বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
সঙ্ঘমিত্রা
দাস
মায়ের
পরশ
"পিকলু মহা আনন্দে মা বলে গলা জড়িয়ে ধরে। দূরে কোথাও মা দুর্গার বিদায় লগ্নে শাঁখ বাজছে। সত্যিই মা যাবার আগে ওদের জীবনের নব সূচনা করে দিয়ে গেলেন। সরমাদেবী মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখলেন মা ছেলেকে কী সুন্দর জড়িয়ে ধরেছে বুকে।"
অবিনাশবাবু রেডিয়োটা চালিয়ে বারান্দার ইজি চেয়ারে গিয়ে বসেন। মহালয়া শুরু হয়েছে। সরমাদেবী বিছানায় বসে। পাশে ছোট্ট পিকলুও জেগে গেছে মহালয়ার সুর শুনে। বছর ঘুরে আবার আসে পুজো। বাইরে কত হুল্লোড়, আনন্দে মেতে সবাই। শুধু এ বাড়িতে পুজোর আনন্দ বলে আর আলাদা কিছু নেই। পরমা মারা যাবার পর সব কেমন যেন থমকে গেছে। মা মরা ছেলেটাকে বুকে আগলে সরমাদেবী এই বয়সে রোজ নিজের জীবনের আকুতি জানান ঠাকুরের কাছে, "বাচ্চাটার জন্য আমাকে সুস্থ রেখো ঠাকুর, ওকে যেন একটু বুঝদার করে যেতে পারি"।
পিকলুর জন্মের সময়ই মারা
যায় পরমা। ছেলে কোলে বাড়ি ফেরেন ঠাকুমা সরমাদেবী। শিবম, পিকলুর বাবা একেবারে বদলে যায় তারপর। হাসিখুশি ছেলেটা এখন
অনেক গম্ভীর। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখে সবসময়। কখনও হয়তো ছেলেকে
কাছে টেনে আদর করে বা রাতে নিজে হাতে খাইয়ে দেয় কিন্তু তেমন
টান কোনদিনও লক্ষ্য করেননি সরমাদেবী। পিকলু বেশিসময় তাই ঠাকুমার কাছে থাকে। ধীর
শান্ত, খুব বাধ্য সে, ঠাকুমার বিশেষ কোনও ঝক্কি নেই তবু মা মরা বাচ্চা মানুষ করা।
পুজোর জামা, জুতো, খেলনা সবই এনেছেন অবিনাশবাবু নাতির জন্য। অথচ ছেলেটা সবসময়
কেমন মনমরা থাকে। মায়ের গল্প শুনতে চায়,
ছবি
দেখতে চায়। শিবম পরমার কোনও ছবি চোখের সামনে রাখতে দেয়নি। ওকে ওভাবে ছবিতে দেখলে কষ্ট
পায় সে। সরমাদেবী তাই মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফিরে খাওয়াতে খাওয়াতে পিকলুকে ওর
মায়ের গল্প শোনায়।
পাড়ায় ভট্টাচার্য বাড়িতে
মহা ধুমধামে দুর্গাপুজো হয়। মহালয়ার
সকালে মায়ের চক্ষুদান হচ্ছে। বুড়ো শিল্পী খুব যত্নে মায়ের তৃতীয় নয়ন
আঁকছেন। পিকলু খাবার টেবিলে বসে শুনতে পাচ্ছে, উলুধ্বনি হচ্ছে, শাঁখ বাজছে। ও পায়ে
পায়ে ভট্টাচার্যদের ঠাকুর দালানে গিয়ে দাড়ায়। ওদের একটা বাড়ির পরেই বাড়ি।
পিকলু ঠাকুরের আশীর্বাদী হাতের ঠিক সামনে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। শান্ত স্বভাবের
ছেলেটা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে মা দুর্গার সামনে। ঠাকুমা ওকে বলেছে ঠাকুর আশীর্বাদ
করলে মা একদিন ঠিক ফিরে আসবে। ঠাকুর নিজে গিয়ে মা-কে ওর কথা বলবে, আর সেই কথা শুনে মা
আর না এসে থাকতেই পারবে না। সেইদিনের অপেক্ষায় আছে পিকলু। ঠাকুরের আশীর্বাদি হাতের সামনে
এই কদিন রোজ এসে দাড়াবে, যাতে ওকে দেখতে পায়
আর মা-কে পাঠিয়ে দেয়। বাবা বলে মা আকাশে তারা হয়ে গেছে, ওখান থেকে সব দেখছে। আসতে পারবে না কিন্তু পিকলুর ঠাম্মার
কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ছোট্ট পিকলু তাই ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার
সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন নিশ্চয়ই ঠাকুর ওর মা-কে ফিরিয়ে
দেবে। এরপর রোজ স্কুল ফেরত একবার ঠাকুরের কাছে ঘুরে আসে। একটু একটু করে প্রতিমার রং ধরে, সেজে ওঠে নানা গয়নার
সাজে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে মা দুর্গাকে। পিকলু হাত জোর করে ওর মা-কে ফিরে পাবার আকুল প্রার্থনা জানায়। পঞ্চমীর দিন স্কুল ছুটি পড়ল, সবাই খুশিতে ঝলমল করছে। ওর বন্ধুরা কী সুন্দর নতুন
জামা পরে মায়ের হাত ধরে স্কুলে এসেছে। পিকলুও একটা নতুন
জামা পরে ঠাম্মার সাথে এসেছে কিন্তু মুখে উচ্ছ্বাসের চিহ্ন
মাত্র নেই।
ভট্টাচার্য বাড়ির বড় মেয়ে
ইন্দ্রানী। এবার পুজোয় বাড়ি এসেছে একা। ও জানে এবার আসাটা ওর একেবারে চলে আসা।
বাড়িময় আত্মীয়স্বজন। ছোটবোন স্বামী,
শাশুড়ি, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির। এর মধ্যে ইন্দ্রানী আর নিজের
সমস্যা টেনে আনতে চায় না। পুজো শেষে সবাই ফিরলে বাবা-মাকে সব
জানাবে। রাজীব, ওর স্বামী কাজের
ব্যস্ততায় আসতে পারছে না এমন একটা অজুহাত সকলের সামনে খাড়া করে রেখেছে। তবে
পিছনে যে নানা কথা হচ্ছে ও সেটা ভালই বুঝতে পারে। দশ বছর হয়ে গেছে বিয়ের। একটা
সন্তানের আশায় কত চিকিৎসা, কত মানত করেছে, কিন্তু ওর কোল আজও খালি। যত দিন যাচ্ছে শাশুড়ির
গঞ্জনা ততই বাড়ছে। বিজয়ও খিটখিটে হয়ে গেছে, ওকে এড়িয়ে চলে। এক ঘরে থাকে অথচ দুজনের মাঝে এখন দুস্তর
ব্যবধান। চিকিৎসার নামে কত শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছে, একটা বাচ্চা আসবে কোল আলো করে এই আশায়। কিন্তু হতাশা ছাড়া
কিছুই পায়নি। এখন তো পাড়াপ্রতিবেশীরাও ওকে অনেক শুভ কাজে এড়িয়ে চলে। বিজয়
হয়তো এই চলে আসার অপেক্ষাটাতেই ছিল। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবে।
সব শেষ হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে ইন্দ্রানী। দুচোখ বেয়ে জল
গড়িয়ে পড়ে। বারান্দা থেকে ঠাকুর দালানে মায়ের মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে।
ইন্দ্রানী রোজই দেখে পিকলুকে।
বাচ্চাটা কী মিষ্টি আর শান্ত। চোখদুটো খুব মায়াবী, তবে কেমন যেন বিষণ্ণ। ঠাকুরের সামনে এসে বসে কিছুক্ষণ তারপর
আস্তে আস্তে চলে যায়। কে ও? এতটুকু ছেলে খেলাধুলা
নেই। পাশে অন্য বাচ্চারা হইচই করছে সেদিকে কোনও নজর নেই। একমনে কী দেখে ঠাকুরের দিকে? ইন্দ্রানী অবাক হয়
দেখে ওকে। মা-কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল ও পাশের বাড়ি শিবমদার ছেলে। শিবমদা বয়সে বছর
কয়েক বড় ইন্দ্রানীর চেয়ে। ওর বিয়ের পর শিবমের বিয়ে হয়েছে তাই শিবমের বউ বা বাচ্চাকে ইন্দ্রানী চেনে না। শিবমের স্ত্রী পরমা বাচ্চা হতে গিয়ে
মারা গেছে। পিকলু ঠাকুমার কাছে মানুষ। খুব শান্ত আর বাধ্য ছেলে ও। মায়ের কাছে
শোনে ওদের সব কথা ইন্দ্রানী। কেমন যেন মায়া পড়ে যায় বাচ্চাটার উপর। ওর নিজের
কষ্টের সাথে বাচ্চাটার কষ্টের কোথায় যেন মিল খুঁজে পায়। মনে মনে ওকে নিজের খুব
কাছের মনে হয়। রোজ অজান্তেই পিকলুর আসার অপেক্ষায় থাকে ইন্দ্রানী।
ষষ্ঠীর দিন সকালে বাচ্চা বড়
সবাই বেশ নতুন জামাকাপড় পড়ে ঘুরছে। বাড়িটা গমগম করছে লোকের ভিড়ে। মায়েরা
সবাই তাদের সন্তানদের মঙ্গল কামনায় উপোস
করেছে। দুপুরের জন্য লুচি ছোলার ডাল রান্না হচ্ছে। ইন্দ্রানীরও কিছু খাওয়া হয়নি।
নীচে ঠাকুর দালানে বোধনের আয়োজন চলছে। বারান্দায় ইন্দ্রানী, পিকলুও ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বাচ্চাদের
দৌড়োদৌড়ির মাঝে পড়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় পিকলু, কেঁদে ওঠে। ইন্দ্রানী ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। পিকলু
ধুলোমাখা হাতদুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইন্দ্রানীকে। ওকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে এসে
পরম যত্নে ওষুধ লাগায় ইন্দ্রানী। ছেলেটা খুব ব্যথা পেয়েছে। পিকলুকে এত আদর করে
আগে তো কেউ ওষুধ লাগিয়ে দেয়নি! পিকলু ইন্দ্রানীর কোলের কাছে ঘেঁসে যায়
আরও। ইন্দ্রানীর পিসিমা মন্তব্য ছুঁড়ে দেন,
-তোর তো ষষ্ঠীর ধুলোমুঠি শাড়ি পড়া হয়ে গেল, এবছরই দেখবি তোর কোল আলো হবে।
কথায় মনটা কেঁদে ওঠে, চুপ করে পিকলুকে আঁকড়ে ধরে ও।
পিকলু আর ইন্দ্রানীর বেশ
বন্ধুত্ব হয়েছে। দুজন নিজেদের দুঃখ কিছুটা ভুলে হাসতে শিখেছে। সবাই লক্ষ্য করেছে
ওরা বেশ একসাথে গল্প করে, অষ্টমীর সকালে
ইন্দ্রানী পিকলুকে সাথে নিয়ে অঞ্জলি দেয়,
প্রসাদ
খায়। নবমীর আরতি দেখতে দেখতে পিকলু হাততালি দিয়ে ওঠে, ইন্দ্রানী ওকে একটা ফাঁকা ধুনুচি ধরিয়ে নিজে একটু ওর সাথে
নেচে নেয়। ইন্দ্রানীর মা আর সরমাদেবী ওদের খুশি মুখটা দেখে বেশ স্বস্তি পান।
ইন্দ্রানী যেন পিকলুকে পেয়ে ওর সব কষ্ট ভুলে গেছে। পিকলুও ইন্দ্রানীর মধ্যে
ঠাম্মার মুখে শোনা মায়ের গল্পের মিল খুঁজে পায়।
দেখতে দেখতে পুজো শেষ। পিকলু
কটা দিন সব কষ্ট ভুলে ইন্দ্রানীকে আঁকড়ে আনন্দ করল খুব। ইন্দ্রানীও পিকলুকে পেয়ে
খুশিতে ভেসে গেছিল। বিকেলে দশমীর বরণ চলছে। ইন্দ্রানী খুব সুন্দর সেজেছে আজ।
পিকলুকে সাথে নিয়ে ঠাকুর বরণ করে নীচে নেমে আসে। সবাই সিঁদুরে ওকে রাঙিয়ে
দিচ্ছে। পিকলু অবাক চোখে চেয়ে থাকে ওর দিকে। মা কি এমনই হয়? ইন্দ্রানী টুক করে একটা সন্দেশ মুখে পুরে দেয় পিকলুর আর
হোহো করে হেসে ওঠে। পিকলু হাসতে গিয়ে বিষম খায়। ইন্দ্রানী মাথায় ফুঁ দিয়ে সাটসাট করে
দেয়। পরম স্নেহে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
সন্ধে ঘনিয়ে আসে, বিদায় বেলায় প্রতিমা নিরঞ্জনের পথে পা বাড়ায়। মন খারাপ
সকলের। একে একে যে যার ঘরে ফেরে। পিকলু ইন্দ্রানীর হাত ধরে বাড়ির পথে। দরজায়
পৌঁছে চিৎকার করে ডাকতে থাকে ঠাম্মা,
দাদুনকে।
-ঠাম্মা, দাদুন, বাবা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। ঠাম্মা ঠিক বলেছিল, ঠাকুর যাবার আগে আমার মা-কে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
দেখে যাও মা-কে নিয়ে এসেছি।
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে
পিকলুর দিকে। শিবম কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সরমাদেবী একটু বিব্রত হয়ে ওকে
ইন্দ্রানীর কাছ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ইন্দ্রানী কোলে তুলে নেয় পিকলুকে।
-তাহলে মা বলে ডাক একবার।
পিকলু মহা আনন্দে মা বলে গলা
জড়িয়ে ধরে। দূরে কোথাও মা দুর্গার বিদায় লগ্নে শাঁখ বাজছে। সত্যিই মা যাবার আগে
ওদের জীবনের নব সূচনা করে দিয়ে গেলেন। সরমাদেবী মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখলেন মা
ছেলেকে কী সুন্দর জড়িয়ে ধরেছে বুকে।
সমাপ্ত
GOOD
ReplyDeletegood
ReplyDelete