বাতায়ন/ঝড়/হলদে খাম/৩য় বর্ষ/১ম সংখ্যা/১লা বৈশাখ, ১৪৩২
ঝড় | হলদে খাম
বন্দনা সেনগুপ্ত
ঝড়ের
পরে
যাক গে। ডাকার কচকচি থাক গে।
যা বলতে কলম ধরেছি, সেটাই বলি। কাল যখন তুমি এই চিঠি
পাবে, তখন আমাকে আর পাবে না। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছ। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই ভাবছ
হঠাৎ কী হল! পাগল হয়ে গেল নাকি? না গো। হঠাৎ কিছুই হয়নি। তুমি যেদিন বিকেলে আমাকে দেখতে
গিয়েছিলে, ওই হালকা মেঘবৃষ্টির দিনে, কমলা রোদ্দুরের আলোয়,
তোমার
ওই শ্যামলা মুখখানা আমায় যে কী মায়ায় বেঁধেছিল! তোমরা আমাকে নাকচ করলে, করতেই পারতে, আমার মন ভেঙে যেত।
কিন্তু, বিয়েটা হল। কিছুদিন পরে এই ভাড়া বাড়িতে সংসার করতে এলাম।
সত্যি বলছি, আমার মনে হয়েছিল যে স্বর্গ
যদি কোথাও থাকে, সেটা এইখানে। এই
বাড়িতে। তোমার সঙ্গে। তখন আমি যেন সর্বদা আনন্দে ফুটতাম। আমার মুখে যেন কথার
ফুলঝুরি ছুটত। আর, তুমি? এত কথায় বিরক্ত হয়ে যেতে। এতটাই বিরক্ত হতে যে আজ যখন কথা
কমতে কমতে প্রায় চুপই হয়ে গেছি, তুমি লক্ষ্যও করতে
পারনি।
আমার স্বর্গবাসের ভুল ভাঙাতে তুমি
বেশি সময় নাওনি। আমার সংসার, আমার বাড়ির কাজ, আমি ভালোবেসেই করতাম। কিন্তু, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম যে তোমার কাছে আমার মর্যাদা একজন কাজের লোকের বেশি
নয়। তাও বিনা মাইনের। গুনে গুনে টাকা দিতে! তারপরও পাই পয়সার হিসেব বুঝিয়ে দিতে
হত। বিয়ের পরেও আমার ছোটোখাটো শখ আহ্লাদের জিনিস, এমনকি মোবাইল রিচার্জও আমার বাবা দিয়েছেন। তুমি কি সেটা
জানো? আমার তো মনে হয় না কখনো
খেয়াল করেছ।
এমনকি তোমার স্বাভাবিক
শারীরিক চাহিদার মধ্যেও কোন ভালোবাসা থাকত না। অফিস আর বন্ধু, আড্ডা এবং মদ নিয়েই তোমার সারাদিন কেটে যেত। বাড়ি আসতে তো
শুধু ঘুমোতে! আমার সাধ, আহ্লাদ, অভিযোগ, অনুযোগ বা চোখের জলের
জন্য তোমার সময় ছিল না।
আমি আর পারছিলাম না। “নিজ
গৃহে পরবাসী” বোধহয় একেই বলে। আমার দম আটকে আসছিল। বাধ্য হয়ে একদিন তোমার মাকে
জানিয়েছিলাম। উনি আমাকে বিন্দুমাত্র সাপোর্ট করেননি। সংসার মেয়েদেরই গুছিয়ে
নিতে হয়, ছেলেরা বারমুখো হয়েই থাকে, বয়স হলে, দু-একটা বাচ্চা
হলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। এইরকম সব
বলে আমাকেই মানিয়ে নিতে বলেছিলেন। তিনি তোমাকে কী বলেছিলেন, আমি জানি না। কিন্তু,
তুমি
সেদিন বাড়ি ঢুকেই আমাকে এত জোড়ে চড় মেরেছিলে যে আমি ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।
দেয়ালে ঠোকা লেগে কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়েছিল। তুমি ফিরে তাকানো প্রয়োজন মনে করনি।
সেই দাগ আজও আমাকে শক্তি দেয়।
সেদিনই বুঝেছিলাম, আর নয়। এবার এখান থেকে বেরোতেই হবে। কিন্তু, তাও এতগুলো দিন লেগেই গেল। তোমরা বেশি লেখাপড়া জানা বা
চাকরি করা মেয়ে চাওনি বলে জানতে না যে মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করার পর আমার বিয়ে
হয়েছিল। এবার উঠেপড়ে লেগে প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা করতে করতে এতদিনে চাকরি
পেয়েছি।
কোনও এক সময় আমার মা
বলেছিলেন বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়ির অতিথি, আসবে যাবে কিন্তু বেশিদিন থাকবে না। তাই এখান থেকেই সোজা চাকরির জায়গায় চলে
যাব। আমি জানি তোমার কাছে
আমার গুরুত্ব এতটাই যে এখানে আসার পর থেকেই আমার মনের মধ্যে যে ঝড় বয়ে চলেছে, তুমি তার খোঁজ পাওনি। চড়ের পর সেই ঝড় যে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ
নিয়েছে, তাও তোমার অজানা। তাই আজ
তোমাকে সব কিছু জানিয়ে গেলাম। তবে, এই ঝাপটাখানা না খেলে
বেরোতে পারতাম না।
ডিভোর্সের কাগজপত্র আমার বাবাকে
পাঠিয়ে দিও, সই করে দেব। ভয় পেও না, তোমার কাছ থেকে কিছু খোরপোষ নেবো না, ঘৃণা বোধ হবে। তবে মনে রেখো, এই মানসিক অত্যাচারের জন্য আমি ইচ্ছে করলেই তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারি।
ভুলে যেও না।
ভালো থেকো।
ইতি—
(আর তোমার না)
গীতশ্রী
(আগে কখনও চিঠি লিখিনি,
তাই এই
জীবনে আর “শুধু তোমারই” লেখার অবকাশ পেলাম না)
ঝড় | হলদে খাম
বন্দনা সেনগুপ্ত
"এমনকি তোমার স্বাভাবিক শারীরিক চাহিদার মধ্যেও কোন ভালোবাসা থাকত না। অফিস আর বন্ধু, আড্ডা এবং মদ নিয়েই তোমার সারাদিন কেটে যেত।"
চিঠির শুরু হয় একটা সম্বোধন
দিয়ে। কী বলে ডাকব তোমায় বলো তো?
দু বছর
আগে হলেও, লিখতাম প্রিয়তম। আজ তুমি
আমার প্রিয়তম হওয়া তো দূরের কথা, প্রিয়ও নও। তুমি কি
সেটা জানো? বুঝতে পারো?
গীতশ্রী
No comments:
Post a Comment