বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/প্রবন্ধ/২য় বর্ষ/৬ষ্ঠ/যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা/২১শে আষাঢ়, ১৪৩১
যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা | প্রবন্ধ
তন্ময় কবিরাজ
নবারুণের কাছে কবিতা
"কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় উঠুক। কবি জানেন, সাহিত্যকে সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চলবে না। মানুষের বিপদে কবিতাকেই পাশে থাকতে হবে।"
"অন্ধকারে জন্ম
তোর / দেখেও যাবি অন্ধকার / অন্ধকারে মৃত্যু হবে / অন্ধকারে জন্ম যার।" নবারুণ
ভট্টাচার্যের এই কথাগুলোই বলে দেয়, রাষ্ট্রশাসনের সামনে মানুষ কত অসহায়। গণতন্ত্রের
দোহাই দিয়ে প্রহসন চলছে। চারদিকে দুর্নীতি। মানুষ শুধু মিথ্যা স্বপ্নের দিনবদলের
আশায় পরিবর্তন
চাইছে। বাস্তবে কিন্তু রং বদল হলেও শাসকের চরিত্র বদল হয় না, ইতিহাস
সে কথাই বলে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার। তাঁদের সচেতন করতে হবে। কবি
সাহিত্যিক তথা বুদ্ধিজীবীদের কাঁধে সেই দায়িত্ব। তাঁদের লেখায় থাকবে প্রতিবাদ।
অথচ সময় বলছে, সেইসব সচেতন বুদ্ধিজীবীরা আর মানুষের পাশে নেই। বরং ওরা-আমরা
রাজনীতির বিভাজন করে তাঁরা শাসককেই সমর্থন করেছে। কবি নবারুণ ভট্টাচার্য্য
লিখেছিলেন, "কবিতা এখনই লেখার সময়।" কবি নবারুণের কাছে, কবিতা জ্ঞানের
বিলাসিতা নয়। কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় উঠুক। কবি জানেন, সাহিত্যকে সমাজ থেকে মুখ
ফিরিয়ে নিলে চলবে না। মানুষের বিপদে কবিতাকেই পাশে থাকতে হবে। সময়ের কালবেলাতে
কবি লেখেন, "এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না।" কবি নবারুণ
ভট্টাচার্য জীবনকে দেখেছেন কাছ থেকে। রাজনীতি, শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্ব
মানচিত্রের পট পরিবর্তন তাঁর মনোজগতকে আন্দোলিত করেছিল। তিনি পলাতক হতে পারেননি, পদাতিক
কবির মতো সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার সমব্যথী হয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, "আমি
সেই মানুষ / যার কাঁধে সূর্য ডুবে যায়।” সূর্য নেহাতই সুখের মেটাফোর। শেকসপিয়রের
সনেটের চিরন্তন সত্যের প্রতিফলন নবারুণের কবিতায়। মৌলিক পার্থক্য যেখানে
এলিজাবেথের সময়ে ইচ্ছে - সময়ের দ্বন্দ্বে ইচ্ছে পরাজিত, সেখানে এখন শাসকের কাছে
পরাস্ত নাগরিক সুখ। কবি অভিমানী নন, বরং তীব্র ঘৃণা শাসকের কাছে। নিজেকে প্রকাশ
করতে না পারার যন্ত্রণা তিনি বয়ে বেড়ান। কবি লেখেন, "মূষিক কবি, শৃগাল কবি
ওড়ায় ন্যাড়া পুচ্ছ।" কবির কলমে থাকা উচিত মেরুদণ্ড, শব্দে তাঁর সততার
অহংকার। ভীতু, চালক হলে সে কবিতার মূল্যবোধ থাকে না। কবি তাই আক্ষেপ প্রকাশ
করেছেন। কবিরা সাহস হারিয়ে ফেলছেন। কবিতার শক্তিতে শাসক ভয় পায়। অ্যাডনিশের মতো
কবিদের ক্ষমতা আজও সমান ভাবে স্বীকৃত। কবিতা নির্ভীক। অনেকেই সত্যকে সহজভাবে বলতে
না পারায় কবি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে লেখেন, "এই দেশে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ।"
কবি মিল্টনের কথা মনে পড়ে যায়। সাহিত্য বেঁচে থাকবে সমাজের দলিল হয়ে। সাহিত্যের
উপর ভরসা করেই ইতিহাস লেখা হয়। তাই কবি সাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতা আরো বেশি। কিন্তু
বর্তমান সময়ে তার পালন করা হচ্ছে না। শাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে তাঁরা সত্যকে
বিকৃত করছে, বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের আবেগ। কবি জানেন, নিরপেক্ষ মানসিকতার
জন্ম হচ্ছে না। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কবিতা। আর্থিক সুরক্ষার আশায় কবিতা আজ
শাসকের বাসর ঘরে। শাসক স্থির করবে, কবিতার বিষয়, শব্দের অবস্থান, উপমার
স্বাধীনতা। কবি লেখেন, "আমি একটা ইতরের দেশে বাস করি / এখানে বণিকেরা / লেখকদের
উদ্ভাবন করে / এবং লেখকরা উদ্ভাবিত হয়।" বণিক আর লেখক একই সারিতে হবার কারণে
ক্ষতি হচ্ছে সৃষ্টির। ধনতন্ত্রে কায়েম হচ্ছে কবিতা। কর্পোরেটে কবিতার সাদা কালো
অক্ষর, মুক্ত চিন্তা ক্রমশ কমছে। পরিবর্তে কর্পোরেট আর প্রযুক্তির হাতছানি। একমুখী
চিন্তায় কবিতা আটকে পড়েছে। এত আন্দোলন, এত ঘটনা তবু কবিরা নির্বাক। তাঁরা পথে
নামার আহ্বান জানান না। একদিন কবি শঙ্খ ঘোষ যে দায়িত্ব পালন করতেন আজ সেই
দায়িত্ব পালনের লোকের অভাব। কবি তাই লেখেন, "সে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও
কেরানি / প্রকাশ্যে পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না / আমি তাকে ঘৃণা করি।" কবি
নবারুণ ভট্টাচার্য কবিতার শব্দ ছন্দ অপেক্ষায় বক্তব্যকে বেশি জোর দিয়েছেন, যাতে
তাঁর সরল বক্তব্য সবাই বুঝতে পারে। কবিতাকে বোঝার জন্য উচ্চশিক্ষিত হবার দরকার
নেই, শুধু যদি প্রাথমিক শিক্ষা আর বোধের জানালা খোলা থাকে তাহলেই কবিতাকে বোঝা
যায়। কবি নবারুণ ভট্টাচার্য্য মলয় রায়চৌধুরী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সমর
সেনের দলের লোক। তিনি কবিতায় বিলাসী হতে চাননি। তাঁর কবিতা শোষণের বিরুদ্ধে স্লোগান,
পাশে থাকার আশ্বাস। কবি জানেন, একসময় শাসকের কোনো বিরোধী দল থাকবে না। গণতন্ত্রের
ভেতর জন্ম নেবে একনায়কতন্ত্র। সরকার নিশ্চিন্ত কারণ প্রতিবাদ করার মানুষ হারিয়ে
যাচ্ছে। সবাই শাসকের দলদাস। কবি লেখেন, "যে দেশের বুদ্ধিজীবী অধ্যুষিত সরকার
/ শীতের ইথারের মধ্যে / গরিব মানুষের ঘর ভেঙে দেয় /... নতুন কাল্পনিক রাস্তা
বানাবার গল্প শুনি।" কবি নবারুণ ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠান বিরোধী, তিনি সজাগ।
সাহিত্য জীবনে তিনি সাহিত্যপত্র, ভাষাবন্ধন পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তিনি ব্রিটিশ
কবি টি এস এলিয়টের মতো সংশয়ী নন, বরং বাস্তববাদী। বাঁচতে গেলে ভাঙতে হবে, একটা
বদল দরকার মানুষের জন্য। তিনি জানেন, কেউ সামনে আসবে না। শাসকের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়াবার লোক নেই। তাই সমসাময়িক কবিদের উপর তিনি বিশ্বাস হারান। তিনি বলেন, আন্দোলন
করতে হলে আরও প্রত্যয়ী হতে হবে। শাসকের পায়ে ডিগবাজি খেলে মানুষের সুদিন ফিরবে
না। তিনি বলেন, প্রশ্ন তুলতে। অন্যায়ের জবাব চান তিনি। তিনি লেখেন, "আমার
ওপরে অনেক অত্যাচার করতে হবে / এত অত্যাচার করার ক্ষমতা দুর্ভাগ্যবশত / কোনো শোষক,
নিপীড়ক বা রাষ্ট্রমেশিন / এখনও জানে না / যখন জানবে / তখন আমার প্রশ্নের সংখ্যাও
অনেক বেড়ে যাবে।" মানুষের উপর ভরসা রাখেন তিনি। কবি জানেন, মানুষ একজোট হলে
পরাজিত হবে শাসক। যাঁরাই প্রতিবাদ করবে তাঁদেরই বিপদ। শুধু প্রতিবাদ করে আজ কত
মানুষ জেলে। কবি সে খবরও রাখেন। তাই তাঁর কবিতা গর্জে উঠে, "জেলখানাতে স্বপ্ন
আটক / একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকে বিঁধবে কবে /... একটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে
মাতাল করে ফুটবে কবে / সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।" কবি জানেন
, শেষ কথা বলবে মানুষ। এদেশের মানুষ অসহায়, তারা কাজ করে নগরে প্রান্তরে। মানুষ
শেষ হয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে। কবা আওনের "স্ট্রেঞ্জ মিটিং" কবিতার পরিবেশ
আজ। চারদিকে আয়রনী চলছে। কবি তাই আক্ষেপ করেন কবিতায়, "আমার ভালোবাসায় যে
নিজেকে উৎসর্গ করেছিল / সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করেছে /...তার আঙুলে লুকানো নরম
রক্ত / সাদা গলা।"
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment