বাতায়ন/রং/ধারাবাহিক উপন্যাস/২য় বর্ষ/৩২তম
সংখ্যা/২৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১
রং
| ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা চ্যাটার্জি
শেষ
থেকে শুরু
[পর্ব – ১৮]
"দুধারে কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাল মাটির রাস্তা - হঠাৎ সজল গান গেয়ে উঠল, আরে লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা / রাঙা মাটির দ্যাশে যা, হিথা তরে মানাইতেসারে আর এক্কেরে মানাইতেসারে। সজল এখনও খুব রোমান্টিক আছে।"
পূর্বানুবৃত্তি পরের দিন রাহুল
ও সুচরিতা দুজনে দুজনের জন্য বিয়ের বিশেষ জামাকাপড় কিনল। রাহুল বলল তার মনে হত এ কাকে আমি ভালবাসতে গিয়েছিলাম! তারপর বিদেশ চলে
যাই, প্রাণপাত
করে পড়াশোনা করে এ জায়গায় এসেছি, বিশ্বভারতীতে তোমাকে দেখে আনন্দে মন ভরে গিয়েছিল, কিন্তু বলতে
সাহস পাচ্ছিলাম না, হতেও
তো পারে ততদিনে তুমি অন্য কাউকে কথা দিয়েছ। তারপর…
-না মনকলি তুই ভুল বুঝছিস, প্রবীরের সাথে কথা হয়েছে আমার, দেখ ও তো
তোকে সমানে ট্রিটমেন্ট করিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছিল তাহলে তুই এত নেগেটিভ হয়ে
যাচ্ছিস কেন? ও
বলল, তুই
নাকি হঠাৎ করে একরাতের মধ্যে ওকে জানিয়ে পরের দিন ভোরবেলা চলে এসেছিলি? পুরুলিয়ার
ঠিকানাটা পর্যন্ত ওকে দিয়ে আসিসনি? এটা খুব খারাপ করেছিস।
-হ্যাঁ আমাকে তো তোমরা সবাই দোষ দেবে, আমি তো খুব
খারাপ মেয়ে।
-না তোকে কেউ খারাপ মেয়ে বলছে না, দেখ তোর খবর পাওয়ার জন্য প্রবীর যে কী পরিমাণ উদ্বিগ্ন ছিল তা আমরা জানি, আমি আসছি তো, একদম চিন্তা
করিস না।
যেদিন
প্রবীর আর সজল এসে পুরুলিয়া পৌঁছল সেদিন রাহুল আর সুচরিতা কলকাতায়। ওরা নিজেরাই একটা হোটেল বুক করে এসেছিল। হোটেলে চেক-আপ
করে ফ্রেশ হয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ওরা বলরামপুর কলেজে গেল
মনকলিকে ডাকতে। মনকলিকে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠালেন।
মনকলি এসে এতদিন পর ওর যৌবনের প্রিয় মানুষ সজলকে দেখে একমুখ হেসে সজলকে জড়িয়ে ধরে
বলল,
-তুমি সত্যি
আমার জীবনের বিপদের দিনে এসে দাঁড়ালে, আমি খুব কৃতজ্ঞ তোমার কাছে আর তোমার
কাছেও প্রবীর, কেন
এত কষ্ট করলে তোমরা,
আমি তো বলছিলাম আমি নিজেই চলে যেতে পারব, কেন এলে প্রবীর দায়বদ্ধতায়?
-না, ভালবাসায়, সবার
ভালবাসার প্রকাশ তো একরকম হয় না মনকলি, আমি কোনদিনই মুখে বেশি কথা বলতে পারি
না, প্রকাশটা
আমার কম তাই বলে এই না যে তোমায় ভালবাসি না বা তোমার এতবড় অসুখের ভার নিতে নিতে
আমি ক্লান্ত, এসবই
তোমার ভ্রান্ত ধারণা। তোমার জন্য বম্বেতে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে আমি
সব বুকিং করে রেখেছি কিন্তু সজল বলছে, চল আমরা বাইরে
নিয়ে যাই ওখানে চিকিৎসা অনেক ভাল হবে।
মনকলি বলল,
-সে তো অনেক খরচ।
প্রবীর খুব
স্নেহভালবাসা নিয়ে এখন ঘাড় অবধি বড় হওয়া চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,
-এই তো কী সুন্দর চুল হয়ে গেছে, আরও কিছুদিন
পরে বড় চুল হয়ে যাবে,
আর কেমো দিতেও হয়নি তোমাকে, আমার তো মনে হয় তুমি অনেকটা সুস্থর দিকে, টাকার জন্য
ভেবো না একদম, অনেকদিন
তো ছিলাম ওখানে, সজল
বলছিল ও পৌঁছে আমার জন্য চেষ্টা করবে তাছাড়া যাব ভাবছি একসাথে।
-মানে সজলদার সাথে?
-হ্যাঁ তোমার সজলদার সাথে, ওরা পুরুলিয়ার রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। দুধারে কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাল মাটির
রাস্তা - হঠাৎ সজল গান গেয়ে উঠল, আরে লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা / রাঙা
মাটির দ্যাশে যা, হিথা
তরে মানাইতেসারে আর এক্কেরে মানাইতেসারে। সজল এখনও খুব রোমান্টিক আছে।
-হ্যাঁ তাই তো দেখছি। আচ্ছা তুমি যে আমার পিছনে এত খরচ করবে, কীসের ভরসায়?
-আরে তোমার দেখি আমার ওপর কোন ভরসা নেই।
-আমি ওখানে কত বছর ছিলাম বল তো? সেগুলো কাজে লাগাব প্রথমে তারপর চলো কাজ ঠিক পেয়ে যাব দেখবে, ওখনাকার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট
পোস্টডক্টরেট সব করেছি,
ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে এতদিন পড়ালাম আর এখন কাজ পাব না? সজল আমার
ডকুমেন্টস সব জমা দিয়ে আমাদের দুজনের কাজের জায়গায় মোটামুটি সব ফাইনাল করে এসেছে।
এদিকে
কলকাতায় এসে রাহুলের দিদি-বউদি ওদের নিয়ে চুটিয়ে শপিং করছে, রাহুল বলছে,
-তোমরা কী আরম্ভ করলে বল তো? জানো তো আমি খুব সিম্পল নীতিতে
বিশ্বাসী আর ওই সিম্পলভাবেই বিয়ে করতে চাই।
মনে মনে
এদিকে ভাবছে সজল হয়তো এসে গেছে এইসময় সে এখানে ওদের জন্য ওখানে কোন গেস্টহাউসও ঠিক
করে আসিনি, কী
ভাববে সব কে জানে। তার ওপর মনকলি আছে
সজলকে বলে যদি কোনরকমে মনকলিকে বিদেশে পাঠানো যায় তাহলে হয়তো এখুনি জীবনাশঙ্কা নাও থাকতে পারে। রাহুল যেন নিজেকে নিজেই
প্রশ্ন করছে, তুমি
তো ওকে আর ভালবাসো না,
তবে ওর ভালমন্দ নিয়ে অত চিন্তা করছ কেন? নিজেকেই
উত্তর দিচ্ছে কারুর জীবনের সাথে ভালবাসার কী সম্পর্ক? এ কথা সত্যি যে মনকলি
অসুস্থ, সজলের
ভালবাসা সুচরিতার সাথে সে পরিণয়ে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে কারণ সুচরিতা চিরকাল
একনিষ্ঠভাবে তার বউয়াদাকে ভালবেসে এসেছে। শান্তিনিকেতন থাকাকালীন দিনগুলোর কথা মনে
পড়ে, কী
যত্ন করে তার জন্য তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে নিয়ে আসত, সামনে বসে কত ভালবেসে তাকে খাওয়াত। নিজের অজান্তেই সুচরিতার ভালবাসার
জালে জড়িয়ে পড়ছিল,
কিন্তু ওই কুৎসিত অপমানের স্মৃতি তার মনটাকে দাবিয়ে দিত, এ ভালবাসাও
যদি ছিঁড়ে যায়। তাই আচমকাই বলরামপুর কলেজের ভাইস
প্রিন্সিপালের পোস্টটা খালি দেখে চলে এসেছিল। আসার সময় সুচরিতা তার মনের কথা জানিয়ে ছিল। সে
আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল,
যদি আবার অপমানিত হয়, কিন্তু
একবারও মনে হয়নি যে মেয়ে এতদিন ধরে এত যত্ন করতে পারে সে কী করে অত নিষ্ঠুর হবে! একটা বাজে মিথ্যে কথা বলে চলে
এসেছিল। একবারও মনে হয়নি তার এই ব্যবহারে সুচরিতা কতটা কষ্ট পাবে! যাইহোক শেষ
পর্যন্ত আর পারেনি ছুটে চলে এসেছিল সুচরিতার কাছে।
সুচরিতা
তাদের বাপের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, তার মনে হল
আজ তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তার বাপি বা মা কেউ ছুটে আসবে না। মা জড়িয়ে ধরে
বলবে না কী চেহারা করেছিস বল তো? আর কতদিন বাইরে বাইরে থাকবি? বাবা তার
স্নেহমাখা হাতদুটো
মাথায় দিয়ে বলতেন আরে আগে মেয়েটাকে ঢুকতে দাও একটু লেবুর শরবত করে দাও। নাহ্ তাঁরা কেউ নেই। তাঁরা তাকে একলা করে চলে গেছে। আজ তার জীবনের পরম শুভদিনে
তাঁরা থাকবে না।
বাড়িঘর পরিষ্কার করে বাসন্তিদি তাকে একটু সেদ্ধভাত ফুটিয়ে দিল। মাকে দেখেছে সে জার্নি করে
এলে অনেক কিছু খেতে পারত না, মাছ মাংস যা কিছু রান্না তোলা থাকত
রাতের জন্য, পরের
দিনের জন্য। চান করে এসে একটু সেদ্ধ ভাত খেয়ে নিল। মনে মনে একটা অভিমান হল, বাবা্ উনি এসে বাড়ির লোকেদের সাথে এতই মেতে গেলেন
যে একবার
ফোন করে কোন খবর নিতে পারলেন না। আলমারি খুলে বাবা আর মায়ের চিঠি পেল বাবার রেখে
যাওয়া পাসবই
চেকবইয়ের সাথে। তাঁরা যখন মারা যান সুচরিতা ইউকে
গিয়েছিল, ইচ্ছে
ছিল পিএইচডিটা ওখান থেকে করবে, মাত্র দুবছর যেতে-না-যেতে বাবার খবর পায় বাবা হসপিটালে ভর্তি। সে যখন এসে পৌছাল তখনই বাবা
শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। বাপি হয়তো তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। তারপর কিছুদিন
কলকাতার কলেজে চাকরি করেছিল। ঠিক করেছিল এবার আর বাইরে যাবে না মাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকবে। সে
যোগমায়া দেবীতে চাকরি নিল। তাও তো পারল না, মাও চলে গেলেন। একদিন হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। তারপরেই চলে গেল বিশ্বভারতীতে একটা
ছোট্ট আশা নিয়ে যদি দেখা পাই, হ্যাঁ পাওয়া গেল, তার ভাবনাই মিলে গেল।
একটু বিশ্রাম করে
নিয়ে মা-বাপির আলমারিটা খুলল, বাপি বলে
গিয়েছিলেন গোলাপি
ফাইলে তিনটে এফডি সার্টিফিকেট আছে, মোট বারো লক্ষ টাকা, তার সাথে
সেভিংস অ্যাকাউন্টের পাশবই আর চেকবই। সুচরিতা সব গুছিয়ে নিয়ে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রওনা হবে তখন মহারাজের ফোন এল। সুচরিতা অভিমানী গলায় বলল,
-এতক্ষণে সময়
হল মহারাজের ফোন করার?
-আরে আর বলো কেন? আসার পর থেকে আমাকে ছাড়ছে না, গল্প শুনবে সবাই কী করে কী হল? তোমার সাথে বিয়ে হচ্ছে শুনে তো ভীষণ খুশি সবাই। দুই দিদি-বউদিরা সবাই মিলে বাজার করতে
চলে গেল, তোমার
মামারা সবাই ছিলেন, দুজন
পিসি ছিলেন জ্যাঠতুতো দাদারা এরা বলছে সবাইকে খবর দিতে, তুমি সবার
ফোন নাম্বার জানো তো?
-হ্যাঁ জানি তো, আমাকে সবাই খুব ভালবাসে, মাসি, পিসিরা তো প্রায় ফোন করেন, মামারাও ফোন করেন, বড়দি মানে
আমার মা তার একটাই মেয়ে আমি, মামারাও আমাকে খুব ভালবাসে।
-দিদি জিজ্ঞেস করছে মোট কজন? ওরা শাড়ি কিনবে।
-বাবা অতসব করতে হবে না, তুমি বারণ করো তাড়াতাড়ি।
-তোমার কী মনে হয় আমি বারণ করিনি, অনেকবার
বারণ করেছি, কেউ
কথা শুনলে তো!
-আচ্ছা ছাড়ো এবার সবাইকে ফোন করতে হবে, কাল সকালে ব্যাংকে যেতে হবে তারপর বাজার যেতে হবে।
-কেন বাজারে কী করবে?
-বারে আমি শাড়ি কিনব না? তোমার দিদি-বউদিদিদের জন্য?
-তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।
-মানে?
-মানে,
তুমি একলা কী করে সব করবে? দেখি তাহলে
এদের হাত থেকে একটু রিলিফ নিয়ে তোমার কাছে যদি যেতে পারি, অনেকক্ষণ
দেখিনি তোমাকে।
-আহা কত প্রেম একেবারে।
-প্রেম নেই বলছ?
-জানি না,
আছে কী নেই আমি কী করে বলব?
-ঠিক আছে বিয়েটা হোক তারপর দেখিয়ে দেব প্রেম আছে কী
নেই, আর
এরা তো ঠিক করেছে ওখানে বিয়ের পর এখানে এসে একটা রিসেপশন পার্টি
দেবে।
-ওরে বাবা কী মুশকিল।
-এই শোনো না এদিকে ওখানে সজল আর মনকলির স্বামী পৌঁছে
গেছে, সজলকে
তো জানো! ফোন
ধরেই গালাগাল দিতে শুরু করল, ও আসছে শুনেও আমরা চলে গেলাম, একটা হোটেল পর্যন্ত ঠিক করে আসিনি।
-সত্যি এটা খুব ভুল হয়ে গেছে।
-জানো সজল বলল, মনকলি আর ওর স্বামীর সাথে ভাব হয়ে গেছে, ওদেশে নিয়ে
যাবে, আজকাল
চিকিৎসা শাস্ত্র
অনেক উন্নত, ওখানে
গিয়ে আরও উন্নত মানের ট্রিটমেন্ট পাবে। ওর শরীরও ভালর দিকে যাবে, আশা করি
সংসারটা মাথা ঠান্ডা করে ভাল করে করুক। সজল বলল, তুমি যা বল
তাই বল তোমার বিয়ের দিন আমি কিন্তু ওই একটাই গান গাইব।
-কোন গান?
‘তুই ভুলে গেছিস?
হয়তো তোমার জন্য,
এই গানটা, বলেই
বলল, আমি
খুব খুশি হয়েছি রে, সুচরিতার
গভীর ভালবাসা এতদিনে পূর্ণতা পাচ্ছে।’ তোমার আত্মীয়দের
ফোনগুলো করে নাও।
-ওটা খুব ভুল হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ ভুল তো হয়েছে, এবার ছাড়ো ফোনটা, আমি ফোনগুলো
করতে আরম্ভ করি, তারপর
যদি সময় থাকে তবে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে যাব।
-তুমি কি একলা যাবে নাকি?
-আমি কি বাচ্চা নাকি?
-হ্যাঁ বাচ্চাই তো একেবারেই বাচ্চা।
No comments:
Post a Comment