বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৩য় সংখ্যা/১২ই বৈশাখ,
১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
শাশ্বত বোস
মিছিলের
ঠিক পরের ট্রামটা
[৩য় পর্ব]
ধারাবাহিক গল্প
শাশ্বত বোস
[৩য় পর্ব]
"অবচেতনে কবরস্থানটাকে দেখে শিখতে চেয়েছে মৃদুলা, কীভাবে অনন্তকাল ধরে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে হয়, কীভাবে খোলা আকাশের নীচে একটা বাউন্ডুলে ঘুড়ির মতো কান কেটে গোত্তা খেতে থাকা একটা গৃহস্থ বাড়িতে পাঁচমিশালি কাওতালির ভিতর অস্ফুট স্বর ম্লান ম্লান হয়ে, এক বুক অভিমান নিয়ে শিকড় গাড়তে হয়।"
ঘন্টির শব্দটা আবার আসবে বিকেলের দিকে। তখন হয়তো এন্টালি মসজিদে নামাজ পড়া চলছে। আয়াতের শব্দের সাথে ধূপ আতরের খুশবু হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে আওয়াজটা। বাপের বাড়ি থাকতে মৃদুলা কলকাতার ট্রামের অনেক গল্প শুনেছে বাবা-কাকাদের মুখে। ওর ন কাকা নিউজিল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রামে চেপে আপিস যেতেন। তখন ট্রামে ফার্স্ট ক্লাস ছিল।
বিয়ের
পর একদিন বরের সাথে শিয়ালদার জগৎ সিনেমা থেকে ট্রামে করে মৌলালী অবধি এসেছিল
মৃদুলা। তখনও ও জানত না নদীর মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা
ট্রামলাইনগুলো আর কিছুদূরের মধ্যে পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোয়
গিয়ে শেষ হয়েছে। মাঝে সান্ধ্যকালীন রাগিনীর মতো কিছু লাইন
চলে গেছে নোনাপুকুর বেনেপুকুরের দিকে। চার নম্বর পোল পেরিয়ে দেবরায় একটা গোরস্থান
আছে বলে শুনেছিল মৃদুলা। ওদিকটা দিয়েই আগে বড়োপিসিমার বাড়ির
দিকে যেত ও কিন্তু কবরগুলোকে কখনও নিজের চোখে দেখেনি। বিয়ের পর এ পাড়াতে এসে
প্রায়ই দমবন্ধ হয়ে উঠত মৃদুলার। সরুগলির মধ্যে বাড়ি। গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করা
দুটো বাড়ির মধ্যে দিয়ে আবার একটা সরু গলি ঢুকে গিয়ে পরের বাড়িটার শ্যাওলা ধরা
কার্নিশ থেকে গড়িয়ে পড়া রোদটাকে এঁটো করে দিতে চাইছে যেন সর্বভুক বুদ্বুদের মতো। তবু সময়ে-অসময়ে পুরো
পাড়াটা যেন একটা পরিবারের মতো। অবচেতনে কবরস্থানটাকে দেখে
শিখতে চেয়েছে মৃদুলা, কীভাবে অনন্তকাল ধরে মাটি
আঁকড়ে পড়ে থাকতে হয়, কীভাবে খোলা আকাশের নীচে
একটা বাউন্ডুলে ঘুড়ির মতো কান কেটে গোত্তা খেতে থাকা একটা গৃহস্থ বাড়িতে পাঁচমিশালি
কাওতালির ভিতর অস্ফুট স্বর ম্লান ম্লান হয়ে, এক বুক অভিমান নিয়ে শিকড় গাড়তে হয়। সমস্ত আয়না, সমস্ত জাদুঘড়ি উধাও করে বিয়ের সময় থেকে দেখে আসা রংচঙে দিনকালটার গা থেকে উড়ে
আসা শুকনো পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে মৃদুলা। ওকে ঘিরে কুন্ডলী তৈরি করে
সেগুলো ‘পৃথিবীর গায়ের সব ফাঁকফোকর বুজিয়ে দেবে’ এই শপথ নেয়।
সেটা ৬৭ সালের মে-জুন মাস। এই
মৌলালির চার রাস্তার মোড়ে ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে দাউ দাউ করে জ্বলেছিল
গোটা একটা ট্রাম। না সে আগুন শুধু কলেজ পাড়াতেই থেমে থাকেনি। এমন অনেক আম-আদমির না
জানা কথা বিয়ের পর মৃদুলা শুনেছে উল্টো দিকের বাড়ির গোলগাল চেহারার অম্বুজা মামার
কাছে। ভদ্রলোক সিইএসসিতে চাকরি করতেন, মৃদুলার ছেলেকে বড়ো ভালোবাসতেন। এবাড়ির আরো দুই ছেলেমেয়ের
থেকে বরাবরই ওর নিজের ছেলে একটু বেশি আদর একটু বেশি লাই পেয়ে এসেছে চিরকাল আর সেটাই হয়তো কাল হলো ছেলেটার জীবনে! এ বাড়ির
রংচঙে জৌলুসদার জীবনের ঘোর লেগে গেল ওর চোখে। চারিদিকে কত মানুষ তখন, কত আশ্রয়! আদতে বখে যেতে যেতে স্কুল ড্রপ আউট হয়ে গেল
ছেলেটা। এখন একটা সরকারি সমবায়ে দারোয়ানের চাকরি করে। দয়ার চাকরি তাই কোন ইজ্জত
নেই! ঘোষ বাড়ির ছেলে দারোয়ান! মৃদুলার খুড়শাশুড়ি বেঁচে থাকলে হয়তো অপমানে
আত্মঘাতীই হতেন। ‘ক্লাস এইট পেরোতে পারেনি যে ছেলে, দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করে নিতে পারছে এটাই ভাগ্য!’, এক বেলা থেকে আরেক বেলার দিকে চলে যেতে যেতে ভাবে মৃদুলা!
একাত্তরের অশান্ত কলকাতায়
মাঘের কোন এক বিকেলে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল মৃদুলা। মৌলালি ক্রসিংয়ে একটা
সমান্তরাল পৃথিবীর বুকে ভনভন করতে থাকা মানুষজনের মেলায়, যুগের সেন্টিমেন্ট হয়ে চলে যেতে দেখেছিল ট্রামটাকে।
কংক্রিটের রাস্তার উপর অদৃশ্য জাদুওয়ালার মতো বিভিন্ন ফর্মের ইন্দ্রজাল বুনতে চাওয়া
শাণিত ইস্পাতের লাইনগুলো ডিঙোতে গিয়ে,
ওদের
গাড়িটা হোঁচট খাচ্ছিল বেশ কয়েকবার। লাইনটা আজ শুয়ে আছে অনন্ত শয্যায়, শুধু গায়ের চামড়ায় মরছে ধরেছে। লাইনগুলো যেন কাটাকুটির অঙ্ক
কষে শেষের আগের ট্রামটা কখন ওদের মাড়িয়ে চলে যাবে সেই অপেক্ষায়! ওর বউভাতের দিন
রাত্রে গলির মুখ থেকে বোমাবাজির শব্দ ভেসে আসতে শুনেছিল মৃদুলা। সেটা নকশাল আমল।
ওর মনকেমন করে উঠেছিল বাড়ির জন্য, ওর মায়ের জন্য আর
সেদিন মৌলালির মোড়ে দেখা সেই ট্রামটার জন্য। ওদের শরীরে যেন কোন আঁচ না আসে এটাই
চেয়েছিল মৃদুলা। যেমনটা ও চায় আজও। ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া শুকনো ফুলের মতো বয়সের সাথে
সাথে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে বাড়িটা,
জৌলুস
হারিয়েছে। নির্মোহ আপেক্ষিকতার নিয়মে বদলে বদলে গেছে সাতপুরনো দিনকাল। মোড়ের মাথায়
ধোপার দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে। লাগোয়া বাড়িটা ভেঙে কর্পোরেশন রুল লঙ্ঘন করে গায়ে
চেপে ফ্ল্যাট তুলে দিয়েছে উঠতি প্রোমোটার। ছাতের ঘরের পায়রাগুলো হয়তো বা উড়ে গেছে
দেবরার গোরস্থানের দিকে কিন্তু ফেলে আসা মাটির ভেতর ডুবে যেতে যেতেও বুকের ভিতর
ট্রামের ঘন্টির শব্দটা যেন ভুলতে চায়নি কেউই। নব্বইয়ের দশকের কোন এক নিঝুম
সন্ধেবেলা, এন্টালি বাজারের মুখটাতে গুলি
চলার আওয়াজ শোনা গেছিল আর ওদের এই গলিটা দিয়ে যুব কংগ্রেসের কিছু তরুণ নেতাকে ছুটে
পালাতে দেখেছিল মৃদুলা। তাঁদের কেউ কেউ আবার বর্তমান সরকারের মন্ত্রী! সেই সন্ধেয় মৌলালি
মোড়ের ট্রামলাইনে দু-একটা ছেলের লাশও পড়ে থাকতে দেখা গেছিল
হয়তো! ট্রামটা হয়তো নিথর শরীরগুলো এড়িয়ে ভারী ধাতুর ঘর্ষণে ছিটকে আসা স্ফুলিঙ্গে
একটা রংমিলন্তি মানচিত্র এঁকে নির্জনতার দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বাহকহীন পালকির সেই নির্জনতায় হয়তো রাত
দশটার পরই নেমে আসে মৃত্যুর জটিল হীমশীতলতা। মৃদুলা সেটা উপলব্ধি করতে পারে কিন্তু
দেখতে পায় না। গত পরশুর টিভির খবরে মৃদুলা শুনেছে ট্রাম নাকি একেবারে মুছে যাবে এই
মহানগরীর বুক থেকে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment