বাতায়ন/দহন/ধারাবাহিক
গল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ধারাবাহিক গল্প
সঙ্ঘমিত্রা
দাস
দহন
[১ম পর্ব]
"পিসি রেডিয়োটা আঁকড়ে ধরে খুব কেঁদেছিল বলে ওটা আর নিতে পারেননি। পিসেমশাই রেডিয়োটা উপহার দিয়েছিল রাঙাপিসিকে। এত বড় সুন্দর যন্ত্রটি ছিল পিসির প্রাণের চেয়েও প্রিয়।"
রাঙাপিসি আমার নিজের পিসি নয়, বাবার পিসতুতো বোন। রাঙাপিসির শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান।
পিসেমশাই চাকরি করতেন সেই সুদূর আন্দামানে। তখন যাতায়তের এত সুবিধা ছিল না, বছরে একবার বা কখনও দুবছরে একবার তিনি আসতেন। আমার বাবার
নিজের কোন বোন ছিল না তাই রাঙাপিসিই ছিল বাবার খুব কাছের। ভাইফোঁটার সময় বাবা
প্রতিবছর বর্ধমান চলে যেতেন ফোঁটা নিতে। পিসেমশাই এলে এক-আধবার ওনারা
আমাদের বাড়িতে এসেছেন। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন পিসেমশাই, আমাকে ব্যাটারিতে চলা গাড়ি, বন্দুক এনে দিতেন যখনই আসতেন।
কিন্তু পিসির কপালে স্বামী-সুখ বেশিদিন
টিকল না। একবার খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজে আন্দামান যাবার পথে ভয়ংকর এক ঝড়ে পড়ল জাহাজ। পিসেমশাই নিজেকে সামলাতে না পেরে মাঝ সমুদ্রে পড়ে
তলিয়ে গেলেন। তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হল না। পিসির জীবনেও নেমে এলো অন্ধকার। ধীরে
ধীরে শ্বশুরবাড়িতে থাকা দুর্বিসহ হয়ে উঠল। একে বিধবা তাতে নিঃসন্তান। শ্বশুর-শাশুড়ির চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল রাঙাপিসি। জা-ভাসুরেরাও
খুব খারাপ ব্যবহার করত। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না, তার ওপর ছিল ঘরের যাবতীয় পরিশ্রমের কাজ। পিসির বাবা-মা আগেই মারা
গেছিলেন, দাদারা বোনের দায়িত্ব
নেবার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। ধীরে ধীরে শরীর, মন সবদিক থেকেই ভাঙতে শুরু করে রাঙাপিসি।
আমার বাবা ছিলেন কোলকাতা
হাইকোর্টের চাকুরে। ভীষণ রাসভারী ও মেজাজী মানুষ। একদিন কাজে বর্ধমান হয়ে ফেরার
পথে পিসির বাড়ি গিয়ে সবকিছু দেখে,
সেই
মুহূর্তে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বোনকে নিয়ে ফিরলেন
কোলকাতা।
বাড়ি পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে
গেল। বাবা উঠোন থেকেই মাকে হাঁক পাড়লেন। বারান্দার কোণের ঘরটা পিসির থাকার ব্যবস্থা করার হুকুম এলো। দেখলাম পিসির
সাজ বদলেছে। পরনে সাদার ওপর কালো কলকার শাড়ি, গায়ে কোন গয়না নেই আগের মতো। রীতিমতো
সুন্দরী রাঙাপিসির মুখটা এখন অনেকটাই মলিন। কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ যাতে দুই-তিনটে শাড়ির বেশি ধরবে না আর দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন বড় একটি রেডিয়ো। হালকা হলুদ রঙের বাক্সের মতো, তাতে কালো দুটো বোতাম। একটা বড়, একটা ছোট। আমাদের
ঘরেও একটা রেডিয়ো আছে। ছোট, কালো রঙের। বাবার
পড়ার টেবিলে থাকে। সকালে অফিসে যাবার আগে সাড়ে-সাতটার খবরটা চলে ওটায়। আমার বা
মায়ের বিশেষ আগ্রহ নেই ওই যন্ত্রে।
কিন্তু এত বড় একটা রেডিয়ো দেখে
আমার খুব আগ্রহ জন্মেছিল। বাবার কাছে পরে শুনেছিলাম পিসি আসার সময় তার
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সবকিছু কেড়ে রেখে দিয়েছিলেন। পিসি রেডিয়োটা আঁকড়ে ধরে খুব কেঁদেছিল বলে ওটা আর নিতে পারেননি। পিসেমশাই রেডিয়োটা উপহার দিয়েছিল রাঙাপিসিকে। এত বড় সুন্দর যন্ত্রটি ছিল পিসির প্রাণের
চেয়েও প্রিয়। ওটি নিয়েই তার সময় কাটত। মনে হতো পাশে কেউ
আছে, গল্প করছে, কথা বলছে। যখন পিসেমশাই বাইরে থাকতেন পিসির একাকিত্ব ওই রেডিয়ো অনেক
কমিয়ে দিত।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment