বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
সীমা ব্যানার্জি-রায়
শরৎ
আসে
"টেলির্যাড রেডিয়ো খোলা থাকত। ছাদের উপর টাঙানো থাকত তারের জালের লম্বা ফিতে। এরিয়াল বলা হত তাকে। ভোরবেলা বাবা রেডিয়োর ভলিউম ফুল করে দিতেন। সবাই দুড়দাড় করে উঠে পড়তাম। উঠে মুখ ধুয়ে কাচা জামাকাপড় পড়ে রেডিয়োর সামনে বসে পড়তাম।"
শরৎকাল মানেই নীল আকাশে পেঁজা তুলোর ফেনা। শরৎকালের আকাশকে শান্ত ও মেঘহীন হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যা রামের শোকের এক স্পষ্ট পটভূমি প্রদান করে। শরৎকালে পরিষ্কার আকাশ, মেঘের অনুপস্থিতি এবং একজন তপস্বীর হৃদয়ের মতো পবিত্রতার প্রতিনিধিত্ব করে। কাশ ফুলের মাথা নেড়ে নেড়ে দোল খাওয়া, শিউলি ফুলের বিছানা, মিষ্টি মিষ্টি ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস, শরতের শিশির। শরৎকালে প্রকতি যখন সম্পূর্ণ নতুনরূপে সাজতে শুরু করে ঠিক তখনই শিশিরের আগমন ঘটে। তেমনই আমাদের কিছু বন্ধু থাকে যাদের খারাপ সময়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। তাই এই প্রতীকী হিসেবে সুবিধাবাদী বা সুসময়ের বন্ধু বোঝাতে শরতের শিশির শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
আমাদের সময় রেডিয়োতে মহালয়া মানেই পুজো শুরু হয়ে যেত। শরতের পুজো মানেই
দুর্গা পুজো, মানেই ‘পূজার সাজ’ কবিতা। আমাদের পুজোর সাজ তো কারখানার বোনাস নির্ভর।
ছোটবেলার কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শিশু' তার থেকে দাদা-দিদির মুখে 'পূজার সাজ'। কবিতার মানে বলে
দিতেন ওনারা। এই ছিল আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা। বাড়িতে হই হই রইরই সব ঝাড়পোঁছ শুরু হয়ে
গেছে। পিসিমারা সব আসা শুরু করে দিয়েছে। নাড়কেল নাড়ু, জিভে গজা, চানাচুর সব তৈরি জোরকদমে
শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা ছোটরা দুপদাপ ঝুপঝাপ করে ওপর নীচ করছি। মাঝে মাঝে মা-পিসিমাদের রাগের গলা শোনা যাচ্ছে,
-বলছি বাইরে
গিয়ে খেল। না শুনলে এইবার এমন মারব বুঝবি তখন।
হি হি করে হেসে সব পালাতাম।
-সেথা মেলা লোক জড়ো,
রায়বাবু
ব্যস্ত বড়, দালান সাজাতে গেছে রাত।
বুঝতাম 'রায় বাবু' বেশ বিত্তশালী মানুষ।
মনে প্রশ্ন জাগে, রায় বাবু রাত জেগে
কেন দালান সাজান! ডাকি সাজ পরাতে আসত চতুর্থীর দিন রাতে। আমাদের তো রাত ন’টা-দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হত। মাথায় চিন্তা অসুরের
চুলগুলো ঝাঁকড়া করবে তো! গোঁফটা তাগড়া! রাতে দিদিকে জিজ্ঞেস করতাম,
-দিদি, মধুর গুপীর কাছ থেকে সার্টিনের জামা নিতে লজ্জা করল না!
আবার প্রশ্ন করতাম,
-আমি মধু না বিধু?
দিদি আদর করে বলতেন,
-তোমরা সবাই বিধু।
বুঝতাম, বড়রা কত কষ্ট করে পুজোর পোশাক "সাধ্যমত এনেছেন
কিনে"। সেসব পরে কী আনন্দ! প্রতিবেশীদের আবার সব পুজোর জামাকাপড় দেখানো হত।
মহালয়া। রেডিয়োর অনুষ্ঠান। আমাদের
একটা ব্রাউন কালারের টিভি ছিল। তার সামনের দিকটা হলুদ রংয়ের
ছিল। টেলির্যাড রেডিয়ো খোলা থাকত। ছাদের উপর টাঙানো থাকত
তারের জালের লম্বা ফিতে। এরিয়াল বলা হত তাকে। ভোরবেলা বাবা রেডিয়োর ভলিউম ফুল করে দিতেন। সবাই দুড়দাড় করে উঠে পড়তাম। উঠে মুখ ধুয়ে কাচা
জামাকাপড় পড়ে রেডিয়োর সামনে বসে পড়তাম। মহালয়ার আরও একটা পোশাকি নাম আছে 'মহিষাসুরমর্দিনী'। পুজো উপলক্ষে
আকাশবাণী কলকাতার এক মহান অনুষ্ঠান।
রেডিয়োর লাল রংয়ের কাঁটাকে মিডিয়াম ওয়েভের কলকাতা 'ক' সেট করে রাখা থাকত আগের দিন
রাতে। ভোরবেলায় শুধু নভটা অন করে দিলেই হয়ে যেত। অপেক্ষা সেই সন্ধিক্ষণের। ভোর হয়ে
আসছে... বাইরে আকাশের কমলা রং ধরেছে। বাবা বৌদিদের বলতেন,
-চা বানাও নয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়বে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই সুর... ‘বাজল... বাজল তোমার আলোর বেণু…’ মাকে ডাকা, ‘জাগো... জাগো মা…’
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment