বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
ইন্দ্রজিৎ
রায়
শরীরের
জন্য মন জেগে থাকে
"আমি তো কর্পোরেট ঢেমনা, ফলে অন্যরকম সাজ করে থাকি। শব্দটা বলে উঠে গিয়ে নিজের মুখটা দেখলাম আয়নায়, এরকমই দেখতে হয় তবে আজকে হয়তো আর সবাইকে মনে হয়, যে বারবার হোক তবু, কাজ তো একই করতে হবে এটা ভেবে, লেখা, মাঝে মাঝে নেশাভাঙ"
শরীরের জন্য মন জেগে থাকে। বছর বছর, শরীরের কীসে আরাম হবে, তার ফন্দিফিকির, কী করে সেই সোঁদা ভুবনে শরীরকে নিয়ে যেতে পারব তাই ভাবে। এর জন্য মন জেগে থাকে। কিন্তু উল্টোটা কী হয়, মনের জন্য কী শরীর জাগে, আমার ঠিক জানা নেই। আমার তো মনে হয় একটা সময়ের পর, শরীর ঘুমিয়ে পড়ে, পড়তে চায়, মনকে পকেটে নিয়ে শরীর ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ এও সত্য যে শরীর ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরেও, মন বলে গালাগাল জেগে থাকে, সারারাত খিস্তি দেয়, মনের জমিনকে, শরীর সেসব জানে না। ভোরের দিকে জানালা দিয়ে মন ঢুকে আসে, দরজা খোলা তবু
জানালা দিয়ে ঢোকে, যেন আমাদের প্রিয় অভিনেতা কেষ্ট মুখার্জির মতো। একা একা
দীর্ঘদিন থাকলে, শুনি রাস্তাগুলো মদের
দোকানের দিকে বেঁকে যায় এটা আমি লক্ষ্য করেছি, মানে ভদ্রলোকদের কথা বলছি আমি। যেসব সাবঅলটার্ন, ছোটলোক ওই গাঁজা, আফিম খায় তাদের কথা
বলছি না, কারণ সেসব গুলিখোরদের প্রসঙ্গে
আরেকদিন বলে যাব। মাঝে মাঝে মন ফিরে যায় এক টাকা দু টাকার শ্যাম্পু পাউচের দিনে, যখন বাংলা ছিল কাচের বোতলে, এখনকার মতো হয়নি খাপদোস্ত, তখনো গাঢ় বাদামি
কাচের বোতলে বাংলা, সবুজ ছিপি পাওয়া
যেত। ফিফটি আপ সিক্সটি আপ, আপ-ডাউন ট্রেনের মতো আর বীরভূমের দিকে ছিল সিক্সটি আপ, সবুজ ছিপি, একটু অভিজাত হালকা স্বাদ মিটে একজন গৌর খ্যাপা
সম্পর্কে বলছিলেন যে গৌর চলে গেলে মনে হতো যেন চারপাশে
কারফিউ হয়ে গেছে। সত্যই এরকম কিছু মানুষ থাকেন, যারা আলোর ঝলকানির মতো গৌর খ্যাপা সেই
গান-কাজ চলেছে শর্টকাটে ভাই শর্টকাটে,
আমাদের
আনন্দের জন্য দিন বটে। কিন্তু এসবের পাশে কত খাজা জানি না বিক্রি হলো এভাবে টিকিট কেটে
দেখল সুন্দর অন্ধকার প্রার্থনা করে শরীর ফিরে আসে স্টেশন রোড দিয়ে বাড়ির দিকে।
অন্ধকার পকেটে করে, স্টেশন রোড দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুকুরের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে
একটু থমকে যাই। বাবাকে মিথ্যে বলেছিল,
তারপর
মাকেও বাবুঘাটে দেয়নি, এর এখানে রেখে
দিয়েছিলাম। যাতে মাঝে মাঝে দেখা করতে পারি বাবা-মা ভুল শিক্ষা দিয়েছিলেন আমাকে
তার চেয়েও বড় ভুল আমি সেগুলোকেই বিশ্বাস করেছিলাম। আজও করি। কম্পিউটার বন্ধ করতে
ভুলে যাই, আলো নেভাতে, ফোন বন্ধ করতেও,
এবং
সারারাত, তড়িৎ চুম্বকীয়, রক্তক্ষয়ী কাটাছেঁড়ার ভেতর অসাড় পড়ে থাকে শরীর, মনকে কোঁচড়ে নিয়ে,
এটা
হয়তো ঘুম নয় শরীর, বলেছিলাম মনের জন্য
জেগে থাকে না না ভুল বললাম হয়তো। মন তো,
লেহনের
জন্য জেগে থাকে, ভোগের জন্য, দেখুন কেমন যেন স্পিরিচুআল গুরুদের মতো শোনাচ্ছে
আমাকে।
যদিও ওরকম চেহারাটা বানাতে
পারিনি, কারণ আমি তো কর্পোরেট ঢেমনা, ফলে অন্যরকম সাজ করে থাকি। শব্দটা বলে উঠে গিয়ে নিজের মুখটা দেখলাম
আয়নায়, এরকমই দেখতে হয় তবে আজকে
হয়তো আর সবাইকে মনে হয়, যে বারবার হোক তবু, কাজ তো একই করতে হবে এটা ভেবে, লেখা, মাঝে মাঝে নেশাভাঙ, বাদ দিলে কর্পোরেট বাজারে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠব শুনি।
আমার নৃত্যভঙ্গিমাতে আরেকটু লচক আসবে,
এইটা
ভাবতে ভাবতে বাজারে গেলাম চিংড়ি কম, লঙ্কা বেশি এরকম একটা
চিংড়ির ঝাল দিয়ে ডাল ভাত মেখে খেতে একটু বাসনা হচ্ছিল কেন জানি না অবশ্য
মাতালছাতালদের বেশি ঝাল খাবার একটা প্রবণতা থাকে।
যদিও নাট্যকার বলেছিলেন এটা
পেঁচো মাতালদের আমাশয় রোগ হবার প্রধান কারণ,
এই
চিংড়ির ঝাল আই মীন, তাহলে কোনটা যে
ছাড়ান দেবেন, লেখাটা বন্ধ রাখবেন? নাকি নেশাটা বন্ধ রাখবেন? কিছুদিন দুটোই বন্ধ রেখে, দেখবেন, কর্পোরেট বাজারে অন্যদের মুখে একটা অদ্ভুত জ্যোতি। তারা
বললেন এই তো, সুন্দর কাজ করছ, আরো ইম্প্রুভ, আরো ইম্প্রুভ করবে
আরো উন্নত কাজ করো, কিন্তু কাজটা যে কী সেটা এখনো
পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছেন না, তাই না!
আপনার কাজ কী কথা বলা, এক ঘর লোকের সঙ্গে?
বসে
থাকা? নাকি অনেক অনেকগুলো সংখ্যা, এক কাগজ থেকে, আরো পাঁচটা কাগজে
নির্ভুলভাবে টুকে ফেলা? কোনটা কাজ আপনার? আমি এখনো বুঝতে পারিনি, অথচ এই কাজের জন্যই আমরা সবাই মাসের শেষে কিছু টাকা পাই। সেই টাকায় চাল ডাল
নুন তেল, পেঁয়াজ মদ লাউ গাঁজা কেনা চলে, খুব জটিল কেস কিন্তু।
প্রশ্নটা ফিরে আসে, সেই এক বোষ্টম গোঁসাই অনেক বছর আগে প্রশ্নটা করেছিল স্যার
আমরা ঘর কেন বানাই বলেন তো। আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, তাই তো, তিনি বলে চলেন, পুরো পরিবার তো একটা
বড় হল ঘরেই, হল ঘরেই থাকতে পারত, তাই না? দুষ্টু হেসে বলেছিলেন, জানেন তো স্যার আমরা মনার জন্য ঘর বানাই। কে মনা, আর কিছু বলেননি চমৎকৃত হয়েছিলাম অনেক বড় বড় সাহিত্যের
বাঘ ভাল্লুক দেখলাম, কিন্তু এই মনার কথাটা
তারা কেউ বলতে পারেনি। এই মনা কে কোথায় থাকে আপনারা চেনেন ওনাকে, যে মনার জন্য ঘর বানান তাকে চেনেন? চৈত্রের আগ্রাসন চলছে এই শহরে, সারা শহরে, বাদামি হলুদ পাতা
পড়ে রাস্তাগুলো থেকে যাচ্ছে, তারই ভেতর বিকেল শেষ
হতে না হতে হলুদ বাদামি পাতার ঢাকা রাস্তাগুলো, রাস্তাগুলো কান্নার মতো তার ওপর বসে কিছু নারী-পুরুষ লক্ষ-কোটি, হাজার টাকার, হিসাব করছে ডানে
বাঁয়ে,
সাদাকালো চাবি হারমোনিয়ামেও
থাকে আবার পিয়ানোতেও থাকে কিন্তু সব সাদাকালো চাবির ভাষা এক না, দূর থেকে হেঁটে যাওয়া পাগুলো হাতগুলো তাদের ছায়া পিয়ানোর
টুংটাং আর অনেক দূরে শাল বট তাদের ছায়াতে, সুন্দর মুখের মানুষ যত, এমনি চট বিছিয়ে
হারমোনিয়াম মন্দিরা দোতারায়, একতারা নিয়ে বসে যে
গান জমে ওঠে, আস্তে আস্তে তার হদিস আমরা
আজও পাইনি। সে গানটির ট্রেন্ডিং হয় লক্ষ কোটি ভিউ, রিল তৈরি হয় আমার ঠিক জানা নেই। আজকাল দেখতে পাই কীভাবে
কর্পোরেট যে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে তা নয়, তারা সংবেদনশীল মানুষকে হত্যা করে, যে মানুষ কবিতা লিখত,
গান
গাইত, চুপ করে বসে থাকত সেইসমস্ত
মানুষকে আস্তে আস্তে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এসো রং লাগাও। মনার জন্য কাজ করো।
শরীরের জন্য মন জেগে থাকে
বছরের পর বছর আবার মনে পড়ে কথাটা মনের জন্য শরীর কখনো জাগে না শরীর। কিছু কিছু
মানুষ, তাদের শরীর জেগে থাকে মনের
জন্য, ক্লেশ পায়, তাদের শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, একের পর এক মহৎ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন তাদের শরীর ক্ষয়ে যায়, কিন্তু মনটা জেগে থাকে।
আমরা ঘর কেন বানাই স্যার?
সমাপ্ত
Bah!! Aro hok...💙🌟
ReplyDelete