ধারাবাহিক গল্প
শাশ্বত বোস
মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ
[৬ষ্ঠ পর্ব]
"হ কত্তা তাই হইবো। রাস্তার কুত্তার তো আর ঘর হয় না। দেইখ্যা লইবেন, ওই মাইয়ারে আমি রাস্তায় ফেলাইয়া রাখুম না। আসি কত্তা ভাল থাইকবেন। বহুকাল আপনের নুন খাইসি, আপনের ব্যবসাডার বারোটা বাজামু না নিশ্চিন্তে থাইক্কেন। না হইলে এই হারানিধি দাস এই বেঙ্গল লজের অনেক গুপ্ত কথাই জানে।"
পূর্বানুবৃত্তি ভোরের অন্ধকার চিরে
হ্যালোজেন বাল্বগুলো থরে থরে সাজানো ইলিশের রুপোলি আঁশে
ধাক্কা খেয়ে, আলো করে চারিদিক। হারান বছর ষোলোর একটা মেয়ে নিয়ে হঠাৎ এসে হাজির। শ্যামলা গড়ন, পানপাতার
মতো মুখ, তাতে
টানা টানা ডিঙি নৌকার মতো দুটো চোখ, নিটোল স্তন, উদ্যাপী
নিতম্ব। আচমকা গুপ্তদা খিস্তি করে। চমকে ওঠে নিধি, চোখ কুঁচকে তাকায়, আজ
ত্রিশ বছরে এই প্রথমবার। এতদিনে
হয়তো লোকটা বাজারটার উপযুক্ত রোজগেরে হল। তারপর…
"কত্তা হারানটা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে। কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবে না। মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না। দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে। হারানটার মতো ওকেও খাওয়াপরা দেবেন। মাইনে লাগবে না"
"কত্তা হারানটা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে। কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবে না। মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না। দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে। হারানটার মতো ওকেও খাওয়াপরা দেবেন। মাইনে লাগবে না"
"আমি কী ধর্মশালা খুলেছি হারানিধি? যাকে পারবে এনে ঢোকাবে একেনে? ওরা যে বিয়ে করেছে কে সাক্ষী আছে? তোমার কথায় এই রাস্কেলটাকে কাজে রেখেছিলাম, সে কাম-কাজ যাই করুক, আমি কোনোদিন কিছু বলিনিকো, আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে। তোমার লজ্জা করছে না ওটার হয়ে দালালি করতে? না না এখানে জায়গা হবে নেকো। অত দরদ থাকলে ওই বাজারের দোতলার ঘরে রাখগে যাও গে। আমার ও ঘর সিজনের জন্য রাখা।"
"না কত্তা ওরা ঐখানে যাইবে না।", নিধির গলায় ক্রমান্বয়ী রেণুঝড় খেলে যায়।
"এত দরদ যখন নিজে বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাখগে যাওনা বাপু, তোমার আদরের ধোন আর তার বৌকে। আর সাথে তুমিও বিদেয় হওনা কেন? আমার লজে এসব ছোটলোকি আমি বরদাস্ত করব না।"
অঙ্কন- শাশ্বত বোস
বর্ষাটা এখন আরো অনেক গাঢ় হয়েছে। ভিজে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে ওর সব সুখ দুঃখ। চৌকো করে মেঘ জমে বাজারটার উপর। ‘বাজারের উপর এক্ষুনি ভেঙে পড়বে’ এরকম অবস্থার দোতলার কার্ণিশটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে থাকা অশ্বত্থর চারাটা, একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার শপথ নেয়। তারপর হয়তো সেটা একদিন বাড়িটাকেই ফেলে দেবে। শিয়ালদহ স্টেশনের চার নম্বর গেটের কাছে ভাতের ঝুপড়ি খুলেছে নিধি, চাইলে বেঙ্গল লজের উল্টোদিকের বাজার চত্বরেও খুলতে পারত। এই বাজারে ওটাই নিধির আঁতুরঘর। কিন্তু বেইমানি নিধির ধাতে নেই। এখানে প্রত্যেকদিন আশেপাশের বিহারি দোকানদারগুলোর সাথে বেঞ্চি পাতা নিয়ে ঝামেলা লাগে, নিধি ঠান্ডা মাথায় সবটুকু সামলায়। রোজ সকালে হারানের বৌটা গামছা উপুর করে ভাতের ফ্যান গালে, সেই ফ্যান পিটুলিগোলা রাস্তাটার উপর ইচ্ছেমতো ছড়িয়ে গিয়ে অক্ষরলিপি আঁকে, ঊর্ণ জালের যাযাবরী চরিত্র অববাহিকায়। বিহারি ছোকরাগুলো প্রথম দিকে কটু নজর দিয়েছিল, মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। সবসময় নিধি পেছনে বটগাছের মতো দাঁড়িয়েছে। কোমরে গামছা বেঁধে হারানিধি বড় কড়াইয়ে তেল ঢালে, পিঁয়াজ-রসুন-আদা ফোড়ন দিয়ে কষতে থাকে। কষে-কষার গন্ধে পথচলতি মানুষের আতশী অষ্টপ্রহর কাটে শ্রীহীন বিরিঞ্চি নগরযাপনে। হারান উবু হয়ে বসে কয়লা ভাঙে। ওরা তিনজন এখন সার্পেন্টাইন লেনের পুরোনো একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। বাড়িটায় সব ভদ্রলোকদের বাস, বলে কয়ে সস্তায় সিঁড়ির নীচে পুরোনো একটা ঘর ভাড়ায় পেয়েছে নিধি। আর যাই হোক এখানে মেয়েটার উপর আর কোন শকুনছায়া পড়বে না। এখান থেকে ওকে আর যোগাযোগের অজানা ক্রসিংএ হারিয়ে যেতে হবে না। আসা যাওয়ার পথে একান্নবর্তী দৃষ্টিতে রাস্তার ওপারের বাজারটাকে দেখে নিধি। দেখতে দেখতে ওর প্রতিটা রন্ধ্রে ঈশ্বর প্রকট হয়ে ওঠেন। বর্ষার নিষিদ্ধ বারবেলাটায় যোগনিদ্রার শীর্ষে উঠে, ওরা স্বপ্ন দেখে মহাজাগতিক দর্শনে ওদের হোটেল বেঙ্গল লজ হয়ে উঠেছে। বেঙ্গল লজে গ্যাসে রান্না হচ্ছে। তৎপুরুষ খুন্তি নাদে, বিবস্ত্র বেগুনের নাগরিকত্বকে মেনে নিয়ে রান্নাঘরদুটো মিশে গিয়ে, ক্রমশ একটা উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠছে।
জামগাছের কোটর থেকে শ্রমিক মৌমাছিটা এদিক-ওদিক উড়ে যায়। সামনের শীতে গাছটার নীচে লজের মিনি বেড়ালটা পোয়াতি হবে। বাজারটা কাকে ভালবাসবে আর কাকে অবহেলা ছুঁড়ে দেবে এই ভেবে চুপ করে থাকে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment