বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/৯ম/অমিতাভ গুপ্ত সংখ্যা/১৮ই
শ্রাবণ, ১৪৩১
অমিতাভ গুপ্ত সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা দে দাস
শিল্পীর আত্মপ্রকাশ
[১ম পর্ব]
"তবে আমি আজকালকার মেয়ে আমার জীবনেও কিছু আদর্শ আছে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেয়ে আমি। সংগীতে মাস্টার্স করেছি। আমিও গান দেখাতাম, স্টেজ পারফরম্যান্স করতাম অনিমিখ হওয়ার পর সব কিছু থেকেই সরে গেলাম।"
'ডক্টর বলেছেন আমার ইমিউন সিস্টেম একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এই
একার লড়াই আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না অনিকেত। অনেক বুঝিয়েছি নিজের মনকে আর
পারলাম না বাধ্য হয়ে আজ তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। বিবাহ নামের এই সাংসারিক পুতুল
খেলা থেকে তুমি আমায় মুক্তি দাও অনিকেত! দেশ-বিদেশ জুড়ে তুমি একজন প্রথিতযশা
সাহিত্যিক। যার সংসার অপেক্ষা শিল্পের খিদে প্রবল। আর একজন কবি-সাহিত্যিকের কাছে
এমনটাই স্বাভাবিক। এই কারণে আমি তোমায় দোষ দিই না। তোমার লেখার প্রেমে পড়েই তো
তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আমি খুব ভাল করেই জানি একজন শিল্পীকে কখনই বেঁধে রাখা যায়
না। আমি কখনো তোমায় কোনো কাজে যেতে বারণ করিনি বিয়ের পর যেখানে তোমার ইচ্ছে
হয়েছে গেছ। মাসের পর মাস ফেরোনি। উপন্যাস লিখে গেছ। আমি সে নিয়ে কোনোদিন কোনো
অভিযোগ করিনি তোমায়। আমার অসুস্থতাতেও আমি তোমাকে ফোন করে বিরক্ত করিনি কখনো।
অন্যান্য স্ত্রী প্রেমিকাদের মতো তোমার কাছে সময় চাইনি কখনো। এই চার দেওয়ালের
কোণে বসে শুধু অপেক্ষা করে গেছি তোমার। কখন ফিরবে? একবার জড়িয়ে ধরবো। তোমার
গায়ের গন্ধ আমার শরীরে মেশাবো। তবে আজ আর এসব মনে হয় না। অপেক্ষারও বোধ হয় একটা
নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। যা এক্সপায়ার করে গেলে বেঁধে রাখার ইচ্ছেটাও ফুরিয়ে
যায়। এখন আমি সবার আগে একজন মা। সন্তানের জন্য বড় স্বার্থপর হয়ে উঠছি দিন দিন।
গোটা সপ্তাহ ধরে অনিমিখ টাইফয়েডে ভুগলো। সেদিন রাতে ওর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। চার
বছরের ছোট ছেলেটা বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। সেদিন রাতে আমি একরাশ শঙ্কা নিয়ে তোমাকে
ফোন করেছিলাম। তুমি ফোনের ওপার থেকে বললে, 'রথীন ডাক্তারকে ফোন করে নাও।' ব্যস এটুকুই
কথা বলে ফোনটা কেটে দিলে। পরদিন একবারও ফোন করে ওর খোঁজটুকু নিলে না। সেদিন
বিকেলবেলা দেখলাম ফেসবুকে পোস্ট করেছ তোমাদের কবি সম্মেলনের গ্রুপ ফটো। ভীষণ অবাক
হলাম তোমার বিবেকবোধ দেখে। বাবা হয়ে এত উদাসীনতা তোমার সন্তানের প্রতি! তোমার
সাহিত্য জগতের বাইরে তোমার যে স্ত্রী-সন্তান আছে এ কথা বোধ হয় আর তুমি মনেই রাখতে
চাও না।
অনিমিখ যখন জ্বরের ঘোরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল 'মা, বাবা কখন আসবে? তুমি একটা ফোন করো-না বাবাকে।' আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। বাচ্চারা অসুস্থ হলে সবার আগে তার বাবা-মাকে খোঁজে। সন্তান অসুস্থ থাকলে বাবারা কত খেলনা নিয়ে আসে যাতে তাদের মন ভাল হয়ে যায়। সন্তানের কাছে বাবা মানেই তো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ও এই বয়সে কোনোকিছুই পায় না যেটা এই বয়সের বাচ্চারা তাদের বাবাদের থেকে পায়। ও যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয় সেবারও তুমি ছিলে জলপাইগুড়ি। প্রিন্সিপালকে অনেক অনুরোধ করে ওকে স্কুলে ভর্তি করাই। ওর স্কুলের প্রতিটা কালচারাল প্রোগ্রামে তুমি কখনোই যাওনি। অন্য বন্ধুদের বাবারা আসে এই নিয়ে ওর একটা বরাবরই আক্ষেপ আছে যেটা ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে। আমি তো মা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতে পারি না। হয়তো চোখ বুজে পড়ে থাকলে তোমার মতো দায শূন্য হয়ে থেকে যাওয়া যায়। তবে এই পৃথিবীর প্রতিটা মা-ই বোধ হয় নিজের সন্তানের জন্য কড়ায় গন্ডায় সব বুঝে নেয়।
আমি তোমার অভাব যেমন বোধ করি সারাক্ষণ। আমি চাই না আমার মতো
অনিমিখও সেই অভাববোধ করুক। তোমার বাড়ি বিষয়সম্পত্তি এসব দেখার জন্য আমি তোমাকে
ভালবাসিনি শুধু তোমার কাছে একটু ভালবাসা পাবো বলেই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। বাবা
বারবার আমাদের বিয়ে নিয়ে আপত্তি করে বলতো, 'শিল্পী মানুষরা কখনোই সংসারের জন্য
হয় না। ওরা যতটা নিজেদের ভালবাসে আর কাউকে তেমন করে ভালবাসতে পারে না।' এখন বুঝতে
পারছি বাবার কথাটাই সত্যি।
‘আমি আর এভাবে থাকতে পারব না। মা-বাবার কাছে চলে যাচ্ছি। ডিভোর্স ফাইল করেছি। আমি সাহিত্যিক অনিকেত চৌধুরীর স্ত্রী হয়ে আর থাকতে চাই না। সে কারণেই এই চিঠি লেখা। আশা করি তুমি ও আপত্তি জানাবে না।'
চিঠিটা লিখে খামে ভরে অনিকেতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
পরদিন কেয়ার-টেকারের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে অনিমিখকে
নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে। সংসার ছেড়ে চলে আসার কী যে যন্ত্রণা আজ টের
পাচ্ছি। কেন মেয়েরা দিনের পর দিন মুখ বুজে পড়ে থাকে শ্বশুরবাড়ির এত অত্যাচারের
পর। স্বামীর অকথ্য গালিগালাজ মারধোর খেয়ে কেন পড়ে থাকে সেই অসভ্য ইতর স্বামীর
কাছে তা আজ বুঝতে পারছি। সংসার মানে তো শুধুই কয়েকটা মানুষের বন্ধন নয় সেই
বাড়ির জানলা-দরজা ওয়াড্রপ, বিছানা-বালিশ-তোশক, রান্নাঘর, হাঁড়ি-কড়াই, গাছপালা
সজীব নির্জীব সব কিছুর ওপর একটা অদ্ভুত টান এসে যায়। এই কারণেই সব ছিঁড়ে বেরোনো
সহজ নয়। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। মনে মনে বললাম, তবে আমি আজকালকার
মেয়ে আমার জীবনেও কিছু আদর্শ আছে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগে ফার্স্ট
ক্লাস পাওয়া মেয়ে আমি। সংগীতে মাস্টার্স করেছি। আমিও গান দেখাতাম, স্টেজ পারফরম্যান্স করতাম
অনিমিখ হওয়ার পর সব কিছু থেকেই সরে গেলাম। আমার জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি
একমাত্র অনিমিখকে দিলাম। সন্তান জন্ম দিলে এইটুকু স্যাক্রিফাইস তো করতেই হয়।
সন্তানকে পর্যাপ্ত জল আলো মাটি বাতাস দিলেই তো সন্তান গাছ হয়। অনিকেত চাইলেই পারত
ওর জীবন থেকে সামান্য সময়টুকু ছেলেকে দিতে কিন্তু না ও চায়ই না কোনো দায়িত্ব
পালন করতে।
অনিমিখ যখন জ্বরের ঘোরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল 'মা, বাবা কখন আসবে? তুমি একটা ফোন করো-না বাবাকে।' আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। বাচ্চারা অসুস্থ হলে সবার আগে তার বাবা-মাকে খোঁজে। সন্তান অসুস্থ থাকলে বাবারা কত খেলনা নিয়ে আসে যাতে তাদের মন ভাল হয়ে যায়। সন্তানের কাছে বাবা মানেই তো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ও এই বয়সে কোনোকিছুই পায় না যেটা এই বয়সের বাচ্চারা তাদের বাবাদের থেকে পায়। ও যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয় সেবারও তুমি ছিলে জলপাইগুড়ি। প্রিন্সিপালকে অনেক অনুরোধ করে ওকে স্কুলে ভর্তি করাই। ওর স্কুলের প্রতিটা কালচারাল প্রোগ্রামে তুমি কখনোই যাওনি। অন্য বন্ধুদের বাবারা আসে এই নিয়ে ওর একটা বরাবরই আক্ষেপ আছে যেটা ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে। আমি তো মা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতে পারি না। হয়তো চোখ বুজে পড়ে থাকলে তোমার মতো দায শূন্য হয়ে থেকে যাওয়া যায়। তবে এই পৃথিবীর প্রতিটা মা-ই বোধ হয় নিজের সন্তানের জন্য কড়ায় গন্ডায় সব বুঝে নেয়।
‘আমি আর এভাবে থাকতে পারব না। মা-বাবার কাছে চলে যাচ্ছি। ডিভোর্স ফাইল করেছি। আমি সাহিত্যিক অনিকেত চৌধুরীর স্ত্রী হয়ে আর থাকতে চাই না। সে কারণেই এই চিঠি লেখা। আশা করি তুমি ও আপত্তি জানাবে না।'
চিঠিটা লিখে খামে ভরে অনিকেতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment