প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১ ৯ তম সংখ্যা/ ৩০শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ ধারাবাহিক উপন্যাস পারমিতা চ্যাটার্জি শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব...

Saturday, August 5, 2023

বর্ষা | জিয়ানস্টাল | আলোক মণ্ডল

 

বাতায়ন/গদ্য/বর্ষা/১ম বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/১৯শে শ্রাবণ, ১৪৩০

গদ্য / বর্ষা
আলোক মণ্ডল

জিয়ানস্টাল

ঝিম বৃষ্টির পর কিংবা নিকানো উঠোন ঘিরে দুপুরের নির্জন বাতাস যখন ঘুরে মরে তখন কেমন যেন নিজেকে আলাদা ভাবতে শুরু করি, বুঝতে পারি শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে একটি ছোট্ট আমি, সে ছুট্টে ঢুকছে সেই দুই কামরা কোয়ার্টারে- বি-টাইপ কোয়ার্টার, যার ভেতরে একটি বারান্দা তার এক পাশে ধোঁয়াটে রান্নাঘর অন্য দিকে টয়লেট, হলুদ বাল্‌বের আলোয় আবছায়া। টাইম কলের পাইপ ঝুলছে চৌবাচ্চায়, রাতদিন তার অদ্ভুত জল পড়ার শব্দ। এক চিলতে উঠোন, সামনের বারান্দায় ছাদ, বি-টাইপ কোয়ার্টারে তাই থাকে, সি-টাইপে থাকে না। শোবার ঘরের জানালার পাশে আমলকী গাছ, ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ন্যারোগেজ লাইনের লেবেল ক্রসিং। অঝোর বৃষ্টি - হরিদাস পালের কাঠের বাঁটওয়ালা ছাতা মাথায় চলেছি, হাতে প্যান্ট-কাটা খাঁকি থলিতে বই। ছেঁড়া থলি থেকে কখন যে পড়ে গেছে কাঠের স্কেল কে জানে! ঘন মেঘের মতো মনখারাপ নিয়ে চলেছি পাঠশালার দিকে। মা ডাকছে, "ফিরে আয়, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে আয়, আর যেতে হবেনি!" ভিজে সপ জামায় চলেছি কোচিং ক্লাসে। সামনেই বৃত্তি পরীক্ষা। পথে ভূতের বাড়ি, গা ছমছম, একলা আমি এক দৌড়ে বনপুকুর। সেখানে জলপাম্প টেস্ট করছে কেউ, নির্ভয় আসে তখনই। ঝোপের আড়ালে পাকা তাল কুড়িয়ে বাড়ি ফেরা, ভাদ্রের বৃষ্টি তখন গেছে থেমে।

কু ঝিকঝিক বিডিআর কালো রঙের পোড়া মাটির ওপর লোহার লাইন পাতা। হই-হই দে-দৌড় লাইন ধারে, কালো ধোঁয়া উগরে ছুটে আসছে দৈত্য রথ। একটি দু’ পয়সা লাইনে পেতে দিতেই চেপ্টে ইয়া বড়! আহা, কত্ত বড় পাওয়া! দু' পয়সা, তিন পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, কুড়ি - আঙুলের ডগায় রেখে এক বালতি জলে ভাসিয়ে একা-একা খেলা। কী মজা, কী মজা- সঙ্গীহীন একা-একা মেতে থাকা! দাড়িয়া বাঁধা, বুড়ি বসন্ত সবাই মিলে সে সব অন্য এক মজার মজা! ভিজে মাটিতে কাঠি দিয়ে কোর্ট এঁকে এক্কাদোক্কা- কতবার ছোট্ট আমি ফেলে এসেছি অজন্তা হাওয়াই চটি, সকালে মনে পড়তেই ছুটে গিয়ে চটি হস্তগত করার আগে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরের মুক্তোকণা, টগরের ডাল নাড়িয়ে বৃষ্টির জল ঝরানো, আহা সেই ছোট্ট বেলা!

কোয়ার্টারটি মনে হত সবুজ দ্বীপ চারদিকে গাছগাছালি ঘেরা। পুব দিকে মাঠের ওপারে ঘন শাল বন, এক পশলা বৃষ্টির পর রোদ উঠত যখন, শালপাতায় সে এক মোহময় রং গড়িয়ে পড়ত চারদিকে, ছুটে যেত ছোট্ট আমি বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে ঝরে পড়া শালফুল লুফে নেওয়া আহা, কী পরম প্রাপ্তি! মাটি ফুঁড়ে সেই ভেলভেট পোকা, নরম তুলতুলে পিঠে হাত বোলাতেই চোদ্দোটি ছোট-ছোট পা গুটিয়ে নিত পেটের ভেতর, আবার নিরাপত্তা অনুভূত হলে পা মেলে চলে যেত নরম মাটির বুকে এঁকেবঁকে দাগ ফেলে। কতবার সেই দাগ ধরে হেঁটে গিয়ে পেয়েছি উইঢিপির পায়ের তলায় সিঁদুরে আম, গত রাতে ঝড়ে পড়ে থাকা আম। দু'-কামরা কোয়ার্টারের সামনে টেস্ট রিলিফের কাজের দরুন কাটা খালের উপরে অসহায় পড়ে থাকা বাঁশের সাঁকো- দুরু বুকে পেরিয়েই ওপারে আশ্চর্য এক কাকুর বাড়ি। অবিবাহিত, গানপাগল। নিজেরই জন্মদিনে কলোনির ছোটদের আদর করে খেলনা আর ট্রফি দিত। হেমন্ত মুখার্জীর মতো জামার গোটানো হাত নিয়ে কাকু যখন মাথায় আদরে হাত বোলাত, শরীরে ঝরনা ঝরে যেত, গান আসত বেরিয়ে ওর দরদি গলা থেকে। একদিন মহালয়ার সকালে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় তখন চণ্ডীপাঠ শেষের দিকে, দেখি সবাই ছুটছে কাকুর কোয়ার্টারের অভিমুখে। সবার মুখ ভার, কেমন নতশির, কালো! ফিসফিস কানে এল কাকু নেই, গলায় দড়ি নিয়েছেন। জানি না কেন গলায় দড়ি বেঁধে কাকু ঝুলেছিল কৃষ্ণচূড়ার ডালে ঠিক দীপ্তিপিসির কোয়ার্টারের পাশে। দীপ্তিপিসি কি জানত? ও-ও তো তখন গান গাইত আকাশবাণীতে! কী জানি, কেন, কে জানে! এর আগে ঐ গাছের ডালে সুতো বেঁধে ঝোলাতাম হরলিক্সের কাগজ প্যাকেট, হাওয়ায় ঘুরত কখনও বনবন কখনও আস্তে আস্তে আর আমার ছোট চোখ গুনে রাখত কত পাক ঘুরল সারা দুপুর। এরপর থেকে সে খেলা বন্ধ হোলো, যদি ভূত হয়ে ফিরে কাকু, নিতে আসে আগের দেওয়া খেলনা ট্রফি!

প্রাথমিক শেষ পরীক্ষা দিতে গেছি হাই স্কুলে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের উঁচু বারান্দা থেকে এক ঝাঁপ দিয়ে সটান নীলবাড়ি কাঁঠাল বন পেরিয়ে, পুলিশ ফাঁড়ির তারকাঁটা গলে সিনেমাতলা। কাচের ঢাকনা দেওয়া বোর্ডের ভেতরে রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকাদের কথা কল্পনায় ভেবে নেওয়া- অপু, ট্রেন দেখবি? কাশ বনের মাঝ দিয়ে ছুটে চলা অজানা এক দেশে!

শ্রাবণের অঝোর ধারায় কোয়ার্টারের সামনের বারান্দায় ঝুলন সেজেছে পাহাড়-নদী-উদ্যান। পথের ধারেই ঘর- হাঁড়িকুড়ি উনুন, পাথর বিছানো পথে প্যাটন ট্যাঙ্ক, নদীতে নৌকো। গুহা থেকে বেরিয়ে আসা হাঁ-মুখ সিংহের পাশে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ। কল্পনায় এক মায়া শহর। ছোট্ট আমি এখনও গন্ধ পাই ঘাস চাপড়া তুলে আনা মাটি লাগা শিকড়ের গন্ধ, চোখে ভাসে গুলঞ্চ বোঁটায় লেগে থাকা দুধ, শুনতে পাই পাহাড় থেকে ঝরে পড়া ঝরনার জলের শব্দ। শুয়ে আছি যেন অতন্দ্রিত আমি মাটি দিয়ে বাঁধানো পুকুর পাড়ে!

আমাদের কোয়ার্টারের চারদিকে গাছ শুধু গাছ, এক পাশে ছোট্ট খেলার মাঠ- সবুজ ঘাসে ঢাকা, অন্য পাশে বাঁশ-কঞ্চি ঘেরা ছোট্ট বাগান। মাটির আলবাল ঘেরা লতানো লাউ, উঠে গেছে ডাল ধরে ছাদে, তার সাদা সাদা ফুল। ছোট ছোট নলিপথের ধারে সবুজ টমেটো, খাল দিয়ে কুলকুল জলধারা, পেঁপে গাছে লটকানো ছেঁড়া ঘুড়ি। ডট পেনে লেখা, 'আমাকে যে পাবে, তাকে দুই টাকা দেওয়া হবে'- ঠিকানা নীচে লেখা। ছোট্ট আমি কখনও পাইনি অক্ষত ঠিকানা কোনদিনও। না-পাওয়ার বেদনা তাই কত-কতদিন কুরে খেত ছোট্ট হৃদয়। ঐ দু’ পয়সা যদি কোনদিন পেত তাহলে নফরডাঙার মেলায় নিশ্চয়ই কিনে খেত ১ পয়সার ঘুগনি আর এক পয়সায় পাঁচটি 'মামার্স চাটনি'- প্যাকেটের ভেতরে পেত নিশ্চয়ই কামান কিংবা বন্দুক! কোয়ার্টার থেকে একটু দূরে, রেল লাইন ক্রস করলেই শাল বন আর ঝোপঝাড় ওখানে কাঁটাঝোপের ডালে ডালে ব্যাচ, বনকুল। আশ্চর্য স্বাদের পিয়াল ফল- আশ্চর্য, রংটি যেমন সোনালি কালচে তেমনি স্বাদটিও অম্লমধুর। হায়, পৃথিবী তার বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে ওর নরম শিকড়। কিন্তু এখনও ওর সবুজ পাতার ছায়া তার স্নিগ্ধ আবেশ, কাঁটা ঝোপের হালকা আঁচড় হঠাৎ দুপুর নির্জনে কিংবা বৃষ্টি মেদুর একাকী বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বেশ অনুভব করি। ভাবি, শরীর ছাড়িয়ে সেই ছোট্ট আমিটা লুটোপুটি খাচ্ছে মাঞ্জা দেওয়া সুতোর লাটাই ধরে কিংবা গাছের ডালে আটকে যাওয়া ঘুড়ির লেজ ধরার জন্য লাফাচ্ছি তো লাফাচ্ছি আর শিশু বান্ধবী দু’ হাতে তালি দিয়ে লাফাতে লাফাতে বলছে, 'কেমনটি ধরতে পারে না, ধরতে পারে না...'

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)