প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, May 16, 2025

দহন [২য় পর্ব] | সঙ্ঘমিত্রা দাস

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৭ম সংখ্যা/৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
সঙ্ঘমিত্রা দাস
 
দহন
[২য় পর্ব]

"মা বেশ জোরে পা ফেলে এসে দুম করে রেডিয়ো বন্ধ করে চলে যেত। রাঙাপিসিও মা চলে যাবার সাথেসাথেই আবার উচ্চস্বরে চালিয়ে দিত। আমার বেশ লাগত গাননাটকখবরবা অন্য সব অনুষ্ঠান শুনতে।"


পূর্বানুবৃত্তি রাঙাপিসির কপালে স্বামী-সুখ বেশিদিন টিকল না। একবার খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজে আন্দামান যাবার পথে ভয়ংকর এক ঝড়ে পড়ল জাহাজ। পিসির জীবনেও নেমে এলো অন্ধকার। পিসেমশাই একটা রেডিয়ো উপহার দিয়েছিল রাঙাপিসিকে। ওটি নিয়েই তার সময় কাটত। তারপর…
 
রাঙাপিসি বারান্দায় কোণের ঘরটায় আপন মনেই থাকত। শান্ত স্বভাবের, বেশি কথা বলত না। পাশের বাড়ির কাকিমা, জেঠিমারা মায়ের সাথে গল্প করতে আসলে পিসিকে কোনদিন সেখানে যোগ দিতে দেখিনি। আপন মনে নিজের কাজ নিয়ে থাকত। সকালে পুরো উঠোন ঝাঁট দিয়ে বড় কদম গাছটার ঝরা ফুল পাতা জড়ো করে একটা ঝুঁড়ি ভরে রাখতো তুলসি তলায়। উঠোনে মাদুর পেতে তেঁতুল, লঙ্কা শুকোত। আর দাওয়ায় পিলারটার গায়ে রাখা থাকতো রেডিয়ো। ওটা চলত বেশ জোরেই। মন দিয়ে কাজ করলেও কান থাকত ওটাতেই।
 
মায়ের সাথে বিশেষ সখ্যতা ছিল না। মা সংসারের বা রান্নাঘরের কোন কাজে সাহায্য চাইলে চুপচাপ সেটুকুই করে দিত। আগবাড়িয়ে কোনদিন কিছু করতে দেখিনি। প্রয়োজন কিছু হলে বাবাকেই বলত আর আমাকে খুব ভালো বাসতো। আচার, কাঁচা আম খেতাম একসাথে দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে। বারান্দায় মাদুরে শুয়ে স্কুলের গল্প করতাম। মাথার কাছে চলত রেডিয়ো‌। কী সুন্দর গান হতো, নাটক হতো। আমারও পিসির মতো ওই যন্ত্রটা প্রিয় হয়ে উঠেছিল। সারাদিনই কিছু না কিছু অনুষ্ঠান চলছেই।
 
মায়ের এই বিষয়ে বেশ আপত্তি ছিল। মাঝে মাঝেই ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠত,
-ছোটদি, রেডিয়োটা একটু কমাও, মাথা যে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায়।
কখনও আমাকেও টেনে নিয়ে আসত ওখান থেকে,
-সারাদিন ওই গানবাজনা শুনলে পড়াশোনা গোল্লায় যাবে।
বাবার কাছে মাঝেমধ্যে অভিযোগ করত সারাদিনের ওই রেডিয়ো চলা নিয়ে। বাবা যদিও বিষয়টাকে বিশেষ আমল দিতেন না। মায়ের রাগ তাতে আরো বেড়ে যেত। পিসি কোন প্রতিবাদ না করলেও রেডিয়োর ভল্যুম কোনদিন কমাননি। এই বিষয়ে তার জেদটা একটু বেশিই ছিল‌।
 
ধীরে ধীরে এই নিয়ে অশান্তি বাড়তে থাকে। বাবার সামনে দুজনেই চুপ থাকলেও আড়ালে লড়াই চলছিল যন্ত্রটা ঘিরে। কখনও মা বেশ জোরে পা ফেলে এসে দুম করে রেডিয়ো বন্ধ করে চলে যেত। রাঙাপিসিও মা চলে যাবার সাথেসাথেই আবার উচ্চস্বরে চালিয়ে দিত। আমার বেশ লাগত গান, নাটক, খবর, বা অন্য সব অনুষ্ঠান শুনতে। পিসির কাছে নানা খাবার আর রেডিয়ো শোনার লোভে যেতাম, মা প্রায়ই টানতে টানতে নিয়ে এসে পড়তে বসিয়ে দিত। চেঁচিয়ে বলত,
-ওই রেডিয়ো একদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবো, আর তো সহ্য হয় না
প্রতিবাদে রেডিয়োর ভল্যুম আরো বেড়ে যেত। রাঙাপিসি মুখে কোন উত্তর দিতো না। চলছিল এভাবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ির অন্দরে টিভি জায়গা করে নিল। আশেপাশে কয়েকজন টিভি কেনায়, মায়েরও বায়না শুরু হল। ঘরে এলো টিভি। এতদিন শুধু শোনা জিনিস, চোখের সামনে দেখতে পাওয়া এ যে কী আনন্দের। মা সন্ধের রান্না তাড়াতাড়ি সেরে বসে যায় টিভির সামনে। আমিও রাঙাপিসির রেডিয়ো ছেড়ে মায়ের দলে যোগ দিলাম। চিত্রহারে হিন্দি সিনেমার গান, ছুটির দিন সিনেমা দেখা। সে কী মজা।
 
আমাদের বাড়িতে শুরু হয়ে গেল এক ভীষণ যুদ্ধ। মায়ের টিভি বনাম রাঙাপিসির রেডিয়ো। মা প্রথম-প্রথম রাঙাপিসিকে টিভি দেখার জন্য ডাকতে গেলেও রাঙাপিসি কখনো টিভি দেখতে আসেনি। বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে আর আমিও স্কুলে চলে গেলে দুজনের লড়াই শুরু হতো। আমি বাড়ি ফিরে বেশ বুঝতাম দুজনের মুখই কেমন থমথমে। মা যখনই উৎসাহ নিয়ে টিভি চালিয়ে একটু বসত, রাঙাপিসির রেডিয়োর আওয়াজ বেড়ে যেতো। টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখার উপায় থাকত না, রেডিয়োর আওয়াজে। মাও টিভির আওয়াজ বাড়িয়ে দিত। মা রেগে থাকত এসব নিয়ে। রাঙাপিসি নির্বিকার। সেটা মাকে আরো বিরক্ত করে তুলত। দিনে দিনে দুজনের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করল আরও। কথা বন্ধ হল। রাঙাপিসি নিজের নিয়মে রেডিয়ো চালিয়ে যেতে থাকল, মায়ের জেদ বাড়তে থাকল। না দেখলেও টিভিও চলতে থাকল সারাদিন। আর রেডিয়োর উদ্দেশ্যে মায়ের চলত "ফেলে দেবো, ভেঙে দেবো" এরকম হুমকি।
 
আমারও রাঙাপিসির কাছে যাওয়া কমে গেল। স্কুল থেকে ফিরে টিভি চালিয়ে দিতাম। কখনও খেলা, কখনও কার্টুন দেখতে দেখতে স্নান-খাওয়া সারতাম। পিসি ডাকলে দৌড়ে একবার ঘুরে আসতাম। হাতে নাড়ু মোয়া নিয়ে পালিয়ে আসতাম। পিসি আরও একাকিত্বে ডুবে যেতে থাকল আর তার জেদ দিনে দিনে বেড়েই চলল। ভিতরে ভিতরে ভাঙলেও সামনে কারোকে বুঝতে দিত না। আমরাও তাই বিশেষ বুঝিনি সমস্যা অনেক দূর পর্যন্ত গড়াচ্ছে।

ক্রমশ…
 

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)