প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, April 11, 2025

ফুল ও বিগশপারের গল্প | ইন্দ্রজিৎ রায়

বাতায়ন/ঝড়/ছোটোগল্প/য় বর্ষ/ম সংখ্যা/১লা বৈশাখ, ১৪৩
ঝড় | ছোটোগল্প
ইন্দ্রজিৎ রায়
 
ফুল ও বিগশপারের গল্প

"এই অঞ্চল এদিকে নরেন্দ্রপুরওদিকে গড়িয়াবাঘাযতীনসবাই রামপুকারের হাঁকে অভ্যস্তখেলেই মরবেখেলেই মরবে, ইঁদুর, আরশোলা, ছুঁচো..."


ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই, সুভাষগ্রাম স্টেষনে এসে ঢোকে আয়ূষ। এবং এসে, এতগুলো বছর ধরেই, এক নম্বর, মানে বাঁদিকের প্ল্যাটফর্মে বসে থাকে কিছুক্ষণ। থুম মেরে বসে থাকে, মিনতিদির চা দোকানটা খুললে, প্রথম চা খেয়ে, তবে ট্রেন ধরে, কলকাতার দিকে। এতবছর, এই তার শিডিউল, একেবারে ঘড়িতে বাঁধা, এই রেললাইনের ঝকঝকে ছুট, ওর বাবা-মা'কে খেয়েছে, খেয়েছে ওর বছরগুলো, বয়ঃসন্ধির ঘটিগরম, সব।


বাবাকে আবছা মনে পড়ে আজও, লালসুতোর বিড়ি খেতো বাবা, দুটো-চারটে, কেমন একটা ঝিমধরা, মিঠেকড়া স্বাদ ছিল, বাবার কোলে করে যখন স্কুল যেত, ওইসময়ের একটা ছোট্ট ফাউ ঘুম ছিল, মিনিট কুড়ির, মিঠেকড়া বিড়ির গন্ধটা সেই থেকে নাকে লেগেই আছে, তবে কী, মানুষের মতোই, বিড়ির কোয়ালিটিও, কয়েকবছরে খারাপ হয়ে গেছে, আয়ূষ বিড়ির গন্ধ পায়, কিন্তু বাবার সেই মিঠেকড়া স্বাদটা অমিল, ওটা পায় না। বেলা চড়ে, দুহাতে দুটো বিগশপার ভর্তি আচারের বোতল, সঙ্গে জ্যাম জেলি, গরমে আমপান্না, কখনো মশলা মৌরি, কটা বাঁধা বাসা হয়েছে আয়ূষের এতবছরে। তারা কেনে ওর থেকে, নিয়ম করে, বড়ো পরিবার এখন বিরল, দুটো-একটা আছে হয়তো, তাদের ওখানে সপ্তাহে এক বোতল লাগেই, আর সত্যি বলতে কী, আয়ূষকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই সব বাড়ির বাচ্চুগুলো, ওরাই, বেল বাজালে দৌড়ে আসে, ওরাই বড়োদের ডেকে আনে মা, ও মা, এসো-না কাকু এসেছে আচার নিয়ে, আমাকে ওইটা দাও মিষ্টি আম তো খেজুর আমসত্ব, কত কী। হ্যামলিনের বাঁশিওলার মতো, স্বপ্নে দেখি আয়ূষ চলেছে, পেছনে পাড়ার বাচ্চুদের দল, তার পেছনে আমি

বাবা চলে যাবার পর, মা দীর্ঘ বছরগুলো ওকে হাত ধরে পার করে দেন, নিজের দিকে একেবারেই না তাকানোর ফলে মা'র শরীরটা অল্পবয়সেই ধ্বংস হয়ে যায়। পেচ্ছাপের জ্বালা, খুব কষ্ট পেত, আয়ূষ বড়ো হয়ে নানান মানুষের নানা মত শুনে, কত ওষুধ আনার চেষ্টা করত, পাথরকুচি পাতা তার মধ্যে একটি, মনে পড়ে
 
আমার বাবা, খুব স্নেহ করতেন আয়ূষকে, যদিও বাবা আচার, জেলির ভক্ত ছিলেন না, কিন্তু আয়ূষকে দুটো পয়সার ব্যবসা দেবার জন্য কিনতেন ওগুলো, খেতেনও সামান্য, একাধিক দিন, আমার বাবার সঙ্গে, দেখতাম আয়ূষ বসে আছে সন্ধের ভেতর ওদের দুজনের সামনে দুকাপ চা আর নৈঃশব্দ্য। বাবাও তো বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের ছেলে, অভাব কষ্ট আমার বাবারও গলার উত্তরীয় ছিল, দুজন আজন্ম দুঃখী মানুষের এই আদানপ্রদান আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝে বিকেলে কাজ থেকে ফিরে আমিও তৃতীয় কাপটা নিয়ে বসতাম ওদের পাশে, মাঝে দুজন অনেক দূরের মানুষের (আজ এমন মনে হয়!) কথা শুনতে। লাল-চা, কোনোদিন বর্ষাকাল হলে দুধ-চা কচ্চিত এরকম চলত। না, ওরা হয়তো আয়ূষকেই কেনেন বারবার আর ভাবেন তাদের ছেলে, ভাইদের কথা গোপনে, আর ভাবেন আহা ওরা যেন এই ছেলেটার মতো ভালো মানুষ হয়। মুখে বলেন না যদিও কারণ ছেলে লেখাপড়া শিখে আচার জেলি বেচবে, মুখে আধুনিক হলেও জীবনে এটা এখনও ভাবতে পারিনি হয়তো। অথচ আয়ূষ, আমার বাবা এবং অনেকে বলার পরেও অকৃতদার থেকে গেল, ভাগ্যিস নাহলে যে বাচ্চুগুলো ওকে দেখে কাকু-উ মা আচার কাকু- জেলি কাকু-উ বলে লাফাত, তারা একটা আরো সিঁটিয়ে যাওয়া আতঙ্কিত ভালোমানুষকে পেত শিওর, এই হাসিটাও হয়তো থাকত না মনে হয়, একদিকে ভালোই হয়েছে আয়ূষ একা ওর শরীরে অব্যক্ত সংসারজ্বালার ছাপটা পড়েনি, হ্যাঁ খুব ঘি মাখন মাংস খাওয়ার ছাপ হয়তো নেই ওর চেহারায় কিন্তু ওর ঝলমলে ক্লিষ্ট চেহারায় একটা অন্য জেল্লা আছে, যেটা প্রত্যাশিতভাবেই শিশুরা বুঝতে পারে কানেক্ট করতে পারে।
 
নেশা বলতে পাড়ার মোড়ে এখন বৃদ্ধ, পটল ঠাকুরের দোকান থেকে এক খিলি মিঠে সাদা পান। প্রতিবছরই, আমার বাবার জন্মদিনে আয়ূষকে খুঁজি আমি ওকে রাস্তায় দেখতে পেলে যেন আত্মীয় দেখার মতো লাগে
 
আর আয়ূষের জুড়ি বলতে রামপুকার ওর ছোটোবেলার খেলার সাথী, একটা চলমান মনিহারি দোকান, তবে মৃত্যুর- আরশোলা ইঁদুর ছুঁচো পোকামাকড় সবার ওষুধ আছে এই অঞ্চল এদিকে নরেন্দ্রপুর, ওদিকে গড়িয়া, বাঘাযতীন, সবাই রামপুকারের হাঁকে অভ্যস্ত, খেলেই মরবে, খেলেই মরবে, ইঁদুর, আরশোলা, ছুঁচো...
 
এই নগ্ন নগরায়নের হাঁ মুখের ওপর আয়ূষ হাসিমুখে হেঁটে যায়, দুহাতে ভারী বিগশপার নিয়ে ওকে অনুসরণ করে অল্প কিছু ফুলের মতো বাচ্চু সব, এই কাঁচা মাংসের বনে কোথাও এই ছোট্ট মিছিল কটা ফুল ছড়িয়ে যাচ্ছে আজও
 
আমরা তো এমনটা পারি না, পারি কি? আয়ূষ পারে, বাচ্চুরা পারে
 
সমাপ্ত

4 comments:

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)