প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

ঘাটের আটা | উৎপলেন্দু পাল

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
উৎপলেন্দু পাল
 
ঘাটের আটা

"কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তার আগে দলে দলে যে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছে তাতে এতদঞ্চলের জনবিন্যাস বদলে গেছে। তাদের  কেউ কেউ সরকারী বদান্যতায় বিভিন্ন কলোনিতা বসবাস করেন।"


বৈশাখ মাস। বিকেল গড়াতেই প্রচণ্ড কালবৈশাখী শুরু হল। আমাদের পাশের একটা পতিত ভিটেয় বড় বড় কয়েকটা আম গাছ। ঝড় একটু কমতেই গাছতলায় আম কুড়োবার ভিড়। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে হুটোপুটি করে আম কুড়োচ্ছে। আমি আমাদের গাছতলায় আম কুড়োচ্ছি। ওরা যদি এদিকে আসে তবে আমাদের গাছতলা সাফ করে দেবে। আম কুড়োতে কুড়োতে ওদের দিকে নজর রাখছি।

 
ওরা রাজবংশী পাড়ার ছেলেমেয়ে। আমরা বলি 'দেশি'। ওরা আমাদের বলে 'ভাটিয়া'। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে যেখানে ওদের পাড়ার রাস্তাটা আমাদের রাস্তা থেকে আলাদা হয়ে গেছে সেখানে এসেই বলতে শুরু করে, -আমার বাড়ি আমরা যাই দই চুড়া মাখি খাই, তোমার বাড়ি তোমরা যাও ভুটি কুত্তিখান মারি খাও।
আরও খানিকটা এগিয়ে বলত,
-ভাটিয়া, গু খায় চাটিয়া।
আমরাও পালটা দিতাম,
-দেশি, গু খায় বেশি।
কিন্ত পরদিন সকালে স্কুলে যাবার সময় ওই রাস্তার মোড়ে এসে ডাকত,
-কী রে, ইক্চুল যাবু না?
আমি যাব বললে ওরা আমার জন্য দাঁড়াত। আবার যেদিন ওদের দেরি হত আমি ডাকতাম। তারপর একসাথেই যেতাম আসতাম। রোজ ঝগড়া হত আবার রোজই মিল। কোনও কোনও দিন আবার কুকুর লেলিয়ে দিত। ওদের অভিভাবকরা দেখতে পেলে ওদের বকাবকি করত। এই দেশি ভাটিয়া নিয়ে কখনও কারো মধ্যে বিবাদ হতে দেখিনি। উৎসবে আনন্দে শোকে দুঃখে সবাই সবার পাশে। তখনও রাজনীতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করার খেলায় নামেনি। মানবতা পাশবিকতার পথে হাঁটতে শুরু করলেও অতটা পথ এগিয়ে যায়নি যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
 
সন্ধে এখনও হয়নি। তবে আকাশ কালো মেঘে এখনও ছেয়ে আছে বলে চারদিক অন্ধকার। গড়গড় শব্দে মেঘ ডাকছে। মা বলছেন,
-হৈচে, আর আম টুকানো লাগবো না। আবার ঝড় উঠবো। ঘরে আয়।
আমি বললাম,
-না টুকাইলে ওরা সব নিবোগা।
মা বললেন,
-এত আম দরকার নাই। হাত-পা ধুইয়া পড়তে বস।
মায়ের কথার অবাধ্য কখনোই ছিলাম না। আমি সুড়সুড় করে বাড়ির উঠোনে সবে ঢুকেছি অমনিই শুরু হল শিলাবৃষ্টি। আমি দৌড়ে বারান্দায় উঠে এলাম। অমনি ওই ছেলেমেয়েগুলোও আমাদের বারান্দায় দৌড়ে এসে উঠল। কারো হাতে চটের ব্যাগ ভর্তি কাঁচা আম, কারো বা বালতি ভর্তি। শিলাবৃষ্টি থামল বটে, শুরু হল মুষল ধারায় বৃষ্টি। সে আর থামে না। ততক্ষণে সন্ধে গড়িয়েছে। অন্ধকার পথে ছেলে তিনটি দৌড়ে বাড়ির পথ ধরল। কিন্ত জয়মালা যাবার সাহস পেল না। আমার মাকে বলল,
-মাওয়াই, মুঁই ক্যাং করিয়া বাড়িৎ যাইম?
মা বললেন,
-বস কতক্ষণ। তোর মা-বাবা কেউ আইসা নিয়া যাইবো। না হইলে তোর তালৈ দিয়া আসবোনে।
জয়মালা চুপ করে বসে থাকল। ও আমার সহপাঠী। ক্লাস টু। যে ছেলে তিনটি বাড়ি গেল সেই মানিক, মহেশ ও বাপইও আমাদের স্কুলেই পড়ে। ওরা জয়মালার প্রতিবেশী। জয়মালার বাবা-মা মাঝেমধ্যেই আমাদের জমিতে খেতমজুরের কাজ করে। ওর বাবা আবার বৈদ্যালি করে অর্থাৎ তন্ত্রমন্ত্র, ঝাঁড়ফুঁক, তাবিজ কবচ ইত্যাদি দেয়। তবে তা ব্যবসাভিত্তিক নয়। মা জিজ্ঞেস করলেন,
-কী রে, আইজ কী খাইছচ?
-সাকালে একান বাসিয়া রুটি খাইচুং। তারপর আর খাং নাই।
-দুপুরে খাচ নাই কিছু?
-না।
-তর মা ভাত রান্ধে নাই?
-চাওল নাই।
-কাইল কী খাইছিলি?
-সাকালে বাসিয়া রুটি, রাইতোত আরো ফির রুটি।
-দুপুরে?
-খাং নাই। কদ্দিন থাকি বাবার কাজ নাই। চাওল আনির পায় নাই।
ঠিক এমন সময় জয়মালার মা এসে হাজির।
-বাড়ি গেলুনা?
প্রশ্ন করেন তিনি।
-আন্ধার হয়া গেইচে।
-হাটেক বাড়ি বুলি।
 
জয়মালার মা'কে চেনে না এমন লোক আমাদের গ্রামে নেই। দশাসই চেহারা, প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও মুখরা। উনি যখন কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন বেশিরভাগই আটহাতি 'জনতা' শাড়ি পড়েন এবং কোনোরকম সায়া ব্লাউজ ছাড়াই। যখন বিছন ভাঙেন অর্থাৎ চারা ধানগাছ তোলেন তখন কোমরে ও বুকে গামছা বেঁধে কাজ করেন। তার স্থূল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আটহাতি কাপড়ে বা গামছায় বাঁধ মানে না। অন্যান্য শ্রমিকেরা তার দিকে আড়চোখে দেখেন, তাকে নিয়ে হাসি মশকরা করেন। এমনটাও শুনেছি যে কেউ কেউ তাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে মুখঝামটাও খেয়েছেন।
 
মা বসতে বললেন জয়মালার মাকে। কিন্ত তার তাড়া আছে।
-না বৈসং বিয়াইন, চৌপতি যাওয়া খায়। আটা আনা খাইবে। লক্ষণের দোকানত গেলুং, চাওল পাঁচসিকা সের। আটা টাকা টাকা। আর 'ঘাটের আটা' বারো আনা।
-নেন নাই?
-না, চৌপতিত ঠাকুরের দোকান যাং। ওঠে দাম কম। ঘাটের আটা আট আনা, কুনোদিন ষাইট পাইসা।
আমরা কখনও ঘাটের আটা খাইনি। বাবা বলতেন মনে হয় ওগুলো জোয়ার বা বাজরার আটা। গমের নয়। ভুষিতে ভরা। রুটি হয় শক্ত। চিবোলে চাপা ব্যথা হয়ে যায়। অর্থাভাবে গরিব মানুষ তা কিনে খায়।
 
কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তার আগে দলে দলে যে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছে তাতে এতদঞ্চলের জনবিন্যাস বদলে গেছে। তাদের  কেউ কেউ সরকারী বদান্যতায় বিভিন্ন কলোনিতা বসবাস করেন। আবার যারা একটু আগের দিকে এসেছিলেন তারা জমি-বাড়ি করে অধিকাংশই কৃষিজীবী বা ক্ষেতমজুর। অনেকে বাবুরহাট এলাকার তাঁতশিল্পের শ্রমিক। চাকুরিজীবী বা ব্যবসায়ীর সংখ্যা হাতে গোনা। আমাদের জমিতে যারা কাজ করতেন তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। কমবয়সিরা কৃষিকাজ করতেই চায় না।
 
প্রতি বছর এই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ক্ষেতমজুর শ্রেণির লোকেদের কাজের অভাব। আউস ধান ও পাট ক্ষেতের নিড়ানি দেওয়া শেষ। তখন আমাদের এলাকায় বোরোধানের চাষ হত না। বর্ষার চাষাবাদ শুরু না হলে হাতে কাজ নেই। তার ওপর জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। চাল আটার দাম তুলনায় বেশি। রেশনে যৎসামান্য যে চাল দেয় তা সেদ্ধ করতে জ্বালানি খরচ বেশি। লোকে বলে বোল্ডার চাওল। তার ওপর দুর্গন্ধ। সেই অভাব পূরণে ভুষি সর্বস্ব 'ঘাটের আটা'। ওর রুটি শক্ত। কিন্ত দামে সস্তা বলে শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা বেশি কেনেন। তার পুষ্টিগুন কতটা তা নিয়ে প্রত্যেকেই সন্দিহান। 
 
জয়মালার মা বলেন,
-প্যাট ভরে বিয়াইন, কিন্ত স্বাদ নাই। আর হাগাও ঢ্যাডঢ্যারা। কুনো কুনো সমায় প্যাট বিষায়। প্যাটের বিষোতে না হীরেনের মাওটা মইল্লেক!
মা বললেন,
-শুনলাম অনেকদিন ধইরাই প্যাট ব্যথা। হাসপাতালেও তো ভর্তি ছিলা
-কন না ওইল্লা কতা বিয়াইন, হাসপাতালোত সেলাইন ছাড়া কোনোয় না দেয়। বেডোত ফ্যালে থুইচে। দুইখান সুই দিচে কী দেয় নাই ছুটি দিয়া দিচে। ঔষধ কিনি নেওয়া খায়। ওই বালের হাসপাতালত ভত্তি হয়া কী লাভ? কোদ্দিন থাকি প্যাটের বিষ, বৈদ্য কতলা টাকা খাইল। বিয়াইন, প্যাটোত ভাত না থাইকলে রোগ হইবে না তো কী তায়? রোগও হইবে, মরণও হইবে।
 
মা উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ করে মাথা নিচু করে রইলেন। এই সমস্যার সমাধান জানা নেই। আটা খেয়ে হয়তো হীরেনের মা মরেননি। কিন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার সামর্থ্য না থাকায় মরেছেন তা নিশ্চিত। সরকারী চিকিৎসার কী হাল তা হাসপাতালে গেলেই বোঝা যায়।
জয়মালার মা বললেন,
-বিয়াইন, দুই সের চাওল দিবেন, কজ্জা। মোর চাইতেও শরম নাগে। বিচোন ভাঙ্গিয়া শোধ করি দিম। আগোতও মাওয়াইরঠে তিন সের চাওল নিচুং। দিবার পাং নাই। পাঁচ সের হৈবে। কদ্দিনোতে ছাওয়াটা ভাত খায় নাই। হামারলার ঝেমন তেমন ছাওয়ালা কী এইমতোন না খায়া, ঘাটের আটা খায়া থাকির পায়? ওইল্লা ঘাটের আটা খায়া খায়া কুনদিন মরি যাইম বিয়াইন, মরি যাইম।
বলতে বলতে তার দুচোখ ছলছল করে উঠল। অমন জাঁদরেল চেহারার মানুষটাকে কাঁদতে দেখে আমারও চোখ ভিজে এল। জয়মালা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
মা দুই কিলো চাল মেপে দিলেন। বললেন,
-এইডা শোধ করা লাগবো না।
সে চাল আঁচলে বেঁধে নিয়ে আমার ঠাকুর্মাকে প্রণাম করে মেয়ের হাত ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন জয়মালার মা। আমি পড়তে বসলাম। কিন্ত বইয়ের পাতা জুড়ে শুধুই জয়মালা আর জয়মালার মায়ের নিরন্ন মুখের জলছাপ।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)