বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/যুগলবন্দি/হলদে খাম/২য় বর্ষ/৯ম/অমিতাভ গুপ্ত সংখ্যা/১৮ই শ্রাবণ, ১৪৩১
অমিতাভ গুপ্ত সংখ্যা | দোলাচল | যুগলবন্দি | জয়িতা বসাক ও অজয় দেবনাথ
জয়িতা বসাক
দোলাচল
"বাস্তবতার সীমারেখা অতিক্রম করে তুমি এক অনাকাঙ্ক্ষিত সময়কে ধরতে চাইছ। তাই তোমার অন্দরমহলের নিভৃত একান্ত কক্ষে, ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো অনবরত দুলে চলেছে একটা দোলাচল। তবু, আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, কেন এই দোলাচল?"
"একেবারেই না। মন না মিললে একটা সম্পর্ক থেকে মনের মতো অন্য সম্পর্কের মাধ্যমে মন এবং মননকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা। সামাজিক বৈধতা না থাকলেও। সমাজের শৃঙ্খল সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে নয় বরং প্রকৃত সৃষ্টি সমাজকে দিশা দেখিয়ে আলোকিত করে।"
"একেবারেই না। মন না মিললে একটা সম্পর্ক থেকে মনের মতো অন্য সম্পর্কের মাধ্যমে মন এবং মননকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা। সামাজিক বৈধতা না থাকলেও। সমাজের শৃঙ্খল সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে নয় বরং প্রকৃত সৃষ্টি সমাজকে দিশা দেখিয়ে আলোকিত করে।"
সুধী মৃণাল,
কেমন আছ? বেশ কিছু দিন
তোমাকে আর চিঠি লিখে উঠতে পারছি না। হয়তো সময়কে এখন আর আগের মতো পোষ মানাতে পারছি
না। আর চিঠি লেখাও তো এখন একদম উঠে গেছে। বিশেষত নব্বইয়ের দশকের শেষে কম্পিউটার
আসার পর থেকেই। অথচ দেখ, সেই কবে ১৯৬১ সালে, জাদু-বাস্তবতার জাদুকর
"গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ" রচিত "No one writes to
Colonel" উপন্যাসে, এই চিঠি না লেখার কথাগুলো কী অসাধারণ দক্ষতায় উনি লিখে
গেছেন! ভাবতে সত্যিই বিস্ময় লাগে, তাই না!
তাই তো আজ তোমাকে
চিঠিটা লিখব বলে কোনোক্রমে ভোরের পায়ে বেঁধে দিলাম একচিলতে সুতো আর তারপর পড়ার
টেবিলে এসে বসে খুলে দিলাম পুবের বাতায়ন।
দেখছি ক্রমশ লাল হয়ে
উঠছে আকাশ। অন্ধকার সরাতে সরাতে একটা চনমনে আলোর গোলা চকিতে উঠে এসে পুব আকাশে
উঁকিঝুঁকি মারছে। টকটকে লাল আলোয় ঢেকে যাচ্ছে সমস্ত চরাচর। তবু যেন মনে হচ্ছে ওই
লালরংটার মধ্যে এখন আর আগের মতো প্রাণবন্ত উদ্দামতা নেই। সময়ের যন্ত্রণা সারাগায়ে
মাখতে মাখতে সেই টকটকে লালরংটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দগদগে ক্ষতে। আমি টের
পাচ্ছি, তবু চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে উঠতে পারছি না। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ একটা দোলাচল
আবর্তিত হচ্ছে। দোলাচল নাকি অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে পিছিয়ে আসছি বারেবারে!
আগের চিঠিতে তুমি
লিখেছ, তোমার মধ্যেও ইদানিং একটা দোলাচল আবর্তিত হচ্ছে, তবে সেটা হয়তো প্রতিবাদের
নয়, হয়তো কল্পনার। কেন হচ্ছে, তুমি কিছুতেই বুঝতে পারছ না। হয়তো, বাস্তবতার
সীমারেখা অতিক্রম করে তুমি এক অনাকাঙ্ক্ষিত সময়কে ধরতে চাইছ। তাই তোমার অন্দরমহলের
নিভৃত একান্ত কক্ষে, ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো অনবরত দুলে চলেছে একটা দোলাচল। তবু,
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, কেন এই দোলাচল?
আসলে, দোলাচল মানে
একধরণের দ্বন্দ্ব। বলা উচিত মানসিক দ্বন্দ্ব। আর দ্বন্দ্ব মানেই অস্থিরতা অথবা
অনিশ্চয়তা। সিদ্ধান্ত না নিতে পারার সঠিক সংকল্পের অভাব। এই দ্বান্দ্বিকতার আসল
অর্থ হল, দুটি পরস্পরবিরোধী
সংঘাতজনিত প্রক্রিয়া।
তুমি জান নিশ্চয়ই, দার্শনিক হেগেল প্রথম এই তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। তাই এটি
"হেগেলিয়ান দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ" বলেই বিশেষ পরিচিত। বাস্তবে
প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মানবমনের মধ্যে 'সু' আর 'কু' এই দুয়ের মধ্যে
পরস্পর বিরোধী তর্ক অনবরত চলতে থাকে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই অস্থিরতা
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।
একটি শিশুর সঠিক বোধ
জন্মানো শুরু হয় তার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দোরগোড়ায়। বাবা-মায়ের সঠিক অনুশাসনে
শিশুটির মধ্যে ক্রমশ 'সু' এবং 'কু' ভাবনার বিষয়ভিত্তিক একটা সামগ্রিক চিত্র ধীরে
ধীরে ফুটে উঠতে থাকে। যদি শিশুটির সেই বয়স থেকেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত
নেওয়ার বুৎপত্তি জন্মায়, তবে সে চেতনায় এবং মননে আর পাঁচটি সমসাময়িক শিশুর থেকে
পৃথক হয়ে উঠবে। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে পারতপক্ষে তা সবসময় হয়ে ওঠে না।
ঠিক যেমনভাবে সদ্য
যৌবনে পা দেওয়া একটি কিশোর বা কিশোরী প্রায়শই স্থির করে উঠতে পারে না কাকে
প্রাধান্য দেবে, নিজের বর্ণময় ইচ্ছা নাকি অর্থময় পেশা। সবচেয়ে বেশি দোলাচল দেখা
যায় সম্পর্ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে। তারপর ধরো, পরিণত বয়েসে দাম্পত্যে যখন পচন ধরে
যায়, তখন অন্য সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে আমৃত্যু একটা দোলাচলে আকণ্ঠ ডুবে যায়
মানুষ। তুমি বলতে পারো, এটা কি মানসিক অবক্ষয় নয়?
আবার দেখো সেই মানসিক
অবক্ষয় এখন এমন পর্যায়ে নেমে গেছে যে, নিতান্ত মানবিক মূল্যবোধটুকু আস্তে আস্তে
হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন থেকে। মনন থেকে। চেতনা থেকে। অন্যের জিনিস কী অনায়েসেই
চুরি করে নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। নিজে এগিয়ে যাবে বলে, অন্যের পা টেনে ধরছে।
বুকের অন্তঃস্থল একবারও এর বিরোধিতা করছে না। প্রতিবাদ করছে না। এটা তো সবচেয়ে বড়
নৈতিক অধঃপতন, তাই নয় কি?
এই দেখ! দোলাচল থেকে
সরে গিয়ে আবার অন্য একটা দোলাচলে এসে পড়লাম। বস্তুত, আমরা সবসময়েই যেন একটা
দোলাচলে গেঁথে থাকি। মানসিক দ্বন্দ্ব ছাড়া কোনও মানুষই একমুহূর্ত স্থির থাকতে
পারেন না। তবে এটাও তো ঠিক, যে সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবসময় সু-ধারণার পক্ষপাতিত্ব
করেন। এবং তাই তো এখনও বিশ্বাস করি, সবশেষে শুভ চেতনার জয় হবে। ঠিক সেভাবেই, আমি
জানি তোমার সু-চেতনা, সব জাগতিক অমাবস্যা সরিয়ে একদিন পূর্ণিমার দুধেল জ্যোৎস্নায়
উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
কেন জানিনা, তোমাকে
চিঠি লিখতে বসলেই পালতোলা নৌকার মতো অজস্র ভাবনা স্রোতের অনুকূলে অবলীলায় ভেসে
আসে। আর তারপর, অন্ধকারের গিঁট খুলতে খুলতে নেমে আসবে আলোর উদ্ভাস।
ভাল থেকো সবসময়।
ইতি—
অন্তরা
ভাল থেকো সবসময়।
অন্তরা
দোলাচল | যুগলবন্দি | অজয় দেবনাথ ও জয়িতা বসাক
অজয় দেবনাথ
দোলাচল
প্রিয় অন্তরা (জ্ঞানবৃদ্ধা),
কেমন আছ? হাতে সময় নেই
বিশেষ, দু-এক কথায় আজ লিখব।
সময়ের নিয়মে সময় চলে
যায়। স্রোতের নিয়মে যেমন নদী বয়ে যায়। তারা কেউই পিছন ফিরে দেখে না, দেখার উপায়ও নেই
তাদের, তারা শুধু এগিয়ে চলতেই জানে। দুনিয়ায় একমাত্র মানুষই ব্যতিক্রম। স্মৃতি কিছুতেই
তার পিছু ছাড়ে না।
লিখেছ সবসময় ভাল থাকতে।
তুমি তো জানোই আমি সবসময় ভালই থাকি। আসলে ভাল থাকাটা মনের ব্যাপার। মনে ঔদাসীন্য এলে
খারাপ থাকার কোন বিষয় নেই, যারা পারেন না তাদের মন ভাল থাকাটা তাৎক্ষনিক। সবসময় কিছু-না-কিছুর
পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন।
তোমার কথা জেনে ভাল
লাগল, আমাকে চিঠি লিখতে বসলেই তোমার পালতোলা নৌকা স্রোতের অনুকূলে অবলীলায় ভেসে অন্ধকারের
গিঁট খোলে। কিন্তু অন্তরা তুমি যে আলোর আভাসটুকুই পছন্দ করো, আলো তো চাও না। তাই তুমি
দিন দিন রুক্ষ থেকে রুক্ষতম হয়ে যাচ্ছ। কেবলই তোমার খটখটে টিচারগিরি, জীবন-যৌবনের বিন্দুমাত্র
রসহীন।
আর সেজন্যই তোমাকে একসময়
বলেছিলাম, চলে এসো, যতদিন খুশি থাকবে, একই সঙ্গে থাকি, ইচ্ছে হলে আসবে, ইচ্ছে হলে যাবে, সম্পূর্ণ বাঁধনছাড়া। একসঙ্গে থাকার অনেক সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে অনেক। অসুবিধার কথা এখন নাহয় থাক। সুবিধার কথাই বলি। একসঙ্গে থাকলে অনেক সময় পাওয়া যায়, অখণ্ড
অবসর। তোমার টিচারগিরির পাশাপাশি রসালাপও চলবে। এলে ভাল লাগত, এলে না। ঠিক আছে।
না এসেও আমার কোনও তারতম্য হয়নি। তুমি কেমন আছ তুমিই জানো।
লিখেছ, সঙ্গী নির্বাচনের
ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি দোলাচল দেখা যায়। সেটা তো দোলাচল নয়, স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবকে
মেলানো। আর দাম্পত্যে পচনজনিত পরিস্থিতির পরবর্তী সময়ে মানসিক অবক্ষয়? একেবারেই না। মন না মিললে একটা সম্পর্ক থেকে মনের মতো অন্য সম্পর্কের মাধ্যমে মন এবং মননকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা। সামাজিক
বৈধতা না থাকলেও। সমাজের শৃঙ্খল সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে নয় বরং প্রকৃত সৃষ্টি সমাজকে
দিশা দেখিয়ে আলোকিত করে।
মৃণাল
No comments:
Post a Comment