বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
অর্পিতা
চক্রবর্তী
অকাল
বোধন
"আমাদের যে বড় অভাব। আমার জামা চাই না। আমাকে একটা কাজ দেবে। আমি কাজ করে সংসারে দুটো টাকা দিতে চাই। আর যদি কটা টাকা জমাতে পারি তবে আমার ভুতুটাকে ছাড়িয়ে আনব।"
-আমার ভুতুটাকে নিয়ে যেও না কাকা, তোমার দুটো পায়ে পড়ি, ও মরে যাবে। ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। আর আমিও ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।
-ও তাই বুঝি।
ঠিক আছে আমি ওকে ছেড়ে দেব কিন্তু তার আগে তোর বাপ যে টাকাটা ধার করেছে সেটা শোধ
করতে বল।
-দেব কাকা, ঠিক শোধ করে দেব। তুমি একটু সময় দাও।
-দিয়েছিলাম তো, পুরো ছ মাস দিয়েছিলাম কিন্তু তোর বাপ আমাকে একটা টাকাও
ফেরত দিতে পারেনি। এবার আর না, আগে টাকা ফেল তারপর
তোর ভুতুকে নিয়ে যা।
ভুতুটা কিছুতেই যাবে না। কাকা
ওকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। অবলা প্রাণী কথা বলতে পারে না। বেচারি হাম্বা
হাম্বা করছে। ওর চোখ দুটো দিয়ে শুধু জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ভুতুকে ছাড়া
গোপালটা থাকতে পারে না। ও রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে মহাজন কাকার বাড়ির গোয়াল ঘরে
গিয়ে ভুতুর গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে আসে। ভুতু অবশ্য তাতেই খুশি।
বেশ চলছিল এই লুকোচুরি খেলা।
কিন্তু সেদিন গোপালটা ধরা পড়ে গেল। বেচারির পিঠে পড়ল কিল চড় ঘুষি। মহাজন কাকা
তার রাগের বাকি অংশটুকু ভুতুর উপর মেটালেন। আজকাল আর এমুখো আসে না গোপালটা। ও জানে
ধরা পড়লে মার খেতে হবে দুটোকেই।
সামনেই দুর্গাপুজো। গ্রামের
জমিদার বাড়ি থেকে বস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। গোপাল আর ওর বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে
যদি কিছু পাওয়া যায়। জমিদার বাড়ির বড়গিন্নি-মায়ের কোন সন্তানাদি নেই। ওনার
মনটা খুব ভাল। গাঁয়ের মানুষগুলো যাতে নতুন জামাকাপড় পড়তে পারে পুজোয় একটু
আনন্দ করতে পারে তাই এই আয়োজন। লাইন ক্রমশ এগোতে লাগল। এবার গোপালের পালা। ও হঠাৎ
করেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রানিমার পা দুটো জড়িয়ে
ধরে বলল,
-উৎসব করতে মন চাইছে না গো। আমাদের যে বড় অভাব। আমার জামা
চাই না। আমাকে একটা কাজ দেবে। আমি কাজ করে সংসারে দুটো টাকা দিতে চাই। আর যদি কটা
টাকা জমাতে পারি তবে আমার ভুতুটাকে ছাড়িয়ে আনব।
এত কিছু দেখে চারিদিক থেকে
সবাই রে রে করে উঠল গোপালের উঠর। রানিমা সবাইকে শান্ত করিয়ে গোপালকে ভিতরে
নিয়ে গেল।
-তোমার নাম
বুঝি গোপাল? তা তুমি লেখাপড়া না
করে কাজ করতে চাইছ কেন? সামনেই দুর্গাপুজো, তুমি নতুন জামা পড়ে আনন্দ করতে চাও না?
-চাই গো রানিমা খুব চাই। কিন্তু আমরা যে পেট ভরে খেতে পাই না। উৎসব করব কী করে? আমার বাপটা টাকা শোধ
করতে না পারায় ওরা আমার ভুতুটাকে নিয়ে গেল। আমার ভুতুটা ভাল নেই গো রানিমা। আমাকে
একটা কাজ দাও না। যাদের পেটে ভাতের খিদে তাদের জীবনে কোন
আনন্দ নেই গো।
রানিমা গোপালের
কথা শুনে তৎক্ষণাৎ রওনা দিলেন মহাজনের বাড়িতে।
-আপনি ঠিক কত
টাকার বিনিময়ে ভুতুকে নিয়ে এসেছেন?
-আজ্ঞে ওর
বাপের কাছে আমি কড়কড়ে এক হাজার টাকা পাব। সময় দিয়েছিলাম কিন্তু শোধ করতে
পারেনি।
-আচ্ছা আমাকে
একটা কথা বলুন তো, আমি শুনেছি আপনি এই
পুজোর মধ্যে গ্ৰামে একটা জলসার আয়োজন করেছেন। কিন্তু কেন জানতে পারি কি?
-আজ্ঞে রানিমা যাতে গ্ৰামের মানুষ একটু আনন্দ করতে পারে।
-বেশ সে তো খুব
ভাল কথা। কিন্তু আজ আপনাকে একটা চরম সত্যি কথা বলি, মানুষের পেটে যদি ভাত না থাকে, তাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্রটুকু যদি না থাকে তবে আনন্দ
আসবে কোথা থেকে। আপনি যা করেছেন আমি তার বিরোধিতা করছি না। তবে আমার অনুরোধ আগে
মানুষ পেট ভরে খেতে পাক, তাদের মন ভাল থাকুক, দেখবেন আনন্দ এমনিতেই আসবে। আপনি এত টাকা খরচা করে এত বড়
জলসা করছেন অথচ এই ছেলেটাকে দেখুন, ও আমার কাছে টাকা
জামাকাপড় কিছুই চায়নি। ও চেয়েছে একটা কাজ। ও ওর সংসারটাকে ভাল রাখতে চায়, ওর ভুতুকে আপনার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু দয়া করে
নয় আপনার টাকা ফেরত দিয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখুন কিছু মনে করবেন না আমরা বয়সে
বড় আপনি মহাজন আর আমি গ্ৰামের রানিমা কিন্তু এইটুকু ছেলে আজ আমাদের শেখাল
আনন্দ করতে গেলে মনটাকে খুশি রাখতে হয়। উৎসব করে আনন্দ করা যায় না আর গেলেও সেটা
সাময়িক। তাই আমি রানিমা আজ এই ঘোষণা করছি, আমার গ্ৰামের মানুষ আমার সন্তান-সম। আমি এত
বছর পর এই গ্ৰামে ফিরে এসেছি শুধু নিজে ভাল থাকব বলে নয় সবাইকে ভাল রাখব বলে। আর
আপনি কাল সকালে গিয়ে জমিদার বাড়ি থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে আসবেন। আর এই যে আমার
গোপাল সোনা, যাও এবার তুমি তোমার
ভুতুকে বাড়ি নিয়ে যাও আর খুব আনন্দ করো। তবে তোমার কাছে আমার একটা ঋণ রইল। তুমি
কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করবে তারপর একটা ভাল চাকরি পেয়ে আমার এক হাজার টাকা শোধ
করবে। কি পারবে তো?
-পারব রানিমা খুব পারব। এই গোপাল আজ কথা দিচ্ছে। শুধু টাকাটা দিতে একটু দেরি হবে।
-বেশ তো হোক
দেরি। আমি অপেক্ষা করব। তবে তুমি ভাল থেক। সামনেই শারদোৎসব তুমি কিন্তু তোমার
ভুতুকে নিয়ে খুব আনন্দ কোরো।
গোপাল বেজায় খুশি। আজ ওর
ভুতু ফিরে এসেছে। রানিমা যেতে যেতে বলল,
-গোপাল কাল থেকে তুমি জমিদার বাড়িতে আসবে। তুমি কাল থেকে
রোজ এসে আমার পুজোর ফুল তুলে দেবে আর আমার হাতে হাতে পুজোর জোগাড় করে দেবে। কি
পারবে তো?
গোপাল একগাল হেসে বলল,
-পারব রানিমা খুব পারব।
-বেশ তবে কাল
থেকে তোমার চাকরি পাকা। অবশ্য এই কাজের জন্য তুমি একটা পারিশ্রমিক পাবে। আর সেটা
তুমি তোমার প্রয়োজন মতো খরচা করবে। ঠিক আছে আজ তাহলে চলি। আর আপনি কাল গিয়ে
টাকাটা নিয়ে আসবেন।
গোপাল ভুতুকে দাঁড় করিয়ে এক
ছুটে এসে রানিমাকে একটা প্রণাম করল।
-থাক থাক, কী করছ গোপাল?
-কিছু না রানিমা, আমি মায়ের বোধন
করছি। তবে সময়ে না অসময়ে, আর একে কী বলে জানেন?
-কী বলে গোপাল?
-একে বলে অকাল
বোধন।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment