বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
শিবরাম দে
রাত
জাগা মন
"এই মুহূর্তে বিতানকে বড় কাছে পেতে ইচ্ছে করছে বৈশাখীর। একটা অপরিচিত ব্যথার আস্বাদ ওর সমগ্র নারী সত্ত্বাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাইশটা বসন্ত পেরিয়ে আসা বৈশাখী চ্যাটার্জীর কাছে এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন। এ এমনই অনুভূতি যা কাউকে বলা যাবে না।"
ঘরময় ফিকে অন্ধকারের সমুদ্র। অতিপরিচিত জারুল গাছটার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে দূরের একফালি আকাশ। আশ্বিনের ধোঁয়া মোছা আকাশের আঙিনায় হাজারো সোনালি তারার ভিড়। পুবের জানালা দিয়ে চতুর্থীর চাঁদ উঁকি মারে। কুচি কুচি চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে ঢুকে নিভৃতে বৈশাখীকে জড়িয়ে ধরে। প্রেমিকের মতো আদর করতে চায়। ফুলদানির বাসি রজনিগন্ধার মৃদু সৌরভ মাঝেমধ্যে নাকে স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। তবু ঘুম আসে না বৈশাখীর। ওর পাশে সোমা, অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সোমা যেন কী! শুতে যতক্ষণ!
আজকাল বিতানকে এমন করে মনে
পড়ে কেন? কেন বিতান বৈশাখীর নরম বুকে
ঢেউ জাগায়? ফুল ফোটায়? কটা দিনই বা ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে! তবু ও যেন বৈশাখীর
অনেক কাছের। একান্ত নিজের। বিতান তো জানে না বৈশাখী রাতের বেলায় শুয়ে শুয়ে তারা
গোণে। ওর কথা ভাবে, এত ভাবে যে রাতে ঘুম আসে না। আচ্ছা বিতানও কি রাতের নির্জন
অবকাশে ওর কথা ভাবে? নিশ্চয়ই ভাবে।
বৈশাখী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, বিতান খাটে শুয়ে, বুকের ওপর খোলা বই। কিন্তু মনটা কোথায়? হয়তো বৈশাখীর কাছেই। বিতানকে অমন নিঃসঙ্গ দেখায় কেন? কেন অমন ক্লান্ত মনে হয়? বিতান কি কাউকে ভালবেসেছিল? কথাটা আগে কেন মনে
পড়েনি বৈশাখীর? তবে কেন এত চুপচাপ ও? সবসময় কী যেন ভাবছে! কী নিয়ে
এত ভাবনা কে জানে?
এখনও স্পষ্ট মনে আছে বৈশাখীর।
সেদিনটা ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নালোকিত চরাচর। মাধুরীদের বাড়ির
ছাদের ধার ঘেঁষে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বিতান। এক মনে মাধুরীদের
হলুদফুলে ভরা অমলতাস গাছটার দিকে তাকিয়ে। জগৎসংসার ভুলে যেন কোনও গভীর চিন্তায়
মগ্ন। সেদিনই মনে মনে ওর নাম দিয়েছিল জ্যোৎস্নাময়।
শান্ত নির্লিপ্ত মানুষও কখনও
কাউকে কাউকে আকর্ষণ করে ফেলে। বিতানকে দেখার আগে কখনও বোঝেনি সে।
মাধুরী, বৈশাখীর প্রাণের বন্ধু। জানতে অসুবিধা হল না। বিতান মাধুরীর পিসির
ছেলে। বৈশাখী, মাধুরী, বিতানের একই ইউনিভার্সিটি। কথায় কথায় বৈশাখী একদিন বলেছিল, "উনি কি সবসময় ভাবজগতেই থাকেন?" উত্তরে মাধুরী বলেছিল, "ছোড়দাকে আজও চিনতে পারলাম না। ওর তো অসমের বরাক
উপত্যকায় বেড়ে ওঠা। ওর হয়তো প্রমিত বাংলায় একটু অসুবিধা হয়। তাই চুপচাপ থাকে।” এই কথা
বৈশাখীর মন মেনে নিতে পারেনি। সত্যি মানুষের মন কাচের মতো
স্বচ্ছ নয়, সমুদ্রের মতো অতল
গভীর। মানুষের বাইরের রূপ আর অন্তরের রূপের ব্যবধান যে অনেক।
বিতানকে অনেক সময় সে আঘাত
দিয়ে কথা বলেও দেখেছে। কিন্তু বিতান ভাবলেশহীন। যেন কিছুই হয়নি। তবে বাদলকে সে
একদম সহ্য করতে পারে না। অথচ বাদল ছেলেটা কিন্তু খারাপ নয়। তবে হ্যাঁ সবসময় কেমন
যেন ইনট্যালেকচুয়াল ইনট্যালেকচুয়াল ভাব। বাদল সেদিন বলছিল, বৈশাখীর কথা নাকি সবসময় মনে পড়ে ওর। কথাটা শুনে ভীষণ হাসি
পেয়েছিল বৈশাখীর। কী কষ্ট করেই যে হাসি চেপেছিল। বাদল ওর নাম দিয়েছিল বেলফুল।
কারণ বৈশাখীর শরীর থেকে সবসময় নাকি বেলফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। বিতানকে কথাটা
বলেছিল বৈশাখী। শুনে দারুণ গম্ভীর হয়ে যায়। বৈশাখী লক্ষ্য করেছে, বাদলের সঙ্গে কথা বললেই, বিতানের মুখে অমাবস্যার আঁধার নামে।
বিতানের সঙ্গে অনেকদিন দেখা
হয়নি বৈশাখীর। কবে যে পুজোর ছুটিটা শেষ হবে। বিতান বসুন্ধরাকে চিঠি লিখেছে। বলেছে আরও লিখবে। কিন্তু বৈশাখীকে একটাও লিখবে না। বৈশাখী বুঝতে পারে বিতান অভিমান
করেছে। এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কেন মনে করে বিতানের ঠিকানাটা নেয়নি! বৈশাখী
চায়নি তাই? না চাইলে কি কিছু
দিতে নেই? বিতান ওর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। বৈশাখী কী এমন অপরাধ করেছে যে এত
শাস্তি দিচ্ছে ওকে। মাধুরী সেদিন অবশ্য বলেছিল, যে বসুন্ধরাকেও নিজের ঠিকানা দেয়নি।
মাথায় বেলফুলের মালা পরে
বাদলের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়াটাই তার কাল হল! পয়লা বৈশাখের দিনে লালপাড়ের সাদা
শাড়ি, লাল ব্লাউজ, মাথার খোপায় বেলফুলের মালা দিয়ে নিজেকে একটু আকর্ষণীয়
করে তুলতে কোন মেয়েই না চায়? ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে
জানতে পারল, বিতান তখনও আসেনি। বৈশাখীর
ইচ্ছা ছিল আজ ঋষিবরের ধ্যান ভঙ্গ করবে। কিন্তু এমনই কপাল! মেনকা হওয়া তো হলই না
সকল নষ্টের মূল ওই বাদল এসে জোর করে ওকে নিয়ে ঘুরতে চলে গেল।
খবরটা বিতানের কানে যাওয়ার
পর থেকে কখনই বৈশাখীর সামনে আসেনি ও। আচ্ছা হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা আর কি কখনও ফিরে আসে? বিতানকে আর কোনদিন ফিরে পাবে সে? তবে কি ভুলে যেতে হবে বিতানকে! বৈশাখী পারবে, পারবে ভুলে যেতে বিতানকে? বোধ হয় পারবে। মেয়েরা স্বামীর সোহাগ,
আর
ঐশ্বর্য দিয়ে অতীতকে সুনিপুণ ভাবে মুছে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়।
কিন্তু বিতান? সেও কি বৈশাখীকে ভুলে যাবে? না-না-না। ওর মনের আঙিনায় জোনাকির আলোর মতো জ্বলজ্বল করবে বৈশাখীর নিষ্পাপ
মুখটা!
এই মুহূর্তে বিতানকে বড় কাছে
পেতে ইচ্ছে করছে বৈশাখীর। একটা অপরিচিত ব্যথার আস্বাদ ওর সমগ্র নারী সত্ত্বাকে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাইশটা বসন্ত পেরিয়ে আসা বৈশাখী চ্যাটার্জীর কাছে এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন। এ এমনই অনুভূতি যা কাউকে বলা যাবে না। একান্ত ভাবে নিজের।
বৈশাখীর দীঘল কালো চোখ দুটো ভিজে উঠল। দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল বালিশের ওপর।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment