প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দেবীর বিসর্জন | বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ দেবীর বিসর্জন তুমি ...

Saturday, July 1, 2023

শর্ত হচ্ছে শরীর ও মনকে সুস্হ রাখা । অমলেশ কুমার ঘোষ

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/১২তম সংখ্যা/১৫ই আষাঢ়, ১৪৩০

অন্য চোখে
অমলেশ কুমার ঘোষ

শর্ত হচ্ছে শরীর-মনকে সুস্হ রাখা

(২০১৫ সাল থেকে International Yoga Day ২১শে জুন পালিত হচ্ছে মানসিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক কথা মনে রেখে। এটা বেশ কিছু কাল আগে লেখা প্রাচীন গ্রন্থ পাঠ করার পর অনেক সময় নিয়ে।)

যোগ হল দুই বা ততোধিক সংখ্যার মধ্যকৃত পরিমাপের এক প্রকার গাণিতিক প্রক্রিয়া। এটা প্রাথমিক অঙ্কশাস্ত্রের চারটি মৌলিক প্রক্রিয়া-প্রতীকের মধ্যে একটি প্রতীক। অন্য দিকে যোগ ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত এক প্রকার ঐতিহ্যবাহী শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক সাধনপ্রণালী। "যোগ" শব্দটির দ্বারা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ধ্যানপ্রণালীকেও বোঝায়। হিন্দুধর্মে এ’টি হিন্দু দর্শনের ছয়টি প্রাচীনতম শাখার অন্যতম। জৈনধর্মে যোগ মানসিক, বাচিক ও শারীরবৃত্তীয় কিছু প্রক্রিয়ার সমষ্টি। খৃস্টীয় ১১ শতকে হঠযোগের পুঁথিসমূহের আবির্ভাব হয়েছিল তান্ত্রিক পন্থা থেকে। পরে ইংরেজি ভাষায় যোগার সংযুক্তি যোগ থেকে।

"যোগ" শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। এ’টি সংস্কৃত "যুজ" ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন, যার অর্থ "নিয়ন্ত্রণ করা", "যুক্ত করা" বা "ঐক্যবদ্ধ করা"। "যোগ" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তাই "যুক্ত করা", "ঐক্যবদ্ধ করা", "সংযোগ" বা "পদ্ধতি"। সম্ভবত "যুজির্সমাধৌ" শব্দটি থেকে "যোগ" শব্দটি এসেছে, যার অর্থ "চিন্তন" বা "সম্মিলন"।

যোগের বিষয়ে উল্লেখ থাকা কিছু গ্রন্থ যেমন হিন্দুদের উপনিষদ বা বৌদ্ধধর্মের পালি ভাষায় লেখা কতিপয় ধর্মশাস্ত্র। পতঞ্জলির যোগসূত্রসমূহ খৃষ্টজন্মের প্রায় পাঁচশো বছরের ভিতরে লেখা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়. যদিও বিংশ শতকে প্রসারতা লাভ করতে সক্ষম হয়, অনেক বাঙালি হিন্দু সন্ন্যাসী ও ভারতীয় সনাতন ধর্ম ও মানবতা ও প্রাচীনতা নিয়ে পাশ্চাত্য দেশে ভ্রমণ ও কেউ কেউ আশ্রম করে দেশীয় পন্থায় প্রচার করেছিলেন হিন্দুধর্ম বা উপনিষদ। পরবর্তীতে উপমহাদেশের অন্য প্রদেশের শাস্ত্র পণ্ডিতগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গেছেন যোগের শরীরবৃত্তিয় দিক নিয়ে।

স্বামী বিবেকানন্দের সফলতার পর, উনিশ শতকের শেষ ভাগে এবং বিংশ শতকের প্রারম্ভ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের যোগাচার্য্যগণ পশ্চিমী দেশসমূহে যোগবিদ্যার প্রচার করেন। ১৯৮০-র দশকে পাশ্চাত্য দেশসমূহে এ’টি শরীরচর্চার অঙ্গ হিসেবে জনপ্রিয় হয়। অবশ্য ভারতীয় পরম্পরায় যোগকে কেবল এক শরীরচর্চার অঙ্গ মাত্র জ্ঞান করা হয় না, এর এক আধ্যাত্মিক এবং ধ্যানের প্রাণ আছে বলে বিবেচনা করা হয়। তদুপরি, সাংখ্য দর্শনের সাথে বহু মিল থাকা ‘যোগ’ হল হিন্দুধর্মের ছয়টি মূল ধারার একটি, যার নিজেরই এক মীমাংসা প্রণালী (epistemology) এবং তত্ত্ব (metaphysics) আছে।

যোগ দুই ভাগে বিভক্ত। যথা- হঠযোগ এবং রাজযোগ। সাধারণ লোক যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম বা আসনগুলোকে বোঝে। রাজযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করা। আর পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়াই হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ। তবে হঠযোগের সঙ্গে রাজযোগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও রয়েছে। সাধনার পূর্ব শর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা।

যিনি যোগ অনুশীলন করেন বা দক্ষতার সহিত উচ্চমার্গের যোগ দর্শন অনুসরণ করেন, তাকে যোগী বা যোগিনী বলা হয়। অষ্টাঙ্গ যোগই বর্তমানে প্রচলিত। রাজযোগের প্রতিটি প্রকারভেদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। এই আটটি অঙ্গ হলঃ

১. যমঃ (পাঁচটি "পরিহার")- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।

২. নিয়মঃ (পাঁচটি "ধার্মিক ক্রিয়া")- পবিত্রতা, সন্তুষ্টি, তপস্যা, সাধ্যায় ও ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ। ‘যম’ ও ‘নিয়ম’ এ দুয়েরই উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলিকে দমন করা এবং এগুলিকে অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা।

৩. আসনঃ যোগ অভ্যাস করার জন্য যে ভঙ্গিমায় শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোন রূপ কষ্টের কারণ ঘটে না তাকে আসন বলে। সংক্ষেপে স্থির ও সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই আসন।

৪. প্রাণায়ামঃ ("প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণ")- প্রাণস্বরূপ নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ।

৫. প্রত্যাহারঃ বাইরের বিষয়গুলি থেকে ইন্দ্রিয়কে সরিয়ে আনা। আসন ও প্রাণায়ামের সাহায্যে শরীরকে নিশ্চল করলেও ইন্দ্রিয় ও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর না-ও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হল প্রত্যাহার।

৬. ধারণাঃ কোন একটি বিষয়ে মনকে স্থিত করা। কোন বিশেষ বস্তুতে বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ করে রাখাকে ধারণা বলে।

৭. ধ্যানঃ মনকে ধ্যেয় বিষয়ে বিলীন করা। যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সে বিষয়ে যদি চিত্তে একাত্মতা জন্মায় তা’হলে তাকে ধ্যান বলে। এই একাত্মতার অর্থ অবিরতভাবে চিন্তা করতে থাকা।

৮. সমাধিঃ ধ্যেয়ের সঙ্গে চৈতন্যের বিলোপসাধন। ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবিষ্ট হয়ে পড়ে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যান রূপ প্রক্রিয়া ও ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থাকেই সমাধি বলে। এই সমাধি প্রকার ভেদ- সবিকল্প এবং নির্বিকল্প। সাধকের ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকলে, তাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমাধি। তখন তাঁর মনে চিন্তার কোনো লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর, যোগীর পরম প্রাপ্তি।


যোগসাধনার এই শাখার মতে, চৈতন্যের সর্বোচ্চ অবস্থায় উঠতে পারলে বৈচিত্র্যময় জগতকে আর মায়া বলে মনে হয় না।
প্রতিদিনের জগতকে সত্য মনে হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করে। তার আমিত্ব লুপ্ত হয়।

হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা। হঠযোগীর ধারণা কোনোরূপ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। হঠযোগের ব্যায়াম বা আসনগুলোক জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ। সাধনার পূর্ব শর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা।

শারীরিক ব্যায়াম (Physical exercise, exercise অথবা workout) হল যে কোন শারীরিক কার্যক্রম যা শারীরিক সুস্থতা রক্ষা বা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অপর একটি অর্থ হল শরীরের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত আন্দোলন। ‌বিভিন্ন কারণে ব্যায়াম করা হয়, যেমন- মাংসপেশি ও সংবহন তন্ত্র সবল করা, ক্রীড়ানৈপুন্য বৃদ্ধি করা, শারীরিক ওজন হ্রাস করা বা রক্ষা করা কিংবা শুধু উপভোগ করা। নিয়মিত ব্যায়াম মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকে পুনরুদ্ধার হতে সাহায্য করে। হৃদ্ররোগ, সংবহন তন্ত্রের জটিলতা, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতা রোধে শারীরিক ব্যায়াম কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া মানসিক অবসাদগ্রস্ততা দূর করতে, ইতিবাচক আত্মসম্মান বৃদ্ধিতে, সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায়, ব্যক্তির যৌন আবেদন বৃদ্ধি, শরীরের সঠিক অনুপাত অর্জনে শারীরিক ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুস্বাস্থ্যের স্থূলতা একটি সমকালীন বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ব্যায়াম শরীরের স্থূলতা রোধে কাজ করে। স্বাস্থ্যসেবাপ্রদানকারীরা শারীরিক ব্যায়ামকে ঔষধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা রক্ষার্থে ব্যায়ামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রমাণিত।

মানব শরীরের উপর প্রভাবের ভিত্তিতে শারীরিক ব্যায়ামকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়—

অ্যারোবিক ব্যায়ামঃ যে সব ব্যায়াম বা শারীরিক কার্যক্রম শরীরের বড় মাংশপেশিগুলো ব্যবহার করে শরীরের অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি করে সেগুলো অ্যারোবিক ব্যায়াম। এ সব ব্যায়ামের লক্ষ্য শরীরের হৃদপিন্ডসহ সামগ্রিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সহনশীলতা বৃদ্ধি করা। এ ধরনের ব্যায়ামের উদাহরণ হল সাইক্লিং, সাঁতার, হাইকিং, টেনিস, ফুটবল ইত্যাদি খেলা।

অ্যানেরোবিক ব্যায়ামঃ এ সমস্ত ব্যায়াম শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মাংসপেশি ও হাড়ের সবলতা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া শরীরের ভারসাম্য বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। এ ধরনের ব্যায়ামের উদাহরণ হল পুশআপ, বাইসেপ কার্লস, পুলআপ ইত্যাদি। ভারোত্তোলন, ফাংশনাল প্রশিক্ষণ ইত্যাদি এ জাতীয় ব্যায়ামের অন্তর্ভুক্ত।

ফ্লেক্সিবিলিটি ব্যায়ামঃ এ সব ব্যায়াম শরীরের মাংশপেশির প্রসারণ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এ ধরনের ব্যায়ামের লক্ষ্য শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করা যাতে ইনজুরি বা আঘাতের প্রবণতা হ্রাস পায়।

শরীর ও মন মিলে শারীরবৃত্তীয় ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত মানের মানসিক লক্ষণ। এই অবস্থায় শারীরবৃত্তীয় সকল ধরনের গতি পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে সচেতন ভাবে সচেষ্ট হয়। Habit is the second nature. প্রাকৃতিক ও শারীরবৃত্তীয় কাজের মধ্যে সেতু বন্ধনে ‘যোগ’ আপন ভূমিকা পালন করে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে, তা ব্যায়ামই হোক বা সাধনা বা ধ্যান যেভাবেই বলা হোক, মনকে সংযত করতে পারে শুধু মাত্র যোগ ব্যায়াম। অন্যভাবে শরীর মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনো কর্মই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়। যোগের পূর্ব শর্ত হচ্ছে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখা। মানবতা মানুষের ধর্ম।

সমাপ্ত


2 comments:

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)