প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, May 16, 2025

দহন [৩য় পর্ব] | সঙ্ঘমিত্রা দাস

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৮ম সংখ্যা/১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
সঙ্ঘমিত্রা দাস
 
দহন
[৩য় পর্ব]

"আমি দেখলাম কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে মেঘ সরিয়ে আকাশের পথে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাঙাপিসি ওই কুন্ডলীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। আজ পিসি একদম সাদা একটা শাড়ি পড়েছেকোন ছাপা নেই। বুকে এখনো রেডিয়োটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে‌ আমি চিৎকার করে ডাকলাম"


পূর্বানুবৃত্তি বাড়িতে শুরু হয়ে গেল এক ভীষণ যুদ্ধ। মায়ের টিভি বনাম রাঙাপিসির রেডিয়ো। আমারও রাঙাপিসির কাছে যাওয়া কমে গেল। স্কুল থেকে ফিরে টিভি চালিয়ে দিতাম। পিসি ডাকলে দৌড়ে একবার ঘুরে আসতাম। পিসি আরও একাকিত্বে ডুবে যেতে থাকল আর তার জেদ দিনে দিনে বেড়েই চলল। ভিতরে ভিতরে ভাঙলেও সামনে কারোকে বুঝতে দিত না। তারপর…
 
কালিপুজো শেষ হয়েছে কয়েকদিন হলো। হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছিল। সেদিন ছিল ছুটির দিন। ভোরবেলা রাঙাপিসির রেডিয়োর সুরে ঘুম ভেঙেছিল। মায়ের একটু জ্বর জ্বর ভাব ছিল। বেশ খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চা বসিয়েছিল। বাবা বারান্দায় পিসির কাছে বসে। আমি তখন ঘরে। পিসির রেডিয়ো আপন মনে চলছে দাওয়ায়। মা হঠাৎ কেন যেন ভীষণ রেগে গেছিল। আচমকা রেডিয়োটা হাতে নিয়ে গটগট করে উঠোনে নেমে গেল,
-সারাদিন আর তো সহ্য হয় না। শেষ করে দেবে এই রেডিয়ো আমায়। তার আগে আমিই এটা ভেঙে শেষ করে দেবো
মায়ের ব্যবহারে সবাই হতবাক হয়ে গেছিলাম। পিসি ছুটল মায়ের পিছনে।
-বৌদি, আমার রেডিয়ো ফেরত দাও। ওটা আমার, তুমি হাত দেবে না। এখনি ফেরত দাও।

মা তুলসি তলায় পৌঁছেছে রেডিয়ো নিয়ে। হঠাৎ শাড়িতে পা বেধে পিসি সজোরে উঠোনে পড়ে গেল। বাবা ছুটল পিসির কাছেমাও রেডিয়োটা তুলসিমঞ্চের কাছে নামিয়ে ছুটে এলো।
-ছোটদি ওঠো, কী হল তোমার। এই নাও তোমার রেডিয়ো। চোখ খোলো। ও ছোটদি।
আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। পিসি চোখ খুলল না। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল, উনি জানিয়ে দিলেন রাঙাপিসি আর নেই। মা চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
-ছোটদি আমি এটা চাইনি। তুমি আমার ওপর এতটা অভিমান করলে। ফিরে এসো ছোটদি, আমাকে একটিবার মাফ করে দাও। দেখো তোমার রেডিয়ো একদম ঠিক আছে।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম। এতদিন পিসি আমাদের সাথে কাটিয়ে আজ এভাবে চলে গেল।
বাবার মুখ থমথমে। পাড়ার অনেকেই উঠোনে জড়ো হয়েছে।
 
সময় বয়ে চলল। সকাল গড়িয়ে দুপুর। বাড়িতে কিছু রান্না হয়নি। কারোর খাওয়াও হয়নি। আমাকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিল পাশের বাড়ির মিতালী কাকিমা। ফুলে ফুলে সেজে আমার রাঙাপিসি খাটে চড়ে বাবা আর অন্য কয়েকজনের কাঁধে করে চলে গেল। আমিও যাবার বায়না ধরেছিলাম। ছোট বলে সঙ্গে নিল না কেউ।
 
সন্ধে হয়ে আসছে। মা এখনো কেঁদে চলেছে।
-কী হয়ে গেল? ছোটদি তুমি রাগ করে চলে গেলে? একবার ফিরে এসো।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কোলের কাছে বসে আছি। মায়ের জ্বর বেড়েছে আমার গায়ে বেশ ছ্যাঁকা লাগছে। সারাদিন না খাওয়া। অনেকেই একটু খাবার জন্য জোরাজুরি করে ব্যর্থ হয়েছে। মায়ের কান্নায় সবার চোখে জল। আশেপাশের বাড়ির কাকিমা-জেঠিমারা বারান্দায় বসে বাবা আর অন্যদের ফেরার অপেক্ষায়।
 
তুলসিমঞ্চে একটা হ্যরিকেন রাখা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। বাবা তখনো ফেরেনি শ্মশান থেকে। কারেন্ট নেই। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া খেলে গেল। কোথাও বোধহয় ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ঠান্ডা শীতল হাওয়া। কী করে কী জানি হ্যারিকেনটা উল্টে পড়ল পিসির কুড়িয়ে জড়ো করা শুকনো পাতার ঝুঁড়িটায়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। পাশেই রাখা রেডিয়োটায় আগুন ছড়িয়ে গেল নিমেষে। আমি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,
-আগুন আগুন
ততক্ষণে দাউদাউ করে পুড়ছে রেডিয়ো। মা ছুটে যেতে গেল কলের কাছে রাখা জল ভরা বালতির দিকে, আগুন নেভানোর জন্য। মিতালী কাকিমা মায়ের হাত চেপে ধরল,
-ছোটদিকে রেডিয়োটা নিয়ে যেতে দাও দিদি, বাধা দিও না
আমি দেখলাম কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে মেঘ সরিয়ে আকাশের পথে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাঙাপিসি ওই কুন্ডলীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। আজ পিসি একদম সাদা একটা শাড়ি পড়েছে, কোন ছাপা নেই। বুকে এখনো রেডিয়োটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে‌ আমি চিৎকার করে ডাকলাম,
-রাঙাপিসি, রাঙাপিসি
পিসি একবারও তাকালো না পিছনে। চলতে চলতে মেঘের আড়াল থেকে হারিয়ে গেল আকাশপথে। বাবা ফিরে এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। আমি ছুটে গেলাম, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, সেদিন বাবার চোখেও জল দেখেছিলাম।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)