বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
সুস্মিত
হালদার
বালাই
ষাট
"এই যে দেখুন না স্যার, দু’ গালে কালো কালো দাগ। বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে। একটা কিছু লিখে দিন না। আমি বামুনের মেয়ে। তাতেও কী সমস্যা? জানি না আমার কপালে কী আছে?"
সকালের সাফারি থেকে হোটেল ফিরে এসে সঞ্জয় দেখল যে রুমটা পরিষ্কার করা হয়নি। ঘর থেকে সকালে বেরোবার আগে অথচ সে ‘প্লিজ ক্লিন মাই রুম’ ট্যাগটা দরজার বাইরে টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে বাইরের করিডরে কয়েকজন মেয়েমানুষের গলা শুনে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি আবার দরজাটা খুলল। যা ভাবা তাই। হাউসকিপিং-এর মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অদূরে দু-তিনটে ঘর পরেই পরিষ্কার করার হাউসকিপিং ট্রলিটাও আছে। চপ্পল পরে করিডরে বেরিয়ে আস্তে সঞ্জয়ের সঙ্গে একজন অল্প বয়েসের কর্মচারী-মহিলার দেখা হয়ে গেল।
গৌহাটি থেকে
কাজিরাঙ্গা গাড়িতে আসতে আসতে অসমীয়া ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে সঞ্জয় এটা বুঝে
গেছিল যে কথ্য ভাষাটা দুইয়ের মধ্যে বেশ মিল। বোঝাতে বা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই
সরাসরি বাংলায় প্রশ্ন করল সঞ্জয়,
-দিদি, ঘরটা এখনও ক্লিন হল
না। বাইরে ট্যাগ লাগিয়ে গিয়েছিলাম।
-এই তো স্যার আমরা করছি। পর পর ঘর ক্লিন করে আসছি। স্যার, একটু অপেক্ষা করুন। করে দিচ্ছি।
-আসলে একটু যদি আগে করে দেন, তবে পরিষ্কার বাথরুমটা আমার স্ত্রী ইউজ করতে পারে। উনি স্নানে যেতে চান।
-আচ্ছা স্যার, দিচ্ছি করে।
সঞ্জয় খুশি হল। মহিলা তার
সাঙ্গপাঙ্গ আরও কয়েক মহিলাকে নিয়ে সঞ্জয়ের ঘরে ঢুকল। অদিতি চুপ করে বিছানায় বসে মোবাইল ঘাঁটছিল। মহিলার ইশারাতে
চেয়ারে গিয়ে বসল। বেডটাকে ঠিক করবে। সঞ্জয় বাইরের বারন্দায় একবার আর ঘরে একবার
পায়চারি করছে আর ঠিকমতো কাজ হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখছে। একসঙ্গে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে
গেল। কেউ বাথরুম পরিষ্কার করছে তো কেউ বিছানা ক্লিন করছে তো কেউ ফ্লোর পরিষ্কার
করছে। সবাই দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে। সঞ্জয় কাজ দেখে খুব খুশি হল।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ
করা, তাদের কথা জানতে চাওয়া
সঞ্জয়ের একটা নেশা। ভৃত্য-মনিব সম্পর্কটা ঘুছিয়ে ফেলতে চায় সঞ্জয়। আপন করে নিতে
চায় মানুষকে। সঞ্জয়ের বিশ্বাস, এই দেওয়ালটা না ভাঙতে
পারলে সমাজ-দর্পণে কোনও ছবি ভেসে ওঠে না। তাই সে বয়সে ছোট হলেও দিদি বলে ডাকতে কুন্ঠা
বোধ করে না। যাকে সে দিদি বলে সম্বোধন করে সে খুশি হয় সম্মান জানানোর জন্য। অতি
দ্রুত সে আপন হয়ে ওঠে। সঞ্জয়ের আসনটা আরও উঁচুতে ওঠে। সঞ্জয় কাজের ফাঁকেফাঁকে
প্রশ্ন করে প্রথম যে মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়েছিল,
-আচ্ছা দিদি, এই রিসর্টটা কবে চালু
হয়েছে?
-আট বছর হল।
-এর মালিক শুনেছি নিরঞ্জন শইকিয়া। আপনি জানেন?
-হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন।
-জানেন দিদি, ওনার এক ভাই ডাক্তার।
আমাদেরই ব্রাঞ্চের, মানে স্কিন
স্পেশালিষ্ট।
-আচ্ছা, আপনি তাহলে একজন
ডক্টর?
-হ্যাঁ।
-আপনি আগে বলেননি কেন স্যার? বলবেন তো।
-ধুর, নিজের ঢোল কি কেউ
নিজে বাজায়?
-এটা কী কথা বললেন স্যার? বেশ তো, আমাদের দিয়ে আগে কাজটা করিয়ে
নিচ্ছেন স্যার, আমাদের জন্য কিছু করবেন না?
এই বোধহয় দূরত্বের
বাঁধটা ভাঙল। সীতার কথার মধ্যে এক আবদারের সুর। অদিতি চুপ করে সব লক্ষ্য করছিল। মোবাইল ছেড়ে একবার মুখ তুলে তাকাল। সঞ্জয় বলল,
-কী করতে হবে?
-এই যে দেখুন না স্যার,
দু’
গালে কালো কালো দাগ। বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে। একটা কিছু লিখে দিন না। আমি
বামুনের মেয়ে। তাতেও কী সমস্যা? জানি না আমার কপালে কী আছে?
-হুম। তোমার বয়স কত?
-এই সবে চব্বিশে পা দিয়েছি স্যার।
সঞ্জয় একটা কাগজ আর পেন আনতে
বলল। বিদ্যুৎ গতিতে কাগজ আর পেন চলে এল। প্রেসক্রিপশনটা করতে করতে সঞ্জয় বলে চলল
কোন ওষুধটা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। তারপর সীতাকে বলল,
-প্রেসক্রিপশন তো করে দিলাম। তিন মাস পরে আমাকে দেখাতে হবে।
আমি তো আর এখানে আসব না, তোমাকে কলকাতায় গিয়ে
দেখাতে হবে আমাকে।
-যাব স্যার। ঠিক যাব। সঙ্গে একটা গন্ডার নিয়ে যাব এখান থেকে।
সবাই হাসতে লাগল। আদিতিও
হাসছে। কথাটা শুনে সঞ্জয় হাসতে পারল না। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। মনে মনে সে বলল, বালাই ষাট।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment