বাতায়ন/শারদ/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ধারাবাহিক গল্প
তুহিনা
সুলতানা
হারিয়ে
গেল
[১ম পর্ব]
"সে নিজে ভাবত, একদিন হয়তো সে শিক্ষক হবে, বা হয়তো ডাক্তার। রঙিন বইয়ের ছবিগুলো দেখে মনে মনে কল্পনা করত শহরের আলো ঝলমলে জীবন। কিন্তু সেই আলো তাদের গাঁয়ে পৌঁছাত না। তাদের ঘরে রাতের বেলা কুপির আলোয় পড়াশোনা চলত।"
সকালের হাওয়ায় কাশবন দুলছে। নদীর ধারে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির ঝরে পড়ছে মাটিতে। গাঁয়ের মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছে চোদ্দো বছরের সান্ত্বনা। কাঁধে স্কুলের ছেঁড়া ব্যাগ, হাতে খাতা-কাগজ। তার হাঁটায় এক অদ্ভুত ছন্দ—কখনো দৌড়ে যাচ্ছে, আবার কখনো থেমে ঘাসের ডগায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছে।
সান্ত্বনা গরিব ঘরের মেয়ে।
বাবা নিত্যানন্দ পেশায় ঢাকি। সারাবছর গ্রামে দিনমজুরির কাজ করে কোনও মতে সংসার
চালান। পুজোর সময় শহরে গিয়ে ঢাক বাজানোই তার বড় আয়। মা
বাসন্তী গৃহিণী, সংসারের যাবতীয়
টানাপোড়েন সামলান তিনি।
গ্রামের কুঁড়েঘরে সান্ত্বনার
ছোট্ট শৈশব কেটেছে মাটির গন্ধে ভিজে। গরিব হলেও তার চোখে ছিল অগণিত স্বপ্ন।
স্কুলের শিক্ষিকা প্রায়ই বলতেন,
-সান্ত্বনা, তুমি বড় হয়ে অনেক দূর
যাবে।
সে নিজে ভাবত, একদিন হয়তো
সে শিক্ষক হবে, বা হয়তো ডাক্তার।
রঙিন বইয়ের ছবিগুলো দেখে মনে মনে কল্পনা করত শহরের আলো ঝলমলে জীবন। কিন্তু সেই আলো
তাদের গাঁয়ে পৌঁছাত না। তাদের ঘরে রাতের বেলা কুপির আলোয় পড়াশোনা চলত। ঝড় এলে
টিনের চাল ফুটো দিয়ে পানি পড়ত বিছানায়। তবু হাসিমুখে সব সহ্য করত সান্ত্বনা, কারণ তার কাছে বাবার ঢাকই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সুর।
শরৎ এলেই নিত্যানন্দ ব্যস্ত
হয়ে পড়তেন। ঢাকের চামড়া টেনে বাঁধা, কাঠের কাঠামো মেরামত
করা—সবকিছুতে সান্ত্বনা পাশে দাঁড়াত। কাঁসর হাতে নিয়ে বাবার সঙ্গে তাল মেলাত সে। বাবা
মুচকি হেসে বলতেন,
-আমার মেয়ে একদিন ঢাকের সুরেই নাম করবে।
সান্ত্বনা হেসে উত্তর দিত,
-না বাবা, আমি ঢাক বাজাব না, আমি পড়াশোনা করে বড় মানুষ হব।
তবু পুজোর কদিন
বাবার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁসর বাজানো তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ হয়ে উঠেছিল।
সেই বছর দুর্গাপুজোয়
নিত্যানন্দ সান্ত্বনাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। গ্রাম থেকে ভোরবেলায় বাস ধরে তারা
পৌঁছাল শহরের বিশাল কোলাহলে। সান্ত্বনার চোখ বিস্ময়ে ভরে গেল। চারিদিকে আলো, রঙিন পোস্টার, উঁচু উঁচু বিল্ডিং,
আর
রাস্তায় ভিড়। সে জীবনে এত গাড়ি একসঙ্গে দেখেনি। প্যান্ডেলে বাজানোর সময় তার চোখ
ছুটে যেত চারদিকে, দামী পোশাকে ঘুরে বেড়ানো মেয়েদের দিকে, হাতে ক্যামেরা ধরা ছেলেদের দিকে। তার মনে হত, যদি একদিন
আমিও এদের মতো সাজতে পারতাম, স্কুল শেষ করে কলেজে
পড়তে পারতাম… কিন্তু সেই স্বপ্নের মাঝেই লুকিয়ে ছিল বিভীষিকার অন্ধকার। ভিড়ের
মধ্যে কিছু দামী পোশাক পরা যুবকের চোখ পড়ে তার ওপর।
তারা ঠোঁটে হাসি খেলায়, চোখে লালসা। সান্ত্বনা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। সেই রাতেই
সে নিখোঁজ হয়ে যায়।
নিত্যানন্দ ভিড় সামলাতে
সামলাতে খেয়ালই করেননি কখন মেয়েটি হারিয়ে গেল।
শহরের প্যান্ডেলে সেদিন ছিল
অষ্টমীর রাত। ঢাকের শব্দে চারদিক গমগম করছিল। ভিড়ের চাপে এক পা এগোনোও যেন কঠিন।
মণ্ডপের ভেতরে দেবীর মুখে আলো পড়ছে, রঙিন ফ্লাডলাইটে ঝলমল
করছে চারপাশ। নিত্যানন্দ ঢাক বেঁধে বসেছেন। ঘামে ভিজে গেছে তার শরীর। ঢাকের
প্রতিটি ঘায়ে যেন উজাড় করে দিচ্ছেন নিজের প্রাণশক্তি। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁসর
বাজাচ্ছিল সান্ত্বনা। তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল ঝলমলে আলোয় ঘেরা দর্শকদের দিকে। একসময়
ভিড় ঠেলে কয়েকজন যুবক এগিয়ে এল। দামি জিন্স-টি শার্ট, গলায় ঝকঝকে চেন,
হাতে
মোবাইল। তারা চোখ টিপে হাসল সান্ত্বনার দিকে। মেয়েটি প্রথমে বুঝতে পারেনি, একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাবার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু
যুবকদের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হল।
ঢাকের তালে তালে রাত এগিয়ে
যাচ্ছিল। ভিড়ের চাপে একসময় সান্ত্বনা বাবার থেকে খানিকটা দূরে সরে গেল।
নিত্যানন্দের চোখ তখন ঢাকেই মগ্ন— কে জানত,
সেটাই
হবে মেয়েকে শেষ দেখা? একসময়ে হঠাৎ করেই সান্ত্বনাকে আর
দেখা গেল না। প্রথমে ভেবেছিলেন,
হয়তো
ভিড়ের মধ্যে সরে গেছে। কিন্তু ঘন্টা পেরোল,
দু’ঘন্টা
গেলো, মেয়ে আর ফিরল না। ঢাক থামিয়ে তিনি চারদিকে ছুটলেন।
-সান্ত্বনা! ওরে সান্ত্বনা!
তার গলা ভেসে গেল আলো-আঁধারি
রাস্তায়। কেউ ফিরিয়ে দিল না। একজন দোকানদার বলল,
-ওসব ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না। পুলিশে যান।
কেউ কেউ মুখ টিপে হাসল,
-ঢাকির মেয়ে আবার ভিড় সামলাতে জানে নাকি?
সেই হাসির শব্দ নিত্যানন্দের
বুকে ছুরি হয়ে বিঁধল। রাত তখন গভীর। নিত্যানন্দ থানায় গিয়ে রিপোর্ট লেখালেন—
আমার মেয়ে নিখোঁজ।
কিন্তু ডিউটিরত অফিসার বিরক্ত
মুখে বলল,
-কিশোরীরা তো মাঝেমধ্যেই পালায়। প্রেমে পড়েছে বুঝি?
বুকের ভেতর হাহাকার নিয়ে তিনি
বারবার বললেন,
-আমার সান্ত্বনা পালাবে কেন? ও তো আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না…
কিন্তু কে শোনে কার কথা? পুলিশের চোখে সে কেবলই একজন গরিব ঢাকি, যার মেয়ের হারিয়ে যাওয়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়।
রাতভর তিনি ঘুরলেন রাস্তায়
রাস্তায়। মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে গিয়ে খুঁজলেন। পোস্টার আঁকানোর মতো টাকা তার নেই, লোক ভাড়া করে খোঁজার মতো সামর্থ্যও নেই। শুধু নিজের জোড়ালো
গলা আর ভেঙে পড়া চোখ নিয়ে খুঁজে ফিরলেন সান্ত্বনাকে।
ভোর হল। রাস্তায় আবার ভিড়
জমতে শুরু করল। ঢাকের শব্দে নতুন দিনের পুজো শুরু হল। কিন্তু নিত্যানন্দের কাছে
সবকিছু নিস্তব্ধ। কারণ তার পৃথিবী থেকে সরে গেছে সান্ত্বনা। ভোরের কুয়াশা তখনও নামেনি। চারদিক ফ্যাকাশে আলোয় মোড়া। কলকাতার এক প্রান্তে, ফাঁকা জলার ধারে হঠাৎ কিছু কাক অস্থির হয়ে উড়তে শুরু করল।
হাটতে যাওয়া দু’জন মানুষ থমকে দাঁড়ালেন। বাতাসে যেন এক অদ্ভুত গন্ধ—সড়গন্ধ।
-ওরে বাবা… এ তো মানুষের গন্ধ!
কেউ চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণের
মধ্যে থানার লোক এল। জলার ধারে শুকনো কচুরিপানার ভেতর থেকে বের করা হল এক অচেনা
কিশোরীর দেহ। শরীরের ওপরে ছেঁড়া জামাকাপড়,
হাতে
আঙুলের আঁচড়, চোখ আধখোলা। মৃত্যুর
আগে ভীষণ লড়াই করেছিল সে, শরীরের প্রতিটি ক্ষত যেন তার সাক্ষী। কেউ পুলিশকে ফিশফিশ করে বলল,
-ঢাকির মেয়েটাই হবে বুঝি? গতরাতে হারিয়েছিল শুনেছিলাম…
খবর যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে
গেল। নিত্যানন্দ তখনও থানার সামনে বসে ছিলেন, চোখে ঘুম নেই, কপালে ঘাম জমে শুকিয়ে
গেছে। পুলিশ এসে বলল,
-আপনার মেয়েকে পেয়েছি।
তিনি দৌড়ে গেলেন। এক ঝলক চোখ
পড়তেই বুক ভেঙে গেল।
-না রে… এ আমার মেয়ে না… এভাবে পড়ে থাকতে পারে না… ওঠ রে
সান্ত্বনা, ওঠ!
কিন্তু মেয়েটির ঠোঁট নিথর, চোখের কোণে শুকনো অশ্রুর দাগ। সেই দৃশ্য দেখে নিত্যানন্দ
মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পুলিশ ফাইল লেখার মতো গলায় বলল,
-ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। তদন্ত হবে।
কিন্তু তদন্ত মানে কী, তা তিনি বুঝলেন না। শুধু বুঝলেন—যে মেয়েটির স্বপ্ন ছিল, যে হাসতে হাসতে বাবার সঙ্গে কাঁসর বাজাত, সে আর নেই। খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। বাসন্তীর বুকফাটা কান্না
নদীর স্রোতের মতো বইতে লাগল। গ্রামের মানুষজন জড়ো হল, কেউ মাথা নাড়ল,
-শহরটা মেয়েদের জন্য কবরস্থানের মতো হয়ে গেছে।
কেউ বলল,
-গরিবের মেয়ের দেহের দাম নেই, দুইদিন খবর হবে তারপর সব চাপা পড়ে যাবে।
সত্যিই তাই হল। একটা ক্ষুদ্র
কলামে খবর ছাপল পত্রিকা—*ঢাকির মেয়ে ধর্ষিতা
অবস্থায় উদ্ধার।*
এরপর শহরের আলো, প্যান্ডেলের ভিড়,
দামি
গয়না, রঙিন আলো—সব ঢেকে দিল এই
মৃত্যুকে। কিন্তু যাকে হারাল, তার শূন্যতা ভরল না। বাসন্তী
ছেঁড়া শাড়ির আঁচল কামড়ে দিনরাত কাঁদতে লাগল। নিত্যানন্দ কথা বলতে ভুলে গেলেন। হাতে
ঢাক ধরলেই যেন শিরায় শিরায় আগুন লাগে—কারণ সেই সুর তাকে মনে করিয়ে দেয়
সান্ত্বনাকে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment