ধারাবাহিক গল্প
অভীক মুখোপাধ্যায়
মৌন মিছিল
[২য় পর্ব]
পূর্বানুবৃত্তি সবার সামনে মুখে কালোকাপড় বেঁধে হুইলচেয়ারে বসে যে পক্ককেশ প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ, পরনে বাউলদের মতো আলখাল্লা, তিনি এককালের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী। এককালে তাঁর বহু কাজ লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হত। মিছিলের বিশিষ্টরা দেখা করবেন সেইসব রুটি রুজি হারা মানুষগুলোর সঙ্গে, সহমর্মিতা জানাবেন, মনোবল বাড়াবেন তারপর সেখান থেকে সোজা প্রেস ক্লাবে। তারপর…
তাঁর হুইলচেয়ার ঠেলা সেই মহানায়িকা থুড়ি পরিচালিকা মাঝেমধ্যেই আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলেন তাঁর সারির একদম শেষপ্রান্তে থাকা স্বপ্নালু চোখের তরুণটিকে। না তরুণটি কোন কেউকেটা নন, সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো এক শিল্পপতি-পুত্র। বাবার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত পুত্র একটি অতি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই পুত্রের সূত্র দিয়েই পৌঁছনো সম্ভব তার শিল্পপতি বাবার কাছে। সিনেমা বানাতে গেলে প্রযোজক লাগে আর আমাদের এই পরিচালিকা যে ধরণের সিনেমা বানান তার জন্য প্রযোজক পাওয়া একটু দুস্কর। শিল্পপতি বাবার আর্থিক সহায়তা পেতে গেলে ছেলেকে একটু প্রচারের আলোয় এনে দিতেই হবে, তা সে ধর্নামঞ্চেই হোক বা প্রেস কনফারেন্সে।
আর সেই কবি, মুখে কিছু না বললেও তাঁর ভেতরেও তোলপাড়। জ্বালাময়ী কবিতা লিখলে ফেসবুকে হয়তো লাইক-কমেন্টের বন্যা বয়, কিন্তু তাতে পেট ভরে না। কবি-জায়ার অনলাইন ব্যবসার দৌলতে দৈনিক জীবনযাপনে কোন অসুবিধে না হলেও আবার একটা বড় ব্রেক দরকার। এই আন্দোলন হয়তো তাঁকে সেই কাঙ্ক্ষিত প্ল্যাটফর্মটি দেবে। তিনি সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করছেন যথাসম্ভব। মনে মনে বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন গতরাতে লেখা কবিতার লাইনগুলো। তিনি নিশ্চিত এই কবিতার প্রতিটা শব্দ ধর্নামঞ্চে আগুন লাগাবে। এই আন্দোলনের ওপর লেখা কবিতাগুলোকে নিয়ে একটা সংকলন প্রকাশ করতে হবে। নাম দেবেন “দহন”। খালি একজন ভালো নামকরা প্রকাশক চাই।
মিছিলের মধ্যে অনেক টিভি রিপোর্টারের মধ্যেই রয়েছে এক ট্রেনি রিপোর্টার। মনে তাঁর একরাশ উদ্বেগ। যে ভাবেই হোক সেন্সেসানাল ব্রেকিং চাই চ্যানেলের নিউজ প্রোডিউসারের, না হলে কনফারমেশান হবে না। মাস-কমিউনিকেশান নিয়ে পড়াশোনার তিনবছর বাদে অনেক কষ্টে জোগাড় হয়েছে এই চাকরি। এটা চলে গেলে বসে যাবে সংসারটা। বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা দিয়ে তাঁর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ফিসের বন্দোবস্ত হয়েছিল, এখন চাকরি না থাকলে কী হবে ভাবলেও তার পায়ের তলার মাটি সরে যায় যেন।
মিছিলের ঠিক পেছনে পুলিশের জিপে বসা অফিসারের চোখদুটো বারবার বুজে আসছে, টানা আঠেরো ঘন্টা ডিউটিতে রয়েছে, কখন শেষ হবে কে জানে! শরীর আর দিচ্ছে না। মনেমনেই মিছিলকারীদের বাপান্ত করছিল সে, আইনরক্ষক মানে তো অতিমানব নয়। তার ইচ্ছে করছিল সামনের লোকগুলোকে লাঠিপেটা করতে, কাজ নেই কর্ম নেই, রাস্তায় নেমে পড়লেই হল।
ঠিক সেইসময়েই মিছিলের বেশ কিছুটা পেছনে জ্যামে আটকে থাকা অ্যাপক্যাবে বসে ঘামছিল সুকান্ত, বারবার ঘড়ি দেখছিল। হাতে আর মাত্র আধঘন্টা ইন্টারভিউ শুরু হতে। জ্যাম কাটলে ওই অফিসে পৌঁছতে দশমিনিটের বেশি লাগার কথা নয়, কিন্তু কাটলে তো! এই ফাইনাল ইন্টারভিউটা মিস করা যাবে না কিছুতেই। গত তিনমাস বসে রয়েছে, তার শেষ কোম্পানি তো কস্ট কাটিংয়ের বাহানা দেখিয়ে দশবছরের কর্মীকে বের করে দিতে একমিনিটও ভাবেনি। শুধু কী সে, আরও শ-তিনেকের চাকরি গেছিল সেদিন। কেউ কিন্তু তখন আন্দোলন করতে এগিয়ে আসেনি তাদের জন্য। উপরন্তু সেদিনেই তাদের সেই কোম্পানির মালিক মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে সরকারি আনুকূল্যে নতুন কারখানা খোলার কথা জানিয়েছিলেন সঙ্গে কয়েকহাজার লোকের কর্মসংস্থানের আশ্বাস। আর থাকতে না পেরে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই পরে সে, যদি দৌড়েও পৌঁছে যাওয়া যায়। এ গাড়ি সে গাড়ির ফাঁক গলে মিছিলের ঠিক পেছনেই পৌঁছে যায় আর তারপর মিছিলের মাঝ দিয়েই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে, সময় একদম নেই তার হাতে।
সে নিজের মতোই এগোচ্ছিল কিন্তু খেয়াল করেনি কখন যে সে হয়ে গেছে সব টিভি ক্যমেরার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, আসলে সে এই মিছিলে একটু ব্যতিক্রম তো তাই। তার হাতে না আছে পোস্টার না মুখে কালো ব্যান্ড। টাই-কোটে সে একেবারেই বেমানান এই মিছিলে।
-স্যার, আপনি এই মিছিলে কেন এলেন?
প্রশ্ন করে সেই ট্রেনি টিভি
রিপোর্টার।
-কে এসেছে এই মিছিলে! লাস্ট একঘন্টা ক্যাবে বসে থেকে থেকে নেমে এলাম, আর দেরি হলে ইন্টারভিউ মিস হয়ে যাবে। আমাদের খেটে খেতে হয়, মিছিল করলে পেট ভরবে থোড়াই। আমাকে প্লিজ যেতে দিন, অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে
সুকান্ত। মৌন মিছিলে তাকে ঘিরে যে কোলাহলটা তৈরি হচ্ছিল, তার উত্তরে
এক নিমেষে থেমে যায়। নিউজ চ্যানেলগুলো অবশ্য বাইট পেয়ে গেছে, ব্রেকিং-এ স্ক্রোল করছে,
-মিছিল করলে
পেট ভরবে থোড়াই...
অভীক মুখোপাধ্যায়
মৌন মিছিল
[২য় পর্ব]
"আরও শ-তিনেকের চাকরি গেছিল সেদিন। কেউ কিন্তু তখন আন্দোলন করতে এগিয়ে আসেনি তাদের জন্য। উপরন্তু সেদিনেই তাদের সেই কোম্পানির মালিক মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে সরকারি আনুকূল্যে নতুন কারখানা খোলার কথা জানিয়েছিলেন"
পূর্বানুবৃত্তি সবার সামনে মুখে কালোকাপড় বেঁধে হুইলচেয়ারে বসে যে পক্ককেশ প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ, পরনে বাউলদের মতো আলখাল্লা, তিনি এককালের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী। এককালে তাঁর বহু কাজ লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হত। মিছিলের বিশিষ্টরা দেখা করবেন সেইসব রুটি রুজি হারা মানুষগুলোর সঙ্গে, সহমর্মিতা জানাবেন, মনোবল বাড়াবেন তারপর সেখান থেকে সোজা প্রেস ক্লাবে। তারপর…
তাঁর হুইলচেয়ার ঠেলা সেই মহানায়িকা থুড়ি পরিচালিকা মাঝেমধ্যেই আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলেন তাঁর সারির একদম শেষপ্রান্তে থাকা স্বপ্নালু চোখের তরুণটিকে। না তরুণটি কোন কেউকেটা নন, সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো এক শিল্পপতি-পুত্র। বাবার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত পুত্র একটি অতি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই পুত্রের সূত্র দিয়েই পৌঁছনো সম্ভব তার শিল্পপতি বাবার কাছে। সিনেমা বানাতে গেলে প্রযোজক লাগে আর আমাদের এই পরিচালিকা যে ধরণের সিনেমা বানান তার জন্য প্রযোজক পাওয়া একটু দুস্কর। শিল্পপতি বাবার আর্থিক সহায়তা পেতে গেলে ছেলেকে একটু প্রচারের আলোয় এনে দিতেই হবে, তা সে ধর্নামঞ্চেই হোক বা প্রেস কনফারেন্সে।
আর সেই কবি, মুখে কিছু না বললেও তাঁর ভেতরেও তোলপাড়। জ্বালাময়ী কবিতা লিখলে ফেসবুকে হয়তো লাইক-কমেন্টের বন্যা বয়, কিন্তু তাতে পেট ভরে না। কবি-জায়ার অনলাইন ব্যবসার দৌলতে দৈনিক জীবনযাপনে কোন অসুবিধে না হলেও আবার একটা বড় ব্রেক দরকার। এই আন্দোলন হয়তো তাঁকে সেই কাঙ্ক্ষিত প্ল্যাটফর্মটি দেবে। তিনি সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করছেন যথাসম্ভব। মনে মনে বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন গতরাতে লেখা কবিতার লাইনগুলো। তিনি নিশ্চিত এই কবিতার প্রতিটা শব্দ ধর্নামঞ্চে আগুন লাগাবে। এই আন্দোলনের ওপর লেখা কবিতাগুলোকে নিয়ে একটা সংকলন প্রকাশ করতে হবে। নাম দেবেন “দহন”। খালি একজন ভালো নামকরা প্রকাশক চাই।
মিছিলের মধ্যে অনেক টিভি রিপোর্টারের মধ্যেই রয়েছে এক ট্রেনি রিপোর্টার। মনে তাঁর একরাশ উদ্বেগ। যে ভাবেই হোক সেন্সেসানাল ব্রেকিং চাই চ্যানেলের নিউজ প্রোডিউসারের, না হলে কনফারমেশান হবে না। মাস-কমিউনিকেশান নিয়ে পড়াশোনার তিনবছর বাদে অনেক কষ্টে জোগাড় হয়েছে এই চাকরি। এটা চলে গেলে বসে যাবে সংসারটা। বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা দিয়ে তাঁর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ফিসের বন্দোবস্ত হয়েছিল, এখন চাকরি না থাকলে কী হবে ভাবলেও তার পায়ের তলার মাটি সরে যায় যেন।
মিছিলের ঠিক পেছনে পুলিশের জিপে বসা অফিসারের চোখদুটো বারবার বুজে আসছে, টানা আঠেরো ঘন্টা ডিউটিতে রয়েছে, কখন শেষ হবে কে জানে! শরীর আর দিচ্ছে না। মনেমনেই মিছিলকারীদের বাপান্ত করছিল সে, আইনরক্ষক মানে তো অতিমানব নয়। তার ইচ্ছে করছিল সামনের লোকগুলোকে লাঠিপেটা করতে, কাজ নেই কর্ম নেই, রাস্তায় নেমে পড়লেই হল।
ঠিক সেইসময়েই মিছিলের বেশ কিছুটা পেছনে জ্যামে আটকে থাকা অ্যাপক্যাবে বসে ঘামছিল সুকান্ত, বারবার ঘড়ি দেখছিল। হাতে আর মাত্র আধঘন্টা ইন্টারভিউ শুরু হতে। জ্যাম কাটলে ওই অফিসে পৌঁছতে দশমিনিটের বেশি লাগার কথা নয়, কিন্তু কাটলে তো! এই ফাইনাল ইন্টারভিউটা মিস করা যাবে না কিছুতেই। গত তিনমাস বসে রয়েছে, তার শেষ কোম্পানি তো কস্ট কাটিংয়ের বাহানা দেখিয়ে দশবছরের কর্মীকে বের করে দিতে একমিনিটও ভাবেনি। শুধু কী সে, আরও শ-তিনেকের চাকরি গেছিল সেদিন। কেউ কিন্তু তখন আন্দোলন করতে এগিয়ে আসেনি তাদের জন্য। উপরন্তু সেদিনেই তাদের সেই কোম্পানির মালিক মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে সরকারি আনুকূল্যে নতুন কারখানা খোলার কথা জানিয়েছিলেন সঙ্গে কয়েকহাজার লোকের কর্মসংস্থানের আশ্বাস। আর থাকতে না পেরে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই পরে সে, যদি দৌড়েও পৌঁছে যাওয়া যায়। এ গাড়ি সে গাড়ির ফাঁক গলে মিছিলের ঠিক পেছনেই পৌঁছে যায় আর তারপর মিছিলের মাঝ দিয়েই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে, সময় একদম নেই তার হাতে।
সে নিজের মতোই এগোচ্ছিল কিন্তু খেয়াল করেনি কখন যে সে হয়ে গেছে সব টিভি ক্যমেরার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, আসলে সে এই মিছিলে একটু ব্যতিক্রম তো তাই। তার হাতে না আছে পোস্টার না মুখে কালো ব্যান্ড। টাই-কোটে সে একেবারেই বেমানান এই মিছিলে।
-স্যার, আপনি এই মিছিলে কেন এলেন?
-কে এসেছে এই মিছিলে! লাস্ট একঘন্টা ক্যাবে বসে থেকে থেকে নেমে এলাম, আর দেরি হলে ইন্টারভিউ মিস হয়ে যাবে। আমাদের খেটে খেতে হয়, মিছিল করলে পেট ভরবে থোড়াই। আমাকে প্লিজ যেতে দিন, অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment