বাতায়ন/ছোটগল্প/বর্ষা/১ম বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/১৯শে শ্রাবণ, ১৪৩০
ছোটগল্প
বর্ষা
দেবশ্রী রায় দে সরকার
আর্দ্র
গত তিনদিন প্রবল বর্ষণের জন্য নিজের ব্যান্ডপার্টির ড্রেসটা শুকোতে পারেনি শামসুদ্দিন। মহাত্মা গান্ধী রোডের একটা আধ-ঘুপচি টালির ঘরে তার সংসার। কীসের টানে যে নিজের গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসেছিল সে আজ মনে নেই। দীর্ঘ কুড়ি বছর বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যান্ডে তাসা বাজায়। বিপত্নীক শামসুদ্দিন আর তার মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে দিন কাটায় কায়ক্লেশে খুব সামান্য রোজগারে। ফাতেমার দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে সামান্য ব্যান্ডপার্টির তাসা বাদক শামসুদ্দিন অপারক। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় একটা ভাল সুযোগ এসেছে তার।
অবাঙালির বিয়েতে তাসা বাজাতে হবে। কোম্পানির মালিক তাকে একটু বেশি অর্থ দেবে বলেছে আর অবাঙালিদের বিয়েতে বকশিশও পাওয়া যায় বেশি। অত্যন্ত আশায় বুক বেঁধেছে শামসুদ্দিন কিন্তু সমস্যা করছে অঝোর ধারার বৃষ্টি। আজ আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা বিকেলে যেন বৃষ্টি কমে যায়। ঘরের অতি পুরোনো টেবিল ফ্যানে শুকোতে থাকে তার লাল রঙের ড্রেসটা। শেষ ছয় মাস তার মেয়ে ফতেমার কষ্ট একটু বেশিই বেড়েছে। "বাবা আজ কাজে যেয়ো না। আমার কাছে একটু থাকো-না" কাতর আকুতি ফতেমার। "না রে মা আজ গেলে অনেক বকশিশ পাব। তোর ওষুধ আর তোর জন্য তোর পছন্দের কেক কিনব।" শামসুদ্দিন মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে। শামসুদ্দিনের পোশাক প্রায় শুকিয়ে গেল, বৃষ্টিও যেন কমল একটু। পোশাক পরে কাজের উদ্দেশ্যে বিকেলে বেরিয়ে পড়ল। শামসুদ্দিন না থাকলে ফতেমাকে দেখাশোনা করে পাশের বাড়ির পাতানো এক দিদি। শামসুদ্দিন বারবার দিদিকে বলে গেল আজ ফতেমা একটু বেশি অসুস্থ। কোন সমস্যা হলে দিদি যেন ফোন করে তাকে।
বেঙ্গল ন্যাশানাল তাসা পার্টি বর আর বরযাত্রী নিয়ে এগিয়ে চলল বিবাহ বাসরের উদ্দেশ্যে। ঘন্টা দুয়েকের জন্য বৃষ্টি কমলেও আবার বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই ব্যান্ডপার্টি এগিয়ে চলল কারণ বর ও বরযাত্রীর গাড়ি যে তাদের পিছন পিছনই আসবে। তাই তাদের থামলে চলবে না। শামসুদ্দিনের জামার পকেটে ফোন বেজে চলেছে। অঝোর বৃষ্টি আর তাসার আওয়াজে ফোন শুনতে পেল না শামসুদ্দিন। দলের একজন বলল তোমার ফোন বাজছে শামসুদ্দিন ভাই। কিন্তু বাজনা যে থামানো যাবে না। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছল তারা। বর পৌঁছে গেল নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে বিবাহ বাসরে।
দিনের রোজ আর মোটা বকশিশ পেয়ে শামসুদ্দিন খুব খুশি আজ। ফেরার পথে ফাতেমার জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল তার ফোন অনেকক্ষণ আগে বেজেছিল। তার পাশের বাড়ির দিদির ফোন। ফোনটা হাতে নিয়েই তাড়াতাড়ি দিদিকে ফোন করল সে। উদ্বিগ্ন গলায় দিদি জানাল ফতেমার অবস্থা খুব খারাপ হয়তো শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চলেছে সে… শামসুদ্দিন কেমন হতভম্ব হয়ে গেল কারণ দীর্ঘ ৬ মাস যক্ষ্মা রোগে ফাতেমা ভুগছে, সাধ্যমতো যৎসামান্য রোজগার দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে এক পিতৃ হৃদয়। কিন্তু আজ যেন তার মনে হচ্ছে কোথায় যেন সে হেরে যাচ্ছে। ফেরার পথে অঝোর বৃষ্টিধারায় স্নাত হতে হতে শামসুদ্দিন হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পথে চলল, আর্দ্র তার চোখ। কোন জলে ভিজল সেই চোখ? বৃষ্টির জলে নাকি পিতৃ হৃদয়ের মমতায় নাকি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেওয়া তার শেষ প্রার্থনায়...
সমাপ্ত
Touched the heart ❤️
ReplyDeleteVery well written. Heart ❤️ touching story
ReplyDelete