাখির মতো কেঁদেছে নন্দিনী।
-ঈশ্বর তোমাকে
চাই না। তুমি প্রকৃতই পাথরের টুকরো। তুমি প্রকৃতই অলীক।
মহেঞ্জোদারোতে ফিরে নন্দিনী
দেখেছে আর একটিও গাছ বেঁচে নেই।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment