প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Friday, September 12, 2025

হারিয়ে গেল [২য় পর্ব] | তুহিনা সুলতানা

বাতায়ন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২তম সংখ্যা/৩রা আশ্বিন, ১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
তুহিনা সুলতানা
 
হারিয়ে গেল
[২য় পর্ব]

"মেয়ের ছবি আঁকড়ে ধরেচোখ শূন্যঠোঁট নীরব। মনে হচ্ছে যেন তার বুকের ভেতর সব ফাঁকা হয়ে গেছে। তখনই মঞ্চে প্রবেশ করল মাধুরী সেন। শহরের একজন তরুণী সাংবাদিক। সোজাসাপটা কথা বলেঅন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালায়।"


পূর্বানুবৃত্তি সান্ত্বনা গরিব ঘরের মেয়ে। বাবা নিত্যানন্দ পেশায় ঢাকি। পুজোর সময় শহরে গিয়ে ঢাক বাজানোই তার বড় আয়। সেই বছর দুর্গাপুজোয় নিত্যানন্দ সান্ত্বনাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। চারিদিকে আলো, রঙিন পোস্টার, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, আর রাস্তায় ভিড়। ভিড়ের মধ্যে কিছু দামী পোশাক পরা যুবকের চোখ পড়ে তার ওপর। তারপর…
 

সেই মৃতদেহের ছবি, সেই অসহায় কান্না, সেই অন্ধকার সত্যিই গ্রাম আর শহরকে বিভক্ত করে দিল। একপাশে ছিল পুজোর আলো আর আনন্দ, আরেকপাশে একটা ভাঙা কিশোরীর লাশ— যে লাশের সঙ্গে শেষ হয়ে গেল এক গরিব ঢাকির মেয়ের স্বপ্ন।

 
কলকাতার আলোর মেলা তখনো শেষ হয়নি। শহরের বড়লোক পাড়াগুলোয় পুজোর পরের আনন্দ—ভোজন, মেলা, শপিং, ফটোসেশান। টেলিভিশনে বারবার প্রচার হচ্ছে কে কোন মণ্ডপে কত কোটি টাকার থিমে সোনা-চাঁদির সাজে দুর্গা বানাল। কিন্তু সেই কোলাহলের বাইরে, এক কোণে বসে আছে নিত্যানন্দ। মেয়ের ছবি আঁকড়ে ধরে, চোখ শূন্য, ঠোঁট নীরব। মনে হচ্ছে যেন তার বুকের ভেতর সব ফাঁকা হয়ে গেছে। তখনই মঞ্চে প্রবেশ করল মাধুরী সেন। শহরের একজন তরুণী সাংবাদিক। সোজাসাপটা কথা বলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালায়। ঘটনাটা শুনেই তার মনে হল, এটা চুপ করে থাকা যাবে না। সে পৌঁছে গেল নিত্যানন্দদের গ্রামে। বাসন্তীর কান্না, মানুষের ক্ষোভ, সব তার চোখে জল এনে দিল। কিন্তু সাংবাদিকের চোখে জল থাকা চলে না, কলমে আগুন থাকা চাই। সে বলল,
-এটা শুধু সান্ত্বনার মৃত্যু নয়। এটা আমাদের সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছে। একদিকে কোটি টাকার আলোয় ভাসছে পুজো, অন্যদিকে এক গরিব ঢাকির মেয়ে নিরাপত্তাহীন হয়ে প্রাণ হারাল। আমরা চুপ থাকলে কাল আবার আরেক সান্ত্বনা হারিয়ে যাবে।
গ্রামের মানুষজন তখন দ্বিধায়—
-আমরা গরিব মানুষ, বড়লোকদের সঙ্গে কি লড়তে পারব?
মাধুরীর কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হল,
-বড়লোক বলেই কি তারা খুন করবে, ধর্ষণ করবে আর পার পেয়ে যাবে? গরিবের রক্ত কি সস্তা?
এই কথাগুলো যেন আগুন ধরিয়ে দিল লোকজনের বুকে। ধীরে ধীরে জড়ো হতে লাগল প্রতিবাদ। প্রথমে গ্রামের মাঠে ছোট্ট সভা, তারপর শহরে মিছিল। প্ল্যাকার্ডে লেখা— আমরা সান্ত্বনার বিচার চাই। ঢাকির মেয়ে মানে কি কেউ নয়?
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে খবর ছড়িয়ে পড়ল। দূরের শহর থেকেও মানুষ আসতে লাগল। সান্ত্বনার নাম হয়ে উঠল এক প্রতীক— দমিত কণ্ঠস্বরের, নিপীড়িত মেয়েদের, আর সমাজের ন্যায়ের দাবির।
নিত্যানন্দ এখন ভাঙা মানুষ। মিছিলে গেলেও তার চোখ ভিজে থাকে। তবু তিনি জানতেন—এই আগুনই হয়তো তার মেয়ের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলোকে এক নতুন পথ দেবে। এভাবেই শুরু হল সান্ত্বনার মৃত্যুর পর এক নতুন লড়াই।
এক লড়াই যা আর কেবল ঢাকির পরিবারের নয়, বরং প্রতিটি মেয়ের, প্রতিটি গরিবের, প্রতিটি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের। কলকাতার সেশন কোর্টের ভেতর তখন ঠাসা ভিড়। সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক—ধনী বাবার আদুরে সন্তান। চুলে জেল, শরীরে দামি জামা, চোখে দাম্ভিকতা। যেন এখন বিশ্বাস করতে পারছে না যে তারা আসামী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, সাক্ষী আসনে দাঁড়িয়ে আছেন নিত্যানন্দ। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন,
-ওরা আমার মাইয়ারে শেষ কইরা দিলো। ও যে ঢাকের তালে তালে হাসতো, সেই হাসি আর ফিরবো না… আমি শুধু বিচার চাই বাবু, বিচার চাই।
আদালত নিস্তব্ধ। কোণায় বসে আছেন মাধুরী। নোটবুকে কলম চালাচ্ছেন। এ লড়াইটা তিনি করেছেন কলম দিয়ে, মানুষের কণ্ঠকে একত্র করে। তার চোখে জল টলমল করছে, কিন্তু মুখ দৃঢ়। প্রতিরক্ষা আইনজীবীরা চেষ্টা করল অপরাধীদের বাঁচাতে।
-এরা নাবালক ছিল, ভুল করে ফেলেছে, মদ্যপ অবস্থায় ছিল।
কিন্তু মাধুরীর সংগ্রহ করা প্রমাণ— CCTV ফুটেজ, সাক্ষ্য, মেডিকেল রিপোর্ট— সব আদালতে দাঁড় করিয়েদিল কঠিন সত্য। শেষে বিচারকের কণ্ঠ ধ্বনিত হল,
-অভিযুক্তদের দোষ প্রমাণিত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
ঘরজুড়ে ফিফা ছড়িয়ে পড়ল। কেউ হাততালি দিল, কেউ বলল,
-ন্যায় হল!
কিন্তু নিত্যানন্দের বুক ভারী হয়ে রইল। তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
-ন্যায় কী বাবু? আমার মাইয়া তো ফেরত আসলো না…
বাসন্তী আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। তার বুকের ভেতর শূন্যতা রয়ে গেল। তবু অন্তত একটা সান্ত্বনা—মেয়ের মৃত্যুকে কেউ ধামাচাপা দিতে পারল না।
 
 
এক বছর পর
 
সান্ত্বনার গ্রামে ঢাকিরা আবার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুজোর। কিন্তু এ বছর গ্রামের মণ্ডপে কিছু আলাদা। প্রবেশদ্বারে বড় করে লেখা— সান্ত্বনার স্বপ্নপ্রতিটি মেয়ের সম্মানের পুজো
এখানে কোন থিমে কোটি টাকা খরচ নেই। কেবল মাটির প্রতিমা, সাধারণ আলো। কিন্তু প্রতিমার পাদদেশে রাখা আছে এক জোড়া কাঁসর— সান্ত্বনার স্মৃতিচিহ্ন। নিত্যানন্দ ঢাক বাজাচ্ছেন, তবে আগের মতো নয়। তার ঢাকের প্রতিটি ঘায়ে আজ আছে প্রতিবাদ, আছে স্মৃতি। বাসন্তী দাঁড়িয়ে, চোখ ভিজে—তবু মনে হচ্ছে মেয়েটি আজ মণ্ডপের ভেতর দাঁড়িয়ে হাসছে। মাধুরী সেই দৃশ্য দেখে মনে মনে লিখে নিল— সান্ত্বনা শুধু এক কিশোরীর নাম নয়। সে প্রতীক—অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। সে আমাদের বলে দিয়েছে, গরিব হলেও স্বপ্ন মরে না, কণ্ঠ রোধ করা যায় না।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)