বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৪র্থ সংখ্যা/১৯শে বৈশাখ,
১৪৩২
ধারাবাহিক
গল্প
শাশ্বত বোস
মিছিলের
ঠিক পরের ট্রামটা
[৪র্থ পর্ব]
"মনে মনে হাসে মৃদুলা, “কী লাভ হল?” পঞ্চাশ জনের গমগমে বাড়িতে আজ লোকসংখ্যা মোটে পাঁচ, তাও ওর সেজভাসুরের বৌমা অর্ধেকদিন এবাড়িতে থাকেন না।"
পূর্বানুবৃত্তি বাপের বাড়ি থাকতে মৃদুলা
কলকাতার ট্রামের অনেক গল্প শুনেছে বাবা-কাকাদের মুখে। একদিন বরের সাথে শিয়ালদার জগৎ
সিনেমা থেকে ট্রামে করে মৌলালী অবধি এসেছিল মৃদুলা। এই মৌলালির চার রাস্তার মোড়ে
ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে দাউ দাউ করে জ্বলেছিল গোটা একটা ট্রাম। না সে আগুন
শুধু কলেজ পাড়াতেই থেমে থাকেনি। তারপর…
শনিবারের বিকেলে শেষ হয়ে যাওয়া দুঃখের পৃথিবীটার সব ফেলে আসা গর্বিত পাপবোধ বুকে নিয়ে মাটি ছেড়ে শূন্যে ঝুলতে থাকা দরজাটাকে, ক্যাঁচ করে ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে কেউ।
“মা দরজাটা দাওনি? তোমায় নিয়ে আর পারলাম না। বলেছি না দরজা সব সময় দিয়ে রাখবে।
কাল রাতে পাশের বাড়িতে চোর এসেছিল! দুম করে কোনদিন কেউ ঢুকে পড়বে বুঝবে মজা! কেটে
রেখে যাবে একদম।” টানা ৪৮ ঘন্টা ডিউটি করে ফেরে মৃদুলার আত্মজ। ছেঁড়া জুতোটা পা
থেকে কোনরকমে খুলে বসার ঘরে ঢুকে খাটের ওপর শুয়ে পড়ে। “এই সোনু যা! এমা! গু-গোবরের
প্যান্টে এসে খাটে শুয়ে পড়লি?”
রে রে
করে ওঠে মৃদুলা। বরাবরই একটু শুচিবাইয়ের বাতিক আছে ওর। দিনের শেষ রোদ এসে তখন
পড়েছে তখন শহরের সমস্ত সিগন্যালে। “কর্পোরেশন থেকে সায়েশনটা এবার পেয়ে যাবো বুঝলে মা, বাড়িটায় এবার হাত দিতে হবে।” আধখোলা শার্টের ভেতর থেকে
বুকের চুলগুলো একটা মেঘহীন রোদজলহীন ব্যস্ত অভ্যাসে পাকাতে পাকাতে নিখুঁত ব্যালেন্সে
ঝুলে থাকা কড়িবরগাগুলোর দিকে চেয়ে বলে ওঠে সন্দীপ, মৃদুলার ছেলে। আকাশভাঙা দুঃখের ভিতর আনন্দের গভীরতম উৎসকে
জেনে ফেলেছে, যন্ত্রণার গহীন গভীরে গিয়ে
জীবনের প্রাণের স্পন্দন পেয়েছে, এমন একখানা বিস্ময়
মাখা মুখ নিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে মৃদুলা,
“তুই
হাত দিবি? পয়সা পাবি কোথায়?” “আমি না পাই যার টাকা আছে সে সারাবে। আমি শুধু আমাদের ভাগের
একখানা ঘর আর বাথরুম একটু একটু করে ছোড়দাভাইকে টাকাপয়সা দিয়ে সারিয়ে নেব। তবু
সায়েশনটা পেলে এই শর্মার ভাগ্যে মনে রেখো! ছোড়দা তো পাশের ফ্ল্যাটের প্রোমোটারের
এগেইন্সটে কেস করে নিজেই বাঁশ নিয়েছিল। হুঁ হুঁ অফিসে কদিন ধরে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার
ম্যাগাজিনে লিখছে Leo will make
certain settlement in property related litigations। এখন তুমি ভাত বাড়ো-গে যাও, আমি যাই ওপরে গিয়ে বৌদিকে বলে আসি। সন্ধেবেলা
ছোড়দাভাই ফিরলে বলতে হবে লাইন ধারের ছেনো মিস্ত্রিকে খবর দিতে। এসে দেখে যাক
সবকিছু।” সটান উঠে বসে আধখোলা জামাটা গায়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটা লাগায় সন্দীপ।
মৃদুলা ওর দিকে চেয়ে থাকে শুধু। মুখের ইংরিজি শুনে কে বলবে একসময় এলাকার নাম করা
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেটা ক্লাস এইটের গণ্ডি পেরোয়নি! আজ
রাতে নিজেই ছুটবে এন্টালি বাজারের দোকান থেকে রুটি তড়কা আনতে। দুই ভাই মিলে খাওয়া
হবে অথচ মাথা গরম হলে এই ছেলেকেই আর রাখা যায় না। মৃদুলার সেজভাসুরের ছেলেকে প্রায়
মারতে যায় আর কী! সরু গলিটায় এই ভরা শীতে একটা কুলফির গাড়ি
ঢুকে পড়েছে, “কুলফি, কু-ল-ফি মা-লা-ই”,
গলা
ফাটানো আওয়াজটা বাড়িগুলোর জীর্ণ দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেটে গড়িয়ে পড়ছে যেন! ঘোরলাগা
বিশাল অন্ধকার রান্নাঘরটায় পায়ে পায়ে ঢুকে আসে মৃদুলা। একসময় দিনে তিনরকম
ব্রেকফাস্ট টিফিন রান্না হত এখানে। বাড়ির এক এক বাবুর জন্য এক একরকম। দুধে গোলা
ফ্রেঞ্চ টোস্ট এখানে এসেই প্রথম দেখেছিল মৃদুলা। তারপর রান্নাঘরটা তিনভাগে ভাগ হল, মাঝখান দিয়ে তিনটে বিশাল বিশাল পাঁচিল। যে যার হাঁড়ি আলাদা।
মনে মনে হাসে মৃদুলা, “কী লাভ হল?” পঞ্চাশ জনের গমগমে বাড়িতে আজ লোকসংখ্যা মোটে পাঁচ, তাও ওর সেজভাসুরের বৌমা অর্ধেকদিন এবাড়িতে থাকেন না। ওই
পাগল ছেলে সোনু বাড়িটা বেচতে দিল না। বলে,
“মা তুমি
চলে গেলে তো আমার আর কেউ থাকবে না। অন্তত বাড়িটা থাকুক!” মৃদুলা ভাবে, এই শহরটা ক্রমশ দলছুট মানুষদের, এই শতাব্দীটা ক্ৰমশ বাড়িছুট মানুষদের হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর
এই অসুখটা সারাবার মতো একটা হাওয়া উঠবে হয়তো আর কদিন পরে। সেই হাওয়াতে এই বাড়িটারও
সব অসুখ সেরে যাবে। সব ক্লেদ সরে গিয়ে পাহাড়চূড়া থেকে ঠিকরে আসবে একটা আলো। যে
আলোটা হয়তো জন্মেও দেখেনি মৃদুলার শেষবারের দেখা ট্রামটা। হয়তো রাগ আর দুঃখের আলো আঁধারিতে মুখভার করে দাঁড়িয়ে আছে যে ট্রামটা ওকেও মুছে
যেতে হবে না সেদিন। ছাতের পায়রার ঘরে তখন নীলচে পেখম, বুকের কাছটা সাদা এমন একটা পাখি সদর্পে চলে বেড়াচ্ছে! মা
ফ্লাইওভারে তখন কর্পোরেট জ্যাম, উল্টোদিকের বাড়িটার
পাশে তখন জানলা জুড়ে পৌষমাস নেমে আসে।
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDelete