বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক
গল্প/৩য় বর্ষ/২০তম সংখ্যা/২০শে ভাদ্র,
১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
অরূপ কুমার
দেব
রহমতের
কেরামতি
[২য় পর্ব]
"পরথম পরথম খুব যন্ত্রণা দিছে। ঘাড় বাইয়া মাথায় উইঠা যাইতো। হের পরে আমার হইতো বুদ্ধি নাশ। কী কী কাম যে করতাম, নিজেই কইতে পারতাম না। একবার তো দাও দিয়া কোপাইয়া এক ল্যাংড়া ফকিররে মাইরাই ফালাইতেছিলাম।"
পূর্বানুবৃত্তি সঞ্জয়ের আমেরিকায়
প্রবাসী মামার বাগানবাড়ির শখে কিছু জমি
কেনার জন্য দেখতে আসে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর জানতে পারে দোলোয়ারের বাইক অ্যাক্সিডেন্ট
হওয়ায় সে আসতে পারবে না। তারপর…
আলমের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না সঞ্জয়। তবে আশপাশের দোকানগুলোতে সত্যি অনেক গ্রাহক আর আলমের দোকানে সে একা। কিন্তু এতেও কিছু পরিষ্কার হলো না। সঞ্জয়ের অবস্থা আঁচ করেই আলম গোড়া থেকে তার গল্পটি বলতে শুরু করে। তার কাছ থেকে শোনা ঘটনাটির সারাংশ হচ্ছে এইরকম।
তিন বছর আগে পৌষ মাসে খালুর
মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বিজনী সীমান্তবর্তী অজপাড়াগাঁয়ে যায় আলম। সেখানে গিয়ে জানতে
পারে একটি বাড়িতে প্রতি বুধবার জিন নামানো হয়। সেই জিন
মানুষের রোগশোকের নিদান দেওয়া ছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতা, আর্থিক উন্নতি,
পরীক্ষায়
পাশ, হারানো স্বজনকে খুঁজে দেওয়াসহ
সব ধরণের সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। কৌতুহলী আলম হাজির হয় সেই বাড়িতে। জিন নামানোর
পর্বটি আবার দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। তবে শর্ত হচ্ছে পাক-পবিত্র পোশাক পরে এবং ওজু
করে আসরে বসতে হবে। সব নিয়ম মেনেই আলম দুরুদুরু বুকে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে।
সেখানেই রহমতের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ। এর পর থেকেই জিন
রহমৎ তার সঙ্গে আছে আর অনেকরকম কেরামতি করছে।
হাইওয়ে ধরে সাঁইসাঁই করে বাস
যাচ্ছে-আসছে। চারদিকে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। বাসস্ট্যান্ডে হাজারো মানুষের
আনাগোনা। এই পরিবেশে এ ধরণের একটি আষাড়ে ভুতের গল্প! হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে
না সঞ্জয়। চা দোকানি আলমের মানসিক সুস্থতা নিয়ে এবার সন্দেহ জাগে। আর মনে-মনে নিজেকে গাল দেয়, এই ছেঁদো গল্প শুনে সময় নষ্ট করার জন্য। সঞ্জয়ের মনের অবস্থা আঁচ
করতে পারে আলম।
-আপনের পকেটের
মানিব্যাগটা যে আপনেরে দিছে হ্যায় আপেনেরে ছাইরা চইলা গেছে। অনেক দূরে।
ফ্যালফ্যাল করে আলমের দিকে
তাকিয়ে থাকে সঞ্জয়। বিচিত্র অনুভুতি খেলা করতে থাকে তার ভেতর। সঞ্জয়কে ছেড়ে শ্বেতা
পুরকায়স্থ ডিভি লটারি পাওয়া এক যুবকের হাত ধরে হাসতে-হাসতে আমেরিকা
পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু এ কথা এই চায়ের দোকানদার আলমের কিছুতেই
জানার কথা না। আস্তে-আস্তে সঞ্জয়ের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
তীব্র চোখে আলম তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-আমারে বিশ্বাস না করতে পারেন। কিন্তু রহমতের কেরামতিরে
বিশ্বাস না করনের কুনু পথ নাই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলম বলতে
শুরু করে,
-পরথম পরথম খুব যন্ত্রণা দিছে। ঘাড় বাইয়া মাথায় উইঠা যাইতো।
হের পরে আমার হইতো বুদ্ধি নাশ। কী কী কাম যে করতাম, নিজেই কইতে পারতাম না। একবার তো দাও দিয়া কোপাইয়া এক ল্যাংড়া ফকিররে মাইরাই
ফালাইতেছিলাম। কেউ দেখনের আগেও সইরা পরছিলাম বইলা থানাপুলিশের ঝামেলায় পড়ি নাই।
তয় হেয় খুব চালাক, আমারে ধরা খাওয়ায়
নাই। একবার তো গেরামের লোকজন মিলা আমার ধইরা-বাইন্দা তেজপুর মেন্টাল হাসপাতালে
পাডাইলো। কিন্তু হেইখানে আমার ওয়ার্ডের দুইজন নার্স আর একটা আয়া পাগল হওনের পর
হাসপাতাল থিকা আমারে বাইর কইরা দিছে।
মোহাবিষ্টের মতো আলমের
বিচিত্র কাহিনি শুনে যায় সঞ্জয়। সে মাথা নাড়িয়ে একটুকু ঢোক গিলে বলে,
-তয় দিনে-দিনে আমিও রহমতরে বশ করন শিখছি। অখন আর
মাথাত চড়তে দেই না। সবসময় কমরের নীচে রাখনের চেষ্টা করি। তয় রাইতে হের উপর আমার
কন্টোল থাকে না। হের লেইগা রাইতে নিজের ঘরেই বাইরে দিয়া তালা মাইরা শুই।
সঞ্জয় বুঝতে পারে না আলমের
কথাগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। আর কেনই বা এই সময় সে তাকে এসব গল্প শোনাচ্ছে! আলম
নিরলসভাবে বলতে থাকে,
-রহমতরে কুনু সময় মাথাত উঠতে দিবেন না, বসে রাখবেন। একবার যুদি মাথাত উঠে, তাইলে হেয় আপনের বুদ্ধিরে বশে নিবো। তখন হেয় আপনেরে দিয়া যা
খুশি তা করাইতে পারবো। রহমতের মুশকিল কী জানেন, হেয় বেশিদিন একজনরে ভর কইরা থাকতে পারে না। যখনই হেই
মানুষটা তারে বশ করন শিইকা যায়, তখনই রহমৎ নতুন আশ্রয়
খুঁজতে কেরামতি করতে থাকে। অখন আর রহমৎ আমারে না, আমিই রহমৎ রে চালাই।
এটুকু বলে থামে আলম। দু-চোখ তুলে
সরাসরি তাকায় সঞ্জয়ের দিকে। তার চোখদুটো যেন তার কপাল ভেদ করে সরাসরি মস্তিষ্ক
দেখতে পাচ্ছে। সঞ্জয়ের মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। ভেতর থেকে কে যেন
ক্রমাগত তাড়া দিতে থাকে, পালাও পালাও!
রুমাল বের করে মুখ মুছে এক
ঝটকায় দোকান থেকে বেড়িয়ে আসে সঞ্জয়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে সামনে যে বাসটি পায়
ঝড়ের বেগে চড়ে বসে তাতে। একটু পরই লক্ষ্য করে এটি গুয়াহাটিগামী নয়, ধুবুড়ির দিকে চলছে। যাইহোক পরে বাস বদলে নেওয়া যাবে। ঘাম দিয়ে যেন
জ্বর ছাড়ে।
ধাতস্ত হয়ে একটু আগে ঘটে
যাওয়া ঘটনাটি ভাবতে থাকে সঞ্জয়। এবার নিজেকে কেমন যেন বোকা-বোকা লাগে।
দিনেদুপুরে এমন একটি উদ্ভট ভুতের গল্প শুনে ভয়ে দৌড়ে পালাল সে! যাইহোক বাস বদলে গুয়াহাটিমুখী একটি ডিলাক্স বাসের সিটে বসে মাথা
এলিয়ে দেয়।
সারাদিন খুব ধকল গেল। চোখদুটো
একটু লেগে এসেছিল হয়তো। হঠাৎ সারাশরীরে ব্যথা অনুভব করে সঞ্জয়। দু-চোখে আঁধার
নেমে আসে। অন্ধকারে ডুবে যেতে-যেতে হলদেটে ক্রুর দুটি চোখ
দেখতে পায়। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ওই চোখদুটি যেন সঞ্জয়ের চোখের সঙ্গে
একাকার হয়ে যায়। মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ। তীব্র একটি জান্তব বোটকা গন্ধে
গা গুলিয়ে ওঠে। সঞ্জয়ের মনে হতে লাগল যেন রহমৎ কোনও নতুন
কেরামতি করতে চলেছে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment