প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, May 16, 2025

অচেনা প্রতিবেশী [১ম পর্ব] | হিমাদ্রি শেখর দাস

বাতায়ন/দহন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

দহন | ধারাবাহিক গল্প
হিমাদ্রি শেখর দাস
 
অচেনা প্রতিবেশী
[১ম পর্ব]

"অশোকের নজর পড়ে দলের কমবয়সি এক ছেলের উপর। একটু আগে যাকে দেখে অবাক হয়েছিল। ছেলেটি গাছের মগডালে স্প্রে করে বেড়াচ্ছে অশোককে অভিভূত করে দিয়েছিল খুব ইচ্ছে হল ওর সঙ্গে আলাপ করার"


বাপির বাড়িতে যাবে বলে রুবি হাসপাতাল থেকে বারাসাতগামী বাস ধরে অশোক। রুবির প্যাথলজিতে কাজ করে। দুজনের সম্পর্ক বন্ধুত্ব। প্যাথলজি আর সব স্টাফদের নিমন্ত্রণ করেছে বৌভাতের দিন। শুধু অশোকের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলে বিয়ের দিনও ডাক পড়েছে ওর। এয়ারপোর্টে দ্রুতগতিতে চলল বাসটা। বাপির দেওয়া ঠিকানায় নির্দেশমতো মধ্যমগ্রামের পৌঁছলো তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। এখান থেকে যেতে হবে হুমাইপুর। উপায় একমাত্র অটো। এখানকার নিয়ম আলাদা, সামনে-পেছনে কমপক্ষে আটজন না হলে অটো ছাড়ে না, হাতে একটু সময় আছে দেখে পাশে দোকান থেকে এক প্যাকেট ভালো মিষ্টি কিনে নেয় অশোক। গিফ্‌ট কাল কিনবে। কারণ বৌভাতের দিন সেটা কিনলে খরচটা শেয়ার হবে। ভাবতে ভাবতে অটোতে ওঠে। হুমাইপুর মোড়ে যখন অটোটা থামল, তখন দুপুর। মাথার উপর গ্রীষ্মের কড়া দহন

 
অশোক সামনের একটা দোকানে জিজ্ঞাসা করে—
-দাদা বাদলপুর যাব কীভাবে?
-বাঁ দিকের রাস্তা ধরে চলে যান, প্রথমে পাটুলি তারপরই বাদলপুর।
-আচ্ছা রিক্সা পাওয়া যাবে না?
-কিছু ভ্যান-রিকশা যায় বটে, তবে এই ভরদুপুরে পাবেন না, হেঁটে চলে যান।
কী করবে ভেবে একটু দাঁড়ায় অশোক। এই সময় একটি মেশিনরিক্সা দেখতে পায়, তড়িঘড়ি তার কাছে গিয়ে বলে,
-দাদা পাটুলি-বাদলপুর দিকে যাবেন?
-না ওই দিকে যাই না। পাটুলি গ্রামের মধ্য দিয়ে মেশিনরিক্সা যাওয়ার অনুমতি নেই
উপায় না দেখে অগত্যা হাঁটা দেয় অশোক। কিছুটা যাওয়ার পরই রাস্তার বাঁদিকে একটা রংচটা তোবড়ানো টিনের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে, তাতে লেখা ওরা গ্রামেরই একজন ওদের বাঁচতে দিন এবং নীচের দিকে একটা তির চিহ্ন দিয়ে লেখা 'পাটুলি'। শহরে থাকা ছেলে অশোক চারদিকে ঘরবাড়ি, বাসগাড়ি আর কোলাহলের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। ওর মনটা আনন্দে ভরে উঠল চারদিকে গাছপালা- আম, জাম, জামরুল, বট, চালতা। রাস্তার দুদিকে ঘন গাছের ভিড়। সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলল নিজেকে। মনে করতে পারছে না- এত কড়ারোদ, মাথার উপর গ্রীষ্মের সূর্য।
 
দহনেও কোথায় যেন উবে গেছে সব ক্লান্তি। হাঁটতে হাঁটতে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলো ও। হঠাৎ দেখতে পেল কিছু লোকের একটা দলকে। কী করছে ওরা? অবাক বিস্ময়ে তাড়াতাড়ি আরেকটু এগিয়ে গেল। দেখল লোকগুলো গাছে গাছে স্প্রে করে বেড়াচ্ছে। অশোকের মনে পড়ল গাছের মুকুল ধরে রাখার জন্য কৃত্রিম হরমোন স্প্রে করা হয়। তবে তা দুপুরে কিনা তা মনে পড়ল না। কিন্তু এই মরশুমে তো এসব গাছে কোন মুকুল নেই তবে না না, জিজ্ঞেস করলে বোঝা যাবে ভেবে আর একটু এগিয়ে জোর গলায় হাঁক দেয়—
-এই যে শুনছেন
কিছুদূরে মাদুর পেতে বসে ছিলেন যে বয়স্ক ভদ্রলোক সেখান থেকেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সতর্ক করলেন অশোককে। মানে চুপ, কথা বলা বন্ধ। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। অশোকের একেবারে কাছে ধীর গলায় শুধালেন-
-কী খুঁজছ বাবা?
-না, আমি
আবার ভদ্রলোক আঙুল চাপালেন ঠোঁটে—
-আস্তে বলো।
আশ্চর্য হল অশোক। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করতে সাহস হল না। তাই ধীরে ধীরে বলল,
-না আমি কিছু খুঁজছি না, আমি বাদলপুর যাচ্ছি। আপনাদের সব কীর্তিকলাপ কিছুতেই বুঝতে পারছি না
তাই জানতে ইচ্ছে করল কী করছেন ওরা মানে আপনারা?
-তাহলে একটু দূরে চলো বাবা এখানে জোরে কথা বলা যাবে না
-কেন?
-চলো বলছি।
কিছুটা দূরে গিয়ে একটা ছোট গাছের নীচে বসলেন ভদ্রলোক। কিছুটা দূরে বেদি করা হয়েছে, সেখানে অশোককে বসতে বললেন, তারপর- পরিচয় বিনিময় করলেন,
-আমার নাম আখতার আলি।
-আমি অশোক, নমস্কার।
আখতার আলির বয়স সত্তরের ওপারে হবে আন্দাজ করল অশোক। আখতার আলি বললেন,
-জোরে কথা বলি না কেন জানো কারণ এই সময় আমাদের প্রতিবেশীদের বিশ্রামের সময়। তাই আমরা কেউ জোরে আওয়াজ করি না অন্যদের সাবধান করে দিয়েছি বাজি ফাটানো দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রতিবেশী এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে, অবাক হয় অশোক। আখতার আলি বলেই চলেন,
-আমাদের প্রতিবেশী বাপ-ঠাকুরদা আমল থেকেই গ্রামে আছে। ঘন গাছের ডালপালা এদের আশ্রয়। প্রতিবেশী আবার গাছে থাকে! অবাক হয়ে যায় অশোক জিজ্ঞাসা করে,
-আপনাদের প্রতিবেশী গাছে থাকে?
মৃদু হাসেন আখতার আলি। বলেন,
-হ্যাঁ সেজন্যই তো ওরা ভরদুপুরে দহনের মধ্যেও গাছে গাছে স্প্রে করছে যাতে ঠান্ডা থাকে। যাতে গাছগুলো ঠান্ডা থাকে। ঠান্ডা থাকলে ওরা আরাম পায়।
আখতার আলির কথা বুঝতে পারে না অশোক। কেমন যেন খাপছাড়া মনে হয়। ঠিকঠাক বোধগম্যের জন্য বলে,
-কারা আপনাদের প্রতিবেশী? যাদের জন্য এত নিয়মশৃঙ্খলা আর আইনকানুন।
আখতার আলি কিছু বলতে যাবেন এমন সময় দলের বাকি সদস্যরা সেখানে এসে যায়। অশোকের নজর পড়ে দলের কমবয়সি এক ছেলের উপর। একটু আগে যাকে দেখে অবাক হয়েছিল। ছেলেটি গাছের মগডালে স্প্রে করে বেড়াচ্ছে অশোককে অভিভূত করে দিয়েছিল খুব ইচ্ছে হল ওর সঙ্গে আলাপ করা তাই আখতার আলি উত্তর দেবার আগে ছেলেটিকে বলল,
-তুমি গাছের মগডালে উঠে স্প্রে করছিলে না?
-আজ্ঞে হ্যাঁ
ছেলেটি উত্তর দেয় তারপর পরিচয় করার জন্য বলে,
-আমার নাম কানাই।
-এত উঁচু ডালে ডালে ঘুরে বেড়াও স্ট্যাফ ব্যবহার করো না? তোমার ভয় লাগে না?
-আগে করত, এখন আর করে না। ভয় করলে প্রতিবেশীদের বাঁচাব কী করে? তাই ভয় থাকলে চলে না।
-আচ্ছা এসব কী কোন সংস্থার কাজ না কোন প্রজেক্ট?
-না না, তা হতে যাবে কেন, আমরা গ্রামের সবাই মিলে চাঁদা তুলে এসব করি শুধু প্রতিবেশীদের কথা ভেবে।
প্রতিবেশী প্রতিবেশী সবার মুখে কথাটা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠে অশোক। কথাটা সবাই বলছে অথচ প্রতিবেশী কে বা কারা তার কোনো সদুত্তর দিচ্ছে না। বিরক্তির সঙ্গে কৌতূহলটা আরো গাঢ় হয় অশোকের বলে, -আপনারা সবাই প্রতিবেশী প্রতিবেশী বলছেন সবসময় অথচ তাদের নাম বলতে এত কুণ্ঠা বোধ কেন করছেন? কে বা কারা প্রতিবেশী বলুন না
আকতার আলি বললেন,
-সরাসরি নাম বললে হয়তো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারো তোমরা শহরের লোক তাই নাম বলার চেয়ে তোমাদের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাব সেখানে গেলে একটা আন্তরিকতা জন্মাবে বলে মনে করি। আচ্ছা তুমি কি আফ্রিকার মোমবাসা, নিউগিনির অধিবাসী গ্রাম কিংবা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে নাম শুনেছ?
আকাশ থেকে পড়ে অশোক, আমতা আমতা করে বলে,
-না জানি না
কানাই বলে,
-জানেন না, তবে আমাদের গ্রামের কথাও জানবেন না।
আখতার আলি বলে,
-২০১২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে সম্মেলন হয়েছিল তাতে আমাদের আমন্ত্রণ ছিল, এখান থেকে হামিদ আর কানাই গিয়েছিল সেই সম্মেলনে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কানাইয়ের মুখ গর্বে রাঙা হয়ে ওঠে। বলে,
-এবার আসুন আপনাকে দেখাই আমাদের প্রতিবেশীদের।
আর অপেক্ষা করতে পারে না অশোক। অদম্য কৌতূহল নিয়ে কানাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়িয়ে চলে। ঘন পাতায় ঢাকা একটা বটগাছের তলায় এসে থেমে যায়। কানাই বলে,
-উপরের দিকে এবার তাকিয়ে দেখুন।
 
ক্রমশ…

1 comment:

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)