প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, December 13, 2024

মুক্তির কান্ডারি | ঋতুরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

মোহন রায়হান সংখ্যা | ছোটগল্প

ঋতুরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়

মুক্তির কান্ডারি



"সরযূর দিকে এগিয়ে গেলে। দেহের অর্ধেক অংশ যখন সরযূর গভীর বুকে নিমজ্জিততখন কেবল পেছন ফিরে গৌরের উদ্দেশ্যে বললেএকশত শবদেহের শ্মশানযাত্রী হতে হবে তোকেএকশত শবদেহ। অতীতকে সম্মুখীন করতে হবে। তবে তোর প্রায়শ্চিত্ত হবে। তবে তুই মুক্তি পাবি।"


গৌরের নামের পাশে খ্যাপা শব্দটা যে আজন্মকাল ছিল, তা নয়। আদতে গৌরের পুরো নাম ছিল গৌরগোপাল চাটুজ্যে। নদীয়ার মায়াপুর গ্রামে ছিল তার বাস। এই গৌর যে কবে গৌরখ্যাপা হয়ে গিয়েছিল, আর কবেই বা শ্মশানখ্যাপা, তা আর মনে নেই গাঁয়ের কারও। কেবল এটুকু মনে আছে, গৌর যেদিন সবকিছু ফেলে গাঁ ছাড়ল, নতুন বৌটা সেদিন খুব কেঁদেছিল।
 
আসলে সে মা-মরা ছেলে। বাপের কাছে মানুষ। পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে কিছুটা সময় একটা চটকলে কাটিয়েছিল দিনমজুরি করে। বাপটা মরার আগে ছেলেটার বিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। পনেরো বছর পরে সেই প্রথম কোনো মেয়েমানুষ এলো গৌরদের ঘরে। নাম তার বিনোদিনী।
 
ঘর বলতে গাঁয়ের মেঠো পথের ধারে, এক কোণে, পড়ে পাওয়া চোদ্দোআনা একটা মাটির কুঁড়ে, খড়ের চাল। বামুনবাড়ির পুত্র-সন্তান বলে পনেরো বছর বয়সে গৌরের উপনয়ন হয়েছিল। আর সেই সাথে বিয়েটাও। বিয়ের পর জানা গেল মেয়েটি আসলে বাঁজা। সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। বাপটা পটল তুলেছে ততদিনে। চটকলের চাকরিটা ছেড়ে, মাটির কুঁড়েটা ছেড়ে, স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ছেড়ে, মায়াপুর ছেড়ে, সব ছেড়ে একদিন গুড়-চিঁড়ে বেঁধে চলে গেল গৌর। ছেড়ে গেল সদ্য বিয়ে করে আনা দোলনচাঁপা ফুলের মতো বৌটাকেও, বিনোদিনী।
নিজের গাঁয়ে আর ফিরে যায়নি তারা কোনোদিন। গৌর বাসা বাঁধল অন্য কোনো গাঁয়ে গিয়ে, বিনোদিনী রয়ে গেল গৌরদের গাঁয়ে, খুঁটি আকড়ে। এইভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো বছর।
 
পালাতে পালাতে বিহারের এক প্রত্যন্ত গাঁয়ে গিয়ে তবে থেমেছিল গৌর। শরীর হয়েছে শীর্ণ, বসন হয়েছে জীর্ণ, চোয়াল গিয়েছে ঢুকে। এক বুড়োবটের তলে তার বাস। সভ্যতার আদিমতম ব্যবসা নাকি ভিক্ষা; সেই ছিল তার কাজ। বুড়োবটের ঝুরির মতোই মুখ ভর্তি দাড়ি-চুলের ঝুরি। বয়সের সাথে তাল রেখে মাথাটাও বেতাল হয়েছে। বছর গড়াতে গড়াতে কখন একটা সে হয়ে গিয়েছিল গৌরখ্যাপা।
 
এমন সময়ে, চৈত্রের এক বারবেলায়, গৌরের সামনে এসে উপস্থিত হলো এক জটাধারী সাধুবাবা। সাধুবাবা না বলে তাকে তান্ত্রিক বলা চলে। পরনে রক্তের রঙে রাঙানো লাল চেলি, ইয়া বড় তার শরীরের কাঠামো, কপালে রক্ত জবার মতো টকটকে লাল তিলক, হাতে ডমরু, মাথায় শতবৎসরের জীর্ণ একটা জটা। তান্ত্রিক এসে গৌরের কাছে ভিক্ষা চাইলে।
 
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল গৌর তার দিকে। এ কী আবদার! ভিখিরির কাছেই ভিক্ষা চাইছে! বললে, আমার কাছে ভিক্ষা দেওয়ার মতো কিছু নাই বাবা। এতে একটুও রেগে না গিয়ে তান্ত্রিক কেবল মৃদু হাসলে। বললে, খুঁজে দেখ, আছে।
গৌর আশপাশটা একবার চেয়ে দেখলে। দেখলে, বুড়োবটতলা শুনসান। কোথাও কিচ্ছুটি নেই। আর ঠিক তখনই মনে পড়ল গৌরের, তার ঝোলায় গুড়-মুড়ি খানিকটা আছে। সেই বের করে তান্ত্রিকের পদতলে সঁপে দিলে সে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললে, বাবা এই নাও দুটি মুড়ি। তান্ত্রিক তা দুহাত ভরে নিলে, এবং নিমেষের মধ্যে খেয়ে নিলে। সেই রাতে গৌরের কাছে, বুড়োবটতলেই থেকে গেল সে।
 
পরের দিন খুব ভোরবেলা, সূর্য তখনও ওঠেনি পুব আকাশে, গৌরকে ডেকে তুললে তান্ত্রিক। নিজের ঠোঁটে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গৌরকে সজাগ করে দিলে, বোঝালে, শব্দ নয়। ধীর পায়ে চললে তান্ত্রিক, পেছনে গৌর, আর সব শেষে একটি কুকুর; গা ঘায়ে ভর্তি, লোম নেই বললেই চলে। সেই ভোরে এই প্রাণী কোথা থেকে এসেছিল, সেকথা গৌর জানে না; কেবল ভোরের আঁধারে, নিঃশব্দে চুপিসারে, তারা চললে। তান্ত্রিক, গৌর, আর সেই কুকুর।
সারাটা রাস্তা নিস্তব্ধে কাটল। অনেকটা চলার পর তান্ত্রিক প্রথম দাঁড়ালে। মুখ খুললে, বললে, থাম। গৌর থামল। সাথে থামল ভোরের প্রাণীটি। আধো কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গৌর দেখলে, সামনে বিশাল জলাশয়। না, জলাশয় নয়, নদী। আদিগন্ত ব্যাপ্তি নিয়ে বয়ে চলেছে সরযূ নদী।
 
তান্ত্রিক কিছুক্ষণ সরযূর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। পাশে এসে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়ালে গৌর। চারিদিক অন্ধকার, নিস্তব্ধ। কেবল কলকল রবে বইছে সরযূ। তারপর তান্ত্রিক এগিয়ে গেলে জলের দিকে। পাড় ধরে খানিকটা নেমে গিয়ে উবু হয়ে বসলে সে। দুহাত আঁজলা করে সরযূর জল তুলে নিলে। তারপর মাথায় এবং শরীরে জল ঢেলে পুব আকাশের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলে।
 
এর মধ্যেই কখন ভোরের সেই ঘেয়ো প্রাণীটি একই ভাবে পাড় ধরে সরযূর দিকে চলে গিয়েছে। মন্ত্র তথা তন্ত্র না জানা এই নীচ জীব সরযূর জল পান করছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠা-নামায় তার পেটের কাছটা আন্দলিত হচ্ছে; দেখা যাচ্ছে মলিন চামড়ার নীচে বুকের পাঁজরগণ দৈন্যতায় ধুঁকছে।
 
সরযূর পাড়ে গিয়ে ততক্ষণে দাঁড়িয়েছে গৌর। সে দেখলে, তান্ত্রিক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কুকুরটির দিকে। কিছুক্ষণ পরে কুকুরটির পেটে হাত বুলিয়ে সে গৌরের কাছে এলে। বললে, তুই যা থেকে পালাচ্ছিস এত বছর – তোর অতীত – তা ধেয়ে আসছে তোর পেছন পেছন, তুই দেখতে পাচ্ছিস না। তুই মুক্তি খুঁজছিস। কিন্তু তুই ত্যাগ করতে পারিসনি মায়াকে। মায়া কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে তোর শরীর, মন, সমস্ত কিছু। ওই দেখ কুকুর – অঙ্গুলি নির্দেশে দূরে জল পানরত প্রাণীটিকে দেখালে তান্ত্রিক – বললে, ওকে দেখ। ওর তো এই ডমরুটুকুও নেই।
এই বলে কোমরে বাঁধা ডমরুটিকে খুলে, হাতের কায়দায় সরযূর জলের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলে সে। ডমরু ভাসতে ভাসতে চলল সরযূর সাথে। তারপর যেটা হল, সেটার ব্যাখ্যা গৌর কখনও পায়নি। প্রথমে দেহের ওপরের অংশের কাপড়, তারপর দেহের নীচের অংশের কাপড়, তারপর গলার পৈতাগাছা ধীরে ধীরে ত্যাগ করলে তান্ত্রিক। তারপর সরযূর দিকে এগিয়ে গেলে। দেহের অর্ধেক অংশ যখন সরযূর গভীর বুকে নিমজ্জিত, তখন কেবল পেছন ফিরে গৌরের উদ্দেশ্যে বললে, একশত শবদেহের শ্মশানযাত্রী হতে হবে তোকে, একশত শবদেহ। অতীতকে সম্মুখীন করতে হবে। তবে তোর প্রায়শ্চিত্ত হবে। তবে তুই মুক্তি পাবি। এই বলে সরযূর জলে, আধো কুশায়ার অন্তরালে, তার ডমরুর মতোই, কোথায় হারিয়ে গেলে তান্ত্রিক। পুবের আকাশে রক্তের মতো এক চিলতে আলো ফুটেছে তখন। ঠিক যেন তান্ত্রিকের কপালের সেই তিলক। সরযূর ধারে, মাটির ওপর, কেবল পড়ে রইল তার পরনের কাপড়টুকু আর পৈতাগাছা।
 
সেই থেকে তো হল শুরু শ্মশানখ্যাপার যাত্রা। গাঁ’কে গাঁ উজাড় করে মড়ক এলো। গৌর যেখানে পারলে, ইতিউতি ছুটলে, শ্মশানযাত্রী হয়ে। লোকে তার নাম দিলে শ্মশানখ্যাপা। এমন করে কেটে গেল আরো অনেক বছর। গৌর এখন শীর্ণকায় বৃদ্ধ। শরীরে বল নেই। পেটে খিদে নেই। গায়ে লোম নেই। বুকের ভেতর থেকে পাঁজরের খাঁচা উঁকি দিচ্ছে। অনেকটা সেই সরযূর ধারে ফেলে আসা কুকুরটির মতো
 
নিরানব্বইটি শবদেহের শ্মশানযাত্রী আজ গৌর। সে এখন ক্লান্ত। সে সবকিছু ভুলেছে, ভোলেনি কেবল তান্ত্রিকের শেষ কথাগুলো – একশত শবদেহের সঙ্গী, তারপর তার মুক্তি। কোথায় সেই মুক্তি? কতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারলে সে? তান্ত্রিক কী বোকা বানালে তাকে? কে দেবে তাকে মুক্তি? গৌর জানে না। মড়ক গেল। মৃতের সংখ্যা হ্রাস পেল। এখন কেবলই দিনগুজরান। অন্তিম শবদেহের প্রতীক্ষা। এখন আর সে ছুটতে পারে না। তাই শ্মশানই তার সংসার। সংসার থেকে মুক্তির সিংহদ্বারই তো শ্মশান; সে স্থান কী কখনও সংসার হতে পারে? গৌর জানে না।
 
আশা যখন বিদায় নিয়েছে, এমন সময়ে, গ্রীষ্মের এক মধ্যাহ্নে, সে এসে পৌঁছলে গৌরের কাছে। একশততম শবদেহ। তার মুক্তির কান্ডারি। তার ডমরু। নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে উঠল আগুনের শিখা। সরযূর জল বয়ে গেল শ্মশানের মধ্য দিয়ে। উঠে দাঁড়ালে গৌর। দেখলে, দূরে ডোমের কাঁধে, খাটিয়ায় শুয়ে রয়েছে মৃতের দেহ। ম্লান হরিধ্বনি ভেসে আসছে তার কানে। বাতাসে খই উড়ছে। চিতা সাজল। গৌর দেখলে চিতার ওপর শুয়ে রয়েছে এক বৃদ্ধা। বছর গড়িয়েছে, বয়স গড়িয়েছে, গড়িয়েছে সরযূর জল, কিন্তু এই দোলনচাঁপার মতো মুখখানি চিনতে একটুও অসুবিধা হল না তার। এই মুক্তিই কী চেয়েছিল সে? সম্মুখে শয়নে তার অতীত, যা থেকে এতকালের পলায়ন, তার একশততম শ্মশানসঙ্গী, তার মুক্তির কান্ডারি, বিনোদিনী।
 

সমাপ্ত

3 comments:

  1. খুবই টানটান মানবিক কাহিনি।মনুষ‍্যজন্মের পূর্বাপর ও পরিণতির কথা গল্পে চিত্রিত হয়ে ছে সুন্দর।

    ReplyDelete
  2. অনবদ্য
    পরাণ মাঝি

    ReplyDelete

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)