প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, May 16, 2025

শেষ থেকে শুরু [পর্ব— ২৭] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/দহন/ধারাবাহিক উপন্যাস/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা চ্যাটার্জি
 
শেষ থেকে শুরু
[পর্ব— ২]

"সুপ্রকাশের বিয়ের পরপরই সজল চলে গিয়েছিল। প্রায় ছবছর পরে বউদির জমজ ছেলেমেয়ে হয়। তাই ওরা তাতাইকে শুধু ছবিতে দেখেই চিনেছে। একটা পারিবারিক আনন্দময় পরিবেশে বাড়িটা রমরম করে উঠল।"


পূর্বানুবৃত্তি মনকলির অসুখটা খুবই বেড়ে গেছে, প্রবীর কলকাতায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা জেনেছে এবার রেডিয়েশন দিতে হবে, তাও একরকম ঠিক আছে। কারণ কেমো দিলে চুল সব উঠে যায় তখন মানসিকভাবে মনকলি আরও ভেঙে পরে। বড়ন্তির জলাধার চোখে-মনে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিল। ক্ষণিকের জন্য একটা সুন্দর অনুভুতির সংগীত মনের বীণার তারে তারে বেজে উঠল। তারপর…
 

পথে আসতে আসতে সজল জানাল,
-আমিও ভাবছি আজই ওদের সাথে কলকাতায় যাই, কতদিন মাকে দেখিনি, একাই তো যাচ্ছি, আশা করি বাবা আর কিছু বলবেন না বল?
-না না তুই নিশ্চিন্তে যা, আরে যতই হোক বাবা তো বাবাই হন তাই না?

-তুই তো আমার বাবাকে চিনিস? অর্থের অহংকার প্রচণ্ড। তিনি সবচেয়ে আনন্দ পান আমার মাকে কষ্ট দিয়ে। আমি দীর্ঘদিন মাকে দেখিনি বা মা আমায় দেখেনি এতে মায়ের ভেতরটা যে ফেটে যাচ্ছে তা তিনি জানেন, তাই যদি আমাকে আটকান আমি মাকে বলব সাতদিন অপেক্ষা কর, আমি ভিসা করিয়ে টিকিট কেটে তোমাকে নিয়ে চলে যাব, দরকার হলে পার্মানেন্ট ভিসা করিয়ে নেব। শেষ জীবনে মায়ের সমস্ত চোখের জলের দাম বাবাকে দিতে হবে। হ্যাঁ বাবার অমতে বিয়ে করব, বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করিনি তাই এই শাস্তি মা ছেলেকে বাবা দিতে পারেন না আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। আসলে টাকার কুমির, টাকা পেয়ে আর আশ মিটছে না। বড়দার বিয়ের সময় দুলাখ টাকা নগদ নিয়েছিল। দাদা তো কিছু বলতে পারে না, আমি দাদার হয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম তোমার তো এত টাকা, তোমার সম্মানে লাগে না, মাত্র দুলাখ টাকা হাত পেতে নিতে। বড়দা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেড আমি আর বড়দা দুজনে মিলে বউদির বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে টাকাটা দিয়ে এসেছিলাম অনেক বুঝিয়ে, যে নগদ নেওয়াতে আমাদের ঘোর আপত্তি, শুধু তাই নয়, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের আধুনিক বলি অথচ পণের জন্যে মেয়েকেও পণ্য করে তুলি। এইটা আমাদের করতে হয়েছিল কারণ আমরা শুনেছিলাম মেয়ের নাকি পণ দিয়ে বিয়ে করতে ভীষণ আপত্তি আবার দাদার এই আপত্তির জন্য মেয়ের তেজস্বী মনোভাবের জন্য মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছিল, তাই বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের এই ব্যাপারে আমি দাদাকে পুরোপুরি সঙ্গ দিয়েছিলাম বলে আমি বউদির খুব প্রিয় দেওর। দাদার ছেলেমেয়ে আমার কী ভক্ত ছিল, কাকাই বলতে পারত না ছোটবেলায় তাই তাতাই বলত। সংসার ছেড়ে এভাবে নিজের আপনজনদের ছেড়ে কতদিন থাকা যায়? ওরাও আমার জন্য ছটপট করছে বিশেষ করে মা, তাই এবার ঠিক করেছি যাবই। দাদা একটা বড় ফ্ল্যাট কিনেছে, মাকে সুদ্ধ নিয়ে যাবে ভেবে রেখেছে, মাও যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছেন কতদিন আর মানুষ এরকম দমবন্ধ হয়ে থাকতে পারেন  বল?
রাহুল বলল,
-আমি বলি কী, তুই ভালো করে দাদাকে ফোন করে কালকে যাস, আজকে গেলে বড্ড হুটোপুটি হয়ে যাবে
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস তাই হবে। আমি এবার ঠিক করেই এসেছিলাম বাড়ি যাব আর সবার সাথে দেখা হবে, সবার জন্য অনেক উপহারও নিয়ে এসেছি।
একটু পরেই মনকলি আর প্রবীর রওনা দিল, যাবার সময় মনকলি সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, সুচরিতারও মনে হচ্ছে যতই ওকে সান্ত্বনা দিক কিন্তু নিজে কি একটুও শান্তি পাচ্ছে? খালি মনে হচ্ছে, আবার দেখা হবে তো? সজল প্রবীরের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
-আমি কালই কলকাতায় যাচ্ছি, কলকাতায় কয়েকদিন থাকব, কিছু কাজ আছে। তুমি কলকাতায় ওকে যিনি চিকিৎসা করতেন তাকে দিয়ে একবার দেখিয়ে নাও তারমধ্যে ভিসা টিকিট এগুলো করাও।
ওদের গাড়ি এগিয়ে গেলে যতদূর দেখা যায় সুচরিতা দেখতে লাগল, তারপর রাহুল ওকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে এসে চোখের জল মুছিয়ে দিল। সেদিন রাতে ওরা তিনজন অনেকক্ষণ অবধি গল্প করল, আড্ডা দিল। পরেরদিন সকালে সজলও চলে গেল, সজলও যাবার সময় বলে গেল,
-তোরা একবার ঘুরে যা এবার
রাহুল বলল,
-হ্যাঁ রে যাব, তবে এই রাঙামাটির দেশ ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারব না জানিস! হয় এখানে, নয় কবির দেশে শান্তিনিকেতন এই অবধি দূর। বিদেশে ছিলাম তো অনেকদিন তারপর মাটির টানকে অস্বীকার করতে পারলাম না, ফিরে এলাম রে, কাজ শেষ হয়ে গেল, ওখানে দুবছর শিক্ষাকতাও করেছি, তারপর আবার চলে এলাম চিরপরিচিত বিশ্বভারতীর দুয়ারে সেখানেই পেয়ে গেলাম এনাকে, ওকে প্রথম ওখানে দেখে আমার মনে হয়েছিল ভগবান বোধহয় আমার জন্য ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
 
সজল এল কলকাতায়। আগেরদিন সজলের দাদা-বউদি ওদের ফ্ল্যাটে এসে সব পরিষ্কার করে রান্নার ব্যবস্থা করে রেখেছিল, সকালে ওর মাকে নিয়ে দাদা আসতে গেলে ছোটখাটো ঝামেলা হল। মাকে বাবা বলল, যাবে তো চিরকালের মতন যাও, মাকে জীবনে প্রথম বাবার কথার উত্তর দিতে দেখল সজলের দাদা সুপ্রকাশ, মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন,
-আমিও আসতে চাই না, এটা কি বাড়ি ছিল? বাড়ির নামে জেলখানা ছিল, হাতে-পায়ে আমার শেকলের দাগগুলো খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে, এবার আমি নিজে হাতে সব শেকল খুলে দিয়ে যাচ্ছি।
এইকথা বলে, সুপ্রভাদেবী হাতের গোছাভরা চুড়ি, লোহাবাঁধানো স্বামীর টেবিলে রেখে লোহাবাঁধানো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শাঁখা-পলা সব সানবাঁধানো উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ভেঙে খানখান হয়ে গেল শাঁখাজোরা। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘসে ঘসে সিঁদুর মুছে ছেলেকে বললেন,
-চল আমাকে নিয়ে
পা-টা সবে বাড়াতে যাবেন, গুরুগম্ভীর স্বরে সজলের বাবা বললেন,
-আমি বেঁচে থাকতেই বিধবার সাজে সাজলে, এই তোমার জন্যই জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করলাম।
-কে কার জন্য জীবন নষ্ট করেছে তা ঈশ্বরই জানেন, যাক আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, জীবনে কটা কথা যে বলেছি তা বোধহয় হাতে গোণা যায়।
সুপ্রভাদেবী সুপ্রকাশের হাত ধরে রাস্তায় নামলেন, খোলা আকাশের নীচে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। সুপ্রকাশ ভাবছিল মা ভেতরে এত দুঃখ পুষে রেখেছিল, আজ যেন তা আগুন হয়ে বেরিয়ে গেল। সুপ্রকাশ খুব যত্ন করে মাকে নিয়ে চলল নিজের ফ্ল্যাটে। চেয়ে দেখল মায়ের চোখদুটো খটখটে শুকনো কোন জলের চিহ্নমাত্র নেই।
একটু পরেই বলে উঠলেন,
-উফফ কী মুক্ত বাতাস, বন্দিদশা ঘুচল আমার। প্রায় দশবছর পর ছেলেটাকে দেখব। তোরা জানিস না দিনের পর দিন রাতের পর রাত ওই লোকটার কত অত্যাচার সহ্য করেছি আমি
-আমাদের বলোনি কেন মা? আমরা তো বড় হয়েছি
-যতই বড় হোস, মায়ের কাছে ছেলেরা ছেলেই থাকে, বলা যায় না রে।
-বললে আমি তোমাকে অনেক আগেই এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতাম
-তোমাদের পড়াশোনা শেষ হয়ে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় ছিলাম, মনে মনে এও ঠিক করেছিলাম যদি তোমরাও তোমাদের বাবার ধারা পাও, তবে আমার বাবার গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব।
-না না আমি আর সজল দুজনেই ঠিক করেছিলাম বড় ফ্ল্যাট কিনে আমিও ইনভেস্ট করব আর মাকেও নিয়ে আসব। ওইভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না কি? তোমার হাত-পায়ের শেকল সব খুলে দিয়েছি, তুমি বাতাসে নীল আকাশের তলায় মুক্ত নিশ্বাস নিয়ে বাঁচো, কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।
একটু পরেই সজল ঢুকল, সজল ঢুকেই অশ্রুমতী মাকে প্রথমে জড়িয়ে ধরে কাঁদল,
-দশবছর মা দশবছর পরে তোমাকে দেখলাম।
তারপর দুটো কচি কচি গলা কানে এল,
-তাতাই ও তাতাই তোমলা কানছ কেন?
সজল মাকে ছেড়ে এসে দুই যমজ ভাইপো-ভাইঝিকে দু কোলে তুলে নিল। তারপর রান্নাঘরের সামনে এসে ওদের নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-মাকে বল তো তাতাইকে চা দাও!
সুপ্রকাশের বিয়ের পরপরই সজল চলে গিয়েছিল। প্রায় ছবছর পরে বউদির জমজ ছেলেমেয়ে হয়। তাই ওরা তাতাইকে শুধু ছবিতে দেখেই চিনেছে। একটা পারিবারিক আনন্দময় পরিবেশে বাড়িটা রমরম করে উঠল।
 
ক্রমশ

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)