প্রথম বর্ষ/দ্বিতীয়
সংখ্যা/১লা মে, ২০২৩
ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ২
সাগরিকা রায়
স্বপ্ন-জাহাজের যাত্রী
পূর্বানুবৃত্তি: সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে উথালপাথাল হয়ে পড়ছিল জাহাজ। শীত করছিল
সোমনাথের। শীতলতায় হিম হয়ে যাচ্ছিল শরীরের সব রক্ত। সোমনাথ বিধবা মায়ের কথায় প্রভাবশালী
প্রোমোটার অজয়দা-র কাছে যায়। অজয়দা ও মলিদিকে এক সঙ্গে দেখে ঈর্ষা জাগে সোমনাথের। মলিদি-র
জলতরঙ্গের মতো হাসি, পরির মতো ফুরফুরে ভঙ্গীর অর্থ বুঝতে পারে না। এরই মধ্যে দেখা হয়
টুম্পার সঙ্গে। টুম্পাও যেন পরির মতোই উড়ে যেতে চায়। নিজে যেচে এগিয়ে আসে সোমনাথের
কাছে।
পকেট হাতড়ে দশ টাকা
বার করে সোমনাথ।
“মাসিমা ভাল তো?” তাড়াতাড়ি
টাকা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে চলে যেতে থাকে টুম্পা, “দেখা হবে। খুব বিজি থাকি জানো!”
নীল ওড়না রোদের ঝাপটায় দুলে ওঠে। টুম্পা যেন পাখি হয়ে যায়। আকাশে হারিয়ে যাওয়া সেই
পরিযায়ী পাখি, সাইবেরিয়া থেকে যে এসেছিল। ওর শরীর থেকে টুকরো টুকরো বরফ ঝরে পড়েছিল
রাস্তার উপরে। রোদের তাপে গলে জল। তারপরই বাষ্প। হুস! নেই!
বাড়ি ফিরে এসে স্নান
করবে ভেবেছিল। রজতদা এসে হাজির। এদিক দিয়ে যাচ্ছিল, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ঢুকেছে।
মা খুশি হল, “বসো। অনেকদিন পর...! সোমা কেমন আছে?”
“ভাল নয় মামী, তোমার
কথা প্রায়ই বলে। বলে, অমন মামী লাখে মেলে। কত খাইয়েছে।”
এসব প্রসঙ্গে মা গুটিয়ে
যায়। বাবার আমলে যা চলেছে, তা কি চিরদিন চলে? বোধহয় সেই হীনমন্যতায় মা গুটিয়ে যায়।
রজতদাকে চা খাওয়ায়। সর্ষের তেল, কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে মুড়ি মাখে। রজতদা চলে যাওয়ার
পর উদাস মা আনমনে আকাশ দেখে— “পাওনা টাকাটার কথা বলতে পারি না। কতদিন হল নিয়েছে!” এমন
সময় টুম্পাকে মনে পড়ে সোমনাথের। সেই পাখি আসে, আবার চলে যায়।
“টুম্পাকে দেখলাম মা।
রজণীবাবুর মেয়ে, মনে আছে?”
“জানি। কেমন হয়ে গেছে
মেয়েটা। বাড়িতে আসে না। কোথায় থাকে কী করে কে জানে!”
স্নানের জলে সমুদ্রের
গন্ধ খোঁজে সোমনাথ। কল খুলে বালতি ভরে, ফের ফেলে দেয়।
“তোর হল?” মা চেঁচিয়ে
ডাকে।
“মা, কাল সকালসকাল ডেকে
দিও। অজয়দার সঙ্গে বের হব।”
লালশাক দিয়ে ভাত মাখতে
মাখতে কী ভাবে মা। সোমনাথ বোঝে মা আবার ওর চাকরির প্রসঙ্গে ফিরে যাবে।
ভোরের বাতাস মেখে বাইপাসে
এসে দাঁড়ায় সোমনাথ। আজ অজয়দা নিশ্চয়ই যাবে। বাতাস কেটে কেটে অজয়দার গাড়ি এগিয়ে যাবে
এক নতুন দেশে।
অজয়দার আসতে দেরি হল।
খিদে পেয়ে গেছিল সোমনাথের। ভেবেছিল এক কাপ চা খাবে। কিন্তু পকেটের কথা ভেবে পিছিয়ে
এল।
“এসে গেছিস? বলে রাখি
আজ কিন্তু নাও ফিরতে পারি।”
মা জানে অজয়দার সঙ্গে
যাচ্ছে। কিন্তু আজ না-ও ফিরতে পারে এ কথা জানা ছিল না। ভাববে মা। “বেশ। তোকে পাঠিয়ে
দেব, চল।”
অজয়দার সঙ্গে যাচ্ছে,
এই পর্যন্তই। কোথায় যাচ্ছে, জানার দরকার নেই। রোমাঞ্চ তো সেখানেই। অজয়দা একই বৃত্তে
ঘুরপাক খায় না। সে অন্য জগতের মানুষ। স্বপ্নের সত্যিকারের চেহারা সেখানে স্পষ্ট। এই
জগতটাকেই খুঁজে মরছে সোমনাথ।
ঘন্টা দুই পরে ওরা যেখানে
এসে পৌঁছল, সোমনাথের কাছে তা সম্পূর্ণ অচেনা। বাতাসে মফস্সলি গন্ধ। মরা মানুষের দৃষ্টি
মেলে পথ হাঁটছে লোকজন। মেয়েদের চেহারায় আদিম পৃথিবীর শ্যাওলার ছাপ। কাঁধে সস্তা ব্যাগ,
সিন্থেটিক শাড়িতে চড়া রং। মুখেও। কোথায় যাচ্ছে এরা?
একটা পলেস্তারাহীন বাড়ির
সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। আজ ড্রাইভারকে আনেনি অজয়দা। সরু প্যাসেজে আধপোড়া বিড়ি, সিগারেটের
টুকরো। ধুলো জমে থাকা সিঁড়ির কোণে কোণে পানের পিক শুকিয়ে আছে। অস্বস্তি হচ্ছিল সোমনাথের।
সারি সারি ঘর পার হয়ে
একটা ঘরের তালায় চাবি ঘোরাল অজয়দা। তারপর মুখ ফিরিয়ে হাসল— “কী? কীরকম?” বোকার মতো
হাসে সোমনাথ।
“চা খাও” বলে দরজার
দিকে তাকাতেই একটা লোক এসে হাজির। যেন সে বাতাসে মিশে লক্ষ্য রাখছিল সব। এখনই বলবে,
হুকুম করুন আকা! অজয়দা একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল, “চা” লোকটা পা ঘষে ঘষে চলে যাচ্ছিল।
মন্ত্র-পড়া সুরে সোমনাথকে ডাকল অজয়দা, “এসো সোমনাথ, বসো এখানে। আজ একটু নেশা করবে?
করো, দেখবে কাঁচা ড্রেনও ফোমের গদি। দাঁড়াও, একটা নেশা তোমাকে শিখিয়ে দেব।” রসিক মানুষ
অজয়দা সোমনাথকে দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে কী ভাবে। পা ছড়িয়ে বসে— “সোমনাথ, নতুন জগতে
যাবে বলেছিলে। যাবে?”
আশ্চর্য হয়ে তাকায় সোমনাথ।
এটা আবার একটা কথা হল? এ কথা কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে বলে ধারণা করতে পারেনি ও।
“নতুন জগত? কোথায়? কবে?”
“বলছি। তার আগে আমাকে
একটা কাজ করে দাও। পারবে তো? চা খেয়ে করবে? এসেই খেও বরং।”
ঘাড় নাড়ে সোমনাথ। “বেশ,
কিন্তু কী কাজ?”
“আমি তো আজ থেকে যাচ্ছি।
ভুল করে পেস্ট ব্রাশ সাবান কিচ্ছু আনিনি। এই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখ বাইরে। দূরে দোকানপাট
দেখতে পাচ্ছ? সামনের বড় দোকানটা থেকে এনে দিতে হবে। পারবে?” অজয়দা সবার থেকে আলাদা।
সামান্য কাজ, তার জন্য কত অনুরোধ।
“এখনই এনে দিচ্ছি।”
উঠে দাঁড়াল সোমনাথ। “টাকা নিয়ে যাও।” পকেট থেকে হাজার টাকার নোট অবলীলায় তুলে আনে অজয়দা।
মুক্তো, প্রবাল, হীরের আংটি পরা আঙুলের দুর্লভ জগত থেকে উঠে আসা টাকাটা স্পর্শ করে
সোমনাথ।
“যাওয়ার সময় দরজাটা
টেনে দিয়ে যেও। আর, এদিকে শোন, টাকাটা কায়দা করে গছাবে।” একটা চোখ ছোট করে ইশারা করে
অজয়দা সোমনাথকে।
সোমনাথ থমকাল, “মানে?”
“বুঝে নাও। নতুন জগত
দেখতে চেয়েছিলে না? হাজার টাকার চেঞ্জ দিতে না পারলে, এই একটা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে
যাও। কথা ব’লে ব’লে অন্যমনস্ক রেখ দোকানিকে। খুব সাবধানে কাজটা করবে। এটা ওটার দাম
জানতে চাইবে। মোট কথা, দোকানদারকে ব্যস্ত রাখবে।”
এক লহমায় সব বুঝে ফেলল
সোমনাথ। এ-ও এক আবিষ্কার। সেই আজব কলের খোঁজ পেয়েছে অজয়দা। হুবহু টুম্পা, মলিদির মতো
লাগছে অজয়দাকে। তবু কিছু বলতে পারল না সোমনাথ। হয়তো আবিষ্কারের নেশাটা ওকে পেয়ে বসেছে
অথবা অজয়দার হাতের সুতো বাঁধা পুতুল হয়ে গেছে ও।
ভিড়ে ঠাসা দোকানটা।
ইতস্তত করে সোমনাথ। যদি ধরা পড়ে যায়? অজয়দা কি ওকে বাঁচাতে আসবে? ব্যস্ত দোকানদার চোখ
তুলল— “কী চাই?”
“সাবান, পেস্ট... ব্রাশ।”
দ্রুত হাতে জিনিসগুলো
গুছিয়ে দিল দোকানদার। ঘামে ভিজে যাওয়া ভাঁজ করা হাজার টাকার নোটটা এগিয়ে দেয় ও। একটু
সন্দেহ, একটু দ্বিধা সর্বনাশ করে দেবে! হাত কাঁপে, হৃৎপিন্ডের শব্দটা কানে এসে বাজে।
লাফিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসে সোমনাথ। পালাতে হবে এখান থেকে।
“ও মশাই, আরে চেঞ্জটা
নিন।”
ত্রাসে শ্রবণশক্তি হারিয়ে
যাচ্ছিল ওর। ফেরত পাওয়া টাকাপয়সা মুঠোয় ভরে দ্রুত হাঁটতে থাকে। ধরা পড়ল না! দোকানি
টাকাটা খুলে দেখেনি। এখন যদি দেখে? যদি ওকে ডাকে! দ্রত বেগে একটা দোকানের আড়ালে চলে
গেল সোমনাথ। তারপর চোরের মতো সাবধানে উঁকি দেয়। কী করছে দোকানদার? ভিড় সামলাচ্ছে? সোমনাথের
নোটটা নিয়ে একদম ভাবছে না?
“কী গো, যাবে নাকি?
সকালে দাম কম, সস্তায় ছেড়ে দেব।” রংচং মাখা একটা মুখ বুকের ওপর থেকে আঁচল সরিয়ে ওকে
দেখাল। আতঙ্কিত সোমনাথ ছুটে আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। প্রায় ছুটতে শুরু করল। অনেকটা
দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। আহ্! আরামের শ্বাস ফেলে সোমনাথ। কী ভয়ংকর দুনিয়ায় না ঢুকেছিল!
ভয়াবহ সব আবিষ্কার হল আজ! ক্যাপ্টেন কুক জানলে কী বলবেন? আশ্চর্য! লোকটা বুঝতেই পারল
না টাকাটা জাল? খুব সোজা তো কাজটা! তবে ওই বিচ্ছিরি মেয়েটা...! হাসতে গিয়েও থমকে গেল
সোমনাথ। এমনই এক জগতে কি আসতে চেয়েছিল ও? এমন ভয়, লজ্জা ভরা পৃথিবীতে? হঠাৎ একটা তীব্র
ভয় এসে জাপটে ধরে ওকে। এই ঘোরদুপুরে এক মফস্সল শহরের ঘামে ভেজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোমনাথ
বুঝতে পারে লাল রঙের ড্রাগন মুখওয়ালা জাহাজ থেকে ওকে নামিয়ে দিয়েছে জাহাজের ক্যাপ্টেন।
সমুদ্রের উপরের কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে সেই জাহাজ। আর দেখা হবে না সেই জাহাজের সঙ্গে।
মুঠোয় রাখা টাকাগুলো
দেখল সোমনাথ। অনেকগুলো টাকা। কিন্তু দোকানদার এত তাড়াহুড়ো করে চেঞ্জ দিল কেন? এগুলো...
এগুলোও জাল নয় তো?
সূর্যের তাপে ভরা রাস্তার
মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে ওঠে সোমনাথ! ওহ্ ক্যাপ্টেন! দু’ হাত তুলে আকশের দিকে নিক্ষিপ্ত
করে মুঠো। চারপাশে টাকাপয়সা ছড়িয়ে পড়ে। সমস্ত শরীর জুড়ে তাপ বিসর্জন করতে করতে সোমনাথ
চিৎকার করে ওঠে— “ভাল্ হাল্লা!”
ভাইকিংরা মৃতের জগতকে
এই নামেই ডাকত। এতদিনে সোমনাথ সেই জগতকে আবিষ্কার করতে পেরেছে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment