বাতায়ন/রং/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৯শে
ফাল্গুন, ১৪৩১
রং
| ছোটগল্প
সুনির্মল
বসু
তরঙ্গমালার
দেশে ভালবাসা
"সুধা ঘুমিয়ে পড়ল। অনন্ত রাত্রি পেরিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। অমলেশ চেয়ে দেখল, ওর বুকের কাছে একটা ছোট্ট পাখির মতো সুধা ঘুমিয়ে পড়েছে।"
-তুমি একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে গিয়েছিলে?
-হু।
-আমার আঁকা ছবি কেমন লাগল?
-ভাল।
-শুধু এটুকুই বলবে?
-তোমার ছবি দেখে বুঝলাম, প্রকৃতি তোমার হাতে বিশেষ ভাল করে
ফোটে।
-সেটা সত্যি।
-আমি রং তুলি ধরলেই, গাছপালা রোদ্দুর ঝর্না নদী অরণ্য
পাখি সবাই একসঙ্গে উঠে আসে।
-তুমি ছবি জগতের বিভূতিভূষণ।
-এভাবে বোলো না। লজ্জায় আমি মাটির নীচে প্রবেশ করব।
-বেশ,
ছেড়ে দিলাম। চলো,
কফি হাউসে ঢুকি।
-রবি ঠাকুরের ছবির নীচে জায়গাটা ফাঁকা আছে।
-এমন সুন্দর জায়গায় বসার জায়গা পাবো, ভাবতে
পারিনি।
-জানো,
কলেজে পড়বার সময় এখানে এলে, সুনীল গাঙ্গুলী, সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে দেখা যেত।
-শুনেছি।
-দুটো কফির অর্ডার দিই।
-বলো। শোনো,
তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে?
-বলেই দ্যাখো।
-আমাদের পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে দিতে হবে।
-একটু সময় চাই।
-দিলাম।
-অফিস করে কীভাবে পত্রিকা চালাও?
-যেভাবে তুমি চাকরি বাঁচিয়ে ছবি আঁকো।
-একবার সমুদ্রের কাছে বেড়াতে যাবার খুব ইচ্ছে।
-আচ্ছা।
-সমুদ্র আমাকে খুব টানে। পুরীতে গেলে, দীঘায় গেলে, আমি পাড়ে
বসে জলের শব্দ শুনি।
-সেটা জানি। সেবার তালসারিতে গিয়ে তুমি আর আমি ঝাউবনের ছায়ায় হাঁটতে
হাঁটতে কতদূর চলে গিয়েছিলাম।
-তুমি উদাস হেঁটে গেছিলে, আমি ঝিনুক কুড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
-তোমার সেই চড়ায় আটকে যাওয়া জাহাজটার কথা মনে আছে?
-আছে তো! তুমি আবার ক্যামেরাম্যানকে ডেকে আমাদের ছবি তুললে।
-ঠিক বলেছ। কিন্তু এভাবে পরিচয়হীন সম্পর্ক আমার ভাল লাগছে না।
-কী বলতে চাও?
-বলছি,
সামনের অঘ্রাণে বিয়েটা সেরে আমরা তো পুরীতে যেতে পারি।
-সেটা সম্ভব। তুমি বাড়িতে কথা বলো।
-আমার বাড়িতে বলা আছে। শুধু ডেটটা মা-বাবা ঠিক করবেন।
-এদিকে আমি একটু গুছিয়ে নিই।
কফি শেষ করে
বিল মিটিয়ে ওরা পথে নামে। রাতের কলেজস্ট্রিট তখন সেজে উঠেছে।
তিন মাস
কেটে গিয়েছে। বিয়ের পর ওরা পুরীতে হানিমুনে এসেছে। বিকেলে
বালিয়াড়ি পেরিয়ে ঝাউবন ছাড়িয়ে ওরা সমুদ্রের তীরে হাঁটছিল।
-তোমার কেমন লাগছে, সুধা!
-খুব ভাল।
-জীবনটাও সমুদ্রের মতো।
-কেন?
-শেষটা দেখা যায় না।
-আকাশে তারা ফুটছে।
-অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু বাদে চাঁদ উঠবে।
-আমার চাঁদের আলো বড় প্রিয়। একবার মনে হয়, সারারাত
জেগে চাঁদকে দেখি, রাত্রি
পেরিয়ে স্বপ্নের দেশে চলে যাই।
-বাহ্, তুমি এইরকম
করে ভাবতে পার?
-হু। যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবার হাত ধরে হাঁটতাম, চাঁদটাও
আমার সঙ্গে হাঁটত।
-পৃথিবীটা বড় সুন্দর!
-একদিন সবকিছু ফেলে চলে যেতে হবে।
-জানি তো। কিন্তু আজকের এই দেখা যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন বুকের
মধ্যে জেগে থাকবে।
-কী সুন্দর বললে!
-সুন্দর মানুষের সঙ্গে হাঁটছি যে!
-তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের কথা মনে আছে?
-কোন কথাটা?
-জীবন এত ছোট কেনে।
-সত্যি,
ভালবাসা থাকলে, পৃথিবীতে
অনেক দিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।
-কথা দিলাম,
ভালবাসা আছে, থাকবে।
-ছোটবেলার কথা মনে আছে তোমার?
-শরৎকালে দুর্গাপূজার সময় তুমি কাশবনে লুকিয়ে পড়তে, আর আমি
তোমায় খুঁজে খুঁজে পাগলপারা।
-সেদিন তুমি আমার খেলার সঙ্গী ছিলে, আজ জীবন সঙ্গী হয়েছ।
-জীবন নিয়ে শেষ কথা বলা যায় না।
-কেন?
-সেদিন আমরা দুজন এভাবেই একে অন্যের কাছে আসব, কখনো
ভাবিনি।
-হলো তো।
-তা হলো। ঈশ্বরের ইচ্ছে।
-কলকাতায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
-অ্যাই,
কাজ না করলে, খাব
কী?
-সেটা ঠিক কথা।
-চলো,
এবার হোটেলে ফিরে যাই।
রাতে
বিছানায় শুয়ে ওরা জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখছিল।
-এই দৃশ্য আমাদের আগে কত মানুষ দেখে গিয়েছে।
-আমরাও দেখছি।
-একদিন আমরা পৃথিবীতে থাকব না। কিন্তু সমুদ্র থাকবে।
-একদিন আমরা না থাকলেও, আমাদের ভালবাসা থাকবে।
-পৃথিবী ছাড়া আর কোনো গ্রহে ভালবাসা নেই।
-জানি। মান্না দের গানটা মনে পড়ছে।
-কোন গানটা?
-চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।
-আহা আহা! আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে। এবার আমি ঘুমাব।
-হ্যাঁ,
এবার শুয়ে পড়ো।
-আমার বালিশটা কাছে নাও।
-কেন?
-তোমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে আমি ঘুমাব।
-ঠিক আছে।
সুধা
ঘুমিয়ে পড়ল। অনন্ত রাত্রি পেরিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। অমলেশ
চেয়ে দেখল, ওর
বুকের কাছে একটা ছোট্ট পাখির মতো সুধা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল ওর, ছোটবেলায়
পাখি পুষত ও।
আজ অনেক দিন
পর, বুকের
মধ্যে ভালবাসার পাখির মুখ দেখতে দেখতে সমুদ্রের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ও মনে মনে বলল,
-চিরদিন
এভাবেই তোমাকে ভালবেসে যাব। তুমি দেখে নিও, সুধা। এই ভালবাসার রাতটার কথা আমি
কোনদিন জীবনে ভুলব না।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment