বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১
চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ছোটগল্প
পারমিতা চ্যাটার্জি
বসন্তের বাতাস
"বিয়ের পর প্রথম দু-তিন বছর তো নিলয়ের আদর-ভালবাসায় অস্থির হয়ে যেত। সুপ্রতীককে কেন্দ্র করে সেই দূরত্ব শুরু হল। ঝিলিক হবার পর তো বিছানাও আলাদা করে নিয়েছিল। স্টাডিতেই ঘুমোত।"
খাওয়ার টেবিলের ঠিক সামনে বারন্দায়
দাঁড়িয়ে অনুমিতা গুণগুণ করে গান গাইছিল— ঘরেতে ভ্রমর এল গুণগুণিয়ে…
নিলয় অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসে বলল, তোমার ফুলে ভ্রমর এসেছে বুছি?
নিলয় অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসে বলল, তোমার ফুলে ভ্রমর এসেছে বুছি?
চমকে উঠল অনুমিতা, কোনরকমে বলল, হ্যাঁ কিছু বললে?
একটু ব্যাঙ্গাত্মক হাসি
হেসে বলল, তোমার
মনের ভ্রমরের গান শুনে তো আমার পেট ভরাবে না, তা ব্রেকফাস্ট
কি রেডি হয়েছে না কি আজ গান শুনেই…?
অনুমিতা বলল, সবই তো রেডি হয়ে গেছে,
বলে এক প্লেট ধোঁয়া ওঠা পাস্তা নিলয়ের সামনে ধরে দিল। তারপর লাঞ্চ
বক্স আর কফির ফ্লাক্স ড্রাইভার শঙ্করকে দিয়ে দিল। নিলয় দেখল দুটো কফির মাগ নিয়ে
অনুমিতা বাবা-মায়ের ঘরের দিকে যাচ্ছে। একটু যেন খারাপই লাগল
তার কী যে তার হয়েছে কে জানে? অনুকে
গান গাইতে দেখলেই যেন তার মনটা জ্বলে ওঠে, সব কাজ সেরেই তো মেয়েটা
দাঁড়িয়ে একটু গুণগুণ করছিল, নিলয় দেখল, অনুর বাবা-মায়ের ঘর থেকে বেরোতে একটু সময় লাগছে,
তারপর নিজের মনেই ভাবল, শুধু তো কফি দেওয়া নয় দুজন
অসুস্থ মানুষের যাবতীয় ওষুধ সব খাইয়ে আসে, একটা ঠিকে কাজের
লোক ওকে সাহায্য করে, মানে ওই বাসন মাজা, মশলা বেটে দেওয়া এইসব আর কী? তাদের চার বছরের মেয়ে
ঝিলিককে এবার লরেটোতে ভর্তি করান হয়েছে, তাই সাশ্রয়ের জন্য রান্নার
লোক ছাড়িয়ে নিজেই সব কাজ করে, নিজের গানটা ছেড়ে দিয়ে হাত
খরচের জন্য গান শেখাবার কাজ নিয়েছে।
খরচ তো সংসারের কম নয় বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন,
তাদের ওষুধ খরচাই তো প্রচুর, অনু নিজেও
মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিএড পাশ করেছে, অপেক্ষায় আছে ঝিলিকের
আর একটু বড় হওয়ার, তারপরই স্কুলে চাকরির চেষ্টা করবে।
অনু বাবা-মায়ের ঘর থেকে সব কাজ সেরে
আসার সময় দেখল ওর চোখদুটো লাল, হয়তো কাঁদছিল, আজ নারী দিবস আর সে স্ত্রীর একটু গান গাওয়ার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। সত্যি
সে দিনদিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে।
অনুমিতা কাছে এসে বলল, পাস্তাটা ভাল হয়নি?
হ্যাঁ! চমক ভাঙল নিলয়ের, বলল, খুব
ভাল হয়েছে, তুমিও তোমার খাবারটা নিয়ে এস-না একসাথে খাই। অনু নিঃশব্দে খাবার নিয়ে এসে খেতে আরম্ভ করল। নিলয় বলল,
তুমি তো ঝিলিকের থেকেও কম খাবার নিয়েছ, সারাদিনের
এত পরিশ্রম আর এইটুকু খেলে তো শরীর ভেঙে যাবে, ম্লান হেসে
অনু বলল, কিছু হবে না, আমি বেশি খেতে পারি
না।
বহুদিন পর নিলয়ের মুখে
স্নেহের কথা শুনে অনুমিতার চোখে জল এসে গেল। বিয়ের পর গানের ক্লাস থেকে আনতে যাবার
সময় নিলয় তার সাথে মাঝে মাঝেই সুপ্রতীককে দেখেছিল, তারপর ধরেই নিয়েছিল
সুপ্রতীকের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক আছে। বিয়ের পর প্রথম দু-তিন বছর তো নিলয়ের আদর-ভালবাসায় অস্থির হয়ে যেত।
সুপ্রতীককে কেন্দ্র করে সেই দূরত্ব শুরু হল। ঝিলিক হবার পর তো বিছানাও আলাদা করে
নিয়েছিল। স্টাডিতেই ঘুমোত।
নিলয় আজ অফিসে যাওয়ার সময়
ভাবছিল আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজকের দিনেও মেয়েটাকে কাঁদালাম। কী আধুনিক সে! নিজেকেই ধিক্কার
দিল। আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে অনুকে ফোন করে বলে দিল রান্না না করতে। অনু খুব
চাইনিজ ভালবাসত, রাতে সবার জন্য চাইনিজ খাবার আর অনুর জন্য তার
প্রিয় একগোছা রজনিগন্ধার স্তবক আর মোটা জুঁই ফুলের মালা নিয়ে
এসে ঘরে ডাকল, অনুমিতা ঘরে আসার সাথে সাথে তাকে কাছে ডেকে
হাতে ফুলের স্তবক দিয়ে খোঁপায় মালাটা জড়িয়ে দিয়ে দুহাতের তালুতে ওর মুখটা তুলে ধরে
বলল— happy women's day। কপালে একটা চুম্বন দিল বহুদিন পর।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment