প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

কলম | কমল নন্দী রায়

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
কমল নন্দী রায়
 
কলম

"পেনশনের বড়াই করছদু বেলা খাওয়ার খরচ জানবাড়ির কোনও কাজ তো কর না। দু বেলা খাচ্ছ আর বিকেলে যত বুড়োগুলোর সঙ্গে গুলতানি মারো। এই বয়সে অত বাইরে বেরোবার কী আছে?"


-একশো টাকা দিবি?
-কেন, কী দরকার?
-দরকার আছে।
-কী দরকার সেটাই তো জানতে চাইছি।
-হাতে একটাও পয়সা নেই, বাইরে বেরোলে টাকাপয়সা লাগে। সবাই খরচ করে, রোজ রোজ অন্যের পয়সায় চা খেতে লজ্জা করে।


-বাইরে চা খাওয়ার কী দরকার? বাড়িতে তো তিনবার চা খাও। বাইরে চা না খেলেই হয়।
-কী যে বলিস। সবাই মিলে একসঙ্গে গল্পটল্প করি, সবাই চা খায় আর আমি না খেলে বাজে দেখায়। তা ছাড়া আমি আমার টাকাই তো চাইছি।
-তোমার টাকা মানে?
-আমার পেনশনের টাকা থেকে।
-কত টাকা পেনশন পাও?
ঝাঁজিয়ে ওঠে জীবন।
-পেনশনের বড়াই করছ? দু বেলা খাওয়ার খরচ জান? বাড়ির কোনও কাজ তো কর না। দু বেলা খাচ্ছ আর বিকেলে যত বুড়োগুলোর সঙ্গে গুলতানি মারো। এই বয়সে অত বাইরে বেরোবার কী আছে?
আর কোনও কথা না বলে শেখর বারান্দায় চলে আসে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে এই বারান্দায় বেশিরভাগ সময় কাটায় শেখর। এখান থেকে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যায়। কতরকমের লোকের যাতায়াত, অটো, রিকশাতে রাস্তাটা জমজমাট। শেখর যখন ফ্ল্যাট কিনেছিল তখন এখানে এত জনবসতি ছিল না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা ছিল। দোকান বাজারও সেরকম খুব একটা ছিল না। অটোও ছিল না, বাস বা ট্যাক্সি ধরতে হলে হেঁটে কিংবা রিকশা করে মেন রোডে যেতে হত। স্ত্রী আরতির নিজের বাড়ির খুব শখ ছিল। শেখরের বাড়ি করার সামর্থ ছিল না। যা মাইনে পেত তাতে সংসারের আর জীবনের পড়াশোনার খরচ করে অল্প কিছু হাতে থাকত। তিল তিল করে সেই জমানো টাকা আর রিটায়ারের সময় পাওয়া পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল। কলকাতার উপকণ্ঠে এখানে তখন একটা-দুটো করে ফ্ল্যাট তৈরি শুরু হয়েছে। সেইজন্য সস্তায় পেয়েছিল। আরতির দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছিল। আরতি  কিন্তু খুব খুশি হয়েছিল। আর যাই হোক এতদিন পর একটা নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই হল। শেখররা তখন উত্তর কলকাতায় যেখানে ভাড়া থাকত, হেঁটে বাস রাস্তা দু মিনিট, বাড়ির কাছে একটা বড় বাজার ছিল।  রাত নটার সময়ও মাছ পাওয়া যেত। নানারকমের দোকান, রেস্টুরেন্ট সব ছিল। এত রকমের সুবিধা ছেড়ে শুধু মাত্র নিজস্ব আস্তানা আর স্ত্রী আরতির অনেকদিনের শখ মেটাতে শেখর এখানে চলে এল। জীবনের একদম ইচ্ছে ছিল না। বন্ধুবান্ধব, এতদিনের পুরোন পাড়া, আড্ডা এসব ছেড়ে আসাতে জীবন খুশি হয়নি। শেখরেরও খারাপ লাগত, যখন দেখত ছেলেটা কত কষ্ট করে ভিড়ের ট্রেনে রোজ কলেজ যেত। বাড়ি ফিরে রোজ রাগারাগি করত জীবন, বাবাকে দোষারোপ করত। 
 
মাথাটা এখনও গরম হয়ে আছে। বাবার যত কথা অফিস যাওয়ার সময়। দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, ছেলেকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাবছে পেনশনের টাকা নিয়ে ছেলে ফুর্তি করছে। এখন প্রত্যেকটা জিনিসের কী দাম বেড়েছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে? নিজে সারা জীবন কিপটেমি করে কাটিয়েছে। সস্তায় জমি পেয়েছে বলে উত্তর কলকাতার ওরকম জমজমাট জায়গা ছেড়ে এই ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে বাড়ি করল। কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে। ভিড় ট্রেনে করে কলেজ যাওয়া-আসা করতে দম বেরিয়ে যেত। কলেজের পর বন্ধুরা যখন আড্ডা মারত, জীবনকে আড্ডা শেষ হওয়ার আগেই ট্রেন ধরার জন্য ছুটতে হত। অফিস টাইম হয়ে গেলে ট্রেনে ওঠা খুব কষ্টকর ছিল। জীবন তাই অফিস টাইম শুরু হওয়ার আগে আড্ডা থেকে বেরিয়ে যেত। ওই ভিড় ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে এত ক্লান্ত লাগত যে, আর পড়তে ইচ্ছে করত না। তাছাড়া জীবন কোনদিনই পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিল না। কোনরকমে পাশ করে যেত। আজকের বাজারে অর্ডিনারি গ্র্যাজুয়েটের চাকরি কোথায়? খুব ইচ্ছে ছিল টেকনিক্যাল কোনও কোর্স করার। কিন্তু বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না কোর্সের খরচ দেওয়া। ভাগ্য ভাল হঠাৎ করে এই চাকরিটা পেয়ে যাওয়ায়। মাইনে খুব একটা খারাপ দেয় না। তবে পুরো উসুল করে নেয়। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, কিন্তু তার জন্য কোনও এক্সট্রা টাকা পায় না। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। এক্সট্রা টাকা ডিমান্ড করলে বলবে কাল থেকে আর আসার দরকার নেই। এই চাকরিটা চলে গেলে এখন নতুন চাকরি কোথায় পাবে? এর মধ্যে মার আবার শখ হয়েছে ছেলের বিয়ে দেবে। বাড়িতে থাকলে কানের কাছে এক কথা, এবার বিয়ে কর। বয়স তো বাড়ছে, বুড়ো হলে বিয়ে করবি? কিছুতেই বোঝান যাচ্ছে না এই ইনকামে তিন জনেরই চলছে না আবার একজন জুটলে আর দেখতে হবে না। এর থেকে ভাল একটা চাকরি না পেলে জীবন বিয়ের রাস্তায় পা বাড়াবে না। কিন্তু আজ বাবাকে সোজাসুজি বলে দেবে যে এবার থেকে আগের মতো তুমি সংসার চালাও। জীবন যে টাকা সংসারের জন্য খরচ করে সেটা বাবাকে দিয়ে দেবে। বাবার ব্যাংকের চেক বই, পাস বই, ডেবিট কার্ড সব ফেরত দিয়ে দেবে, তাহলে আর বাবাকে ছেলের কাছে হাত পাততে হবে না। জীবনও সন্দেহের হাত থেকে মুক্তি পাবে।
-কী রে টিফিন করবি না? কী এত ভাবছিস?
অজয়ের কথায় জীবনের হুঁশ ফিরল।
-ও দুটো বেজে গেছে খেয়াল করিনি। চলো খিদেও পেয়েছে।
মনে মনে বলল, আর খিদে, সেই তো একঘেয়ে রুটি আর তরকারি। ক্যান্টিনে গিয়ে টিফিন বক্স খুলে জীবন অবাক হয়ে গেল। পরোটা বেগুন ভাজা সঙ্গে আবার মিষ্টি। হঠাৎ টিফিনের রাজকীয় চেঞ্জ কেন ভেবে পেল না। তবে সকাল থেকে যে বিরক্ত ভাবটা ছিল সেটা কেটে গেল, জীবন যে কতদিন পর পরোটা খেল মনে করতে পারল না। উত্তর কলকাতায় যে পাড়াতে ওরা থাকত সেখানে একটা কচুরির দোকান ছিল। এত ভাল খেতে ছিল যে, কচুরি কেনার জন্য খুব ভিড় হত। দেরি করে গেলে পাওয়া যেত না। জীবন কচুরি খেতে ভালবাসত বলে বাবা প্রায় সকালে গিয়ে কচুরি নিয়ে আসত। এখন বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছে। সকালে বাবার সঙ্গে রাগারাগি করা উচি হয়নি। কেন যে আজকাল হট করে মাথা গরম হয়ে যায়।
 
বাড়ি ফিরে জীবন মাকে জিজ্ঞেস করল,
-বাবা কোথায়?
-নিজের ঘরে
বলে মা রান্না ঘরে গেল। জীবন বাবার ঘরে গিয়ে দেখে বাবা বিছানায় শুয়ে আছে। জীবনকে দেখে বিছানা থেকে উঠে বলল,
-আয় আয় তোর জন্য অপেক্ষা করছি।
তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কলম বার করে জীবনের হাতে দিল।
-হঠাৎ কলম!
জীবন ভীষণ অবাক হল।
-তুই কলম খুব ভালবাসিস। যখন ছোট ছিলিস তখন নতুন নতুন কলমের জন্য বায়না করতিস। কীরকম হয়েছে রে? অবশ্য একশো টাকায় এর থেকে ভাল কলম পেলাম না।
-কিন্তু এখন আমার অনেক কলম আছে। দরকার হলে আমি নিজেই কিনতাম, তুমি শুধু শুধু টাকা খরচ করতে গেলে কেন?
-কী যে বলিস। আজ তোর জন্মদিন, বাবা হয়ে একটা কিছু দেব না?
জীবনের মনেই ছিল না আজ ওর জন্মদিন। বাবা-মা ঠিক মনে রেখেছে। সেইজন্য আজকে মা টিফিনে পরোটা দিয়েছে। বাবা-মা ওকে এত ভালবাসে আর তার প্রতিদানে ওর বাবা-মায়ের ওপর ক্ষোভ রাগ আর অভিমান। জীবনের নিজেকে খুব ছোট মনের মনে হল। জীবনের চোখে সহজে জল আসে না। কিন্তু আজ ওর চোখ দুটো কখন জলে ভরে গেছে নিজেই জানে না। জীবন বাবাকে প্রণাম করতেই বাবা ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। কত বছর পর জীবন সেই ছোটবেলার মতো বাবার গায়ের গন্ধ পেল। যার বুকে পরম নিশ্চিন্তে নিজেকে সমর্পণ করা যায়। বাবা পাশে থাকলে পৃথিবীর কোনও শক্তি জীবনের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। বট গাছের মতো বাবা ওকে আগলে রাখবে। মা রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলছে,
-তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আয় জীবন। তোর জন্য পায়েস করেছি।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)