প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

শরৎ উৎসবের অমাবস্যায় জীবনের কোলাহল | ব্রজ গোপাল চ্যাটার্জ্জী

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
ব্রজ গোপাল চ্যাটার্জ্জী
 
শরৎ উৎসবের অমাবস্যায় জীবনের কোলাহল

"বিশ্বনাথের রক্তমাখা লুঙ্গি খাঁড়িতে ভেসে উঠলনিশ্চিত হলো তার পরিণতি। তার দেহ আর পাওয়া যায়নি। দক্ষিণরায়ের শিকার হয়েছে সে—যেন মৃত্যুর রক্তিম স্বাক্ষর আঁকা হলো নদীর জলে। আর তারপর এল বিনোদের খবর। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপ দিলেও কুমির তাকে অতলে টেনে নিয়েছিল।"


মহালয়ার অন্ধকার অমাবস্যার রাতে মাতলা নদীর জল ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তার উন্মত্ততা যেন আরও ভয়ংকর। এই নদী শুধু জল নয়, যেন এক অতৃপ্ত রাক্ষসের ক্ষুধা। এই নদীর বুকে এক চাপা ভয়, যা বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামল, অসিত, বিশ্বনাথ আর বিনোদের দল। তাদের চোখে কঠিন সংকল্প, মুখে চাপা উদ্বেগ। আজ তারা মধু কাটতে যাবে সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ওঁত পেতে আছে।

 
তাদের স্ত্রীরা— আশাপূর্ণা, কমলা এবং অন্যান্যরা— নদীর ঘাটে প্রদীপ জ্বেলেছেন, তাদের স্বামীদের নিরাপদে ফিরে আসার আশায়। প্রদীপের আলোয় কাঁপছিল তাদের বুক, যেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা জীবনের এক দুর্বল শিখা। প্রতিটি শিখা যেন এক-একটি প্রার্থনা, যা ঈশ্বরের কানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
 
তারা নৌকায় উঠে বৈঠা ধরেছিল। সেই বৈঠার শব্দে যেন মিশেছিল ভয় আর সাহসের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। গভীর রাতে মাতলার বুকে সেই ছোট নৌকাগুলো যেন অসীম সাহসের প্রতীক। এ যেন শুধু হরগোজা ফুলের মৌসুমে মধু সংগ্রহ নয়, জীবন আর মৃত্যুর এক কঠিন খেলা। এই সময় শ্যামল, অসিত, বিশ্বনাথ আর বিনোদ দলের বাকিদের সঙ্গে বৈঠা ঠেলে আরও গভীরে প্রবেশ করল। ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক আর নদীর পাড়ের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা নাম-না-জানা পাখির ডাক এক বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি করেছে।
 
কিন্তু সুন্দরবনের শ্বাপদসংকুল জঙ্গল প্রতি মুহূর্তে সবকিছু গ্রাস করতে উদ্যত। এখানে মৃত্যু এক উন্মুক্ত তলোয়ারের মতো সবার মাথার ওপর ঝুলে থাকে। দেখতে দেখতে পাঁচ দিন পেরিয়ে গেল, কিন্তু শ্যামলরা ফিরল না। গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে আশঙ্কার কালো মেঘে, যেন সূর্যের আলো সম্পূর্ণ ঢেকে গেছে। শিশুদের হাসির শব্দ, পাখির কিচিরমিচির সব যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মুহূর্ত গুনছে, কান পেতে আছে কোনো শুভ সংবাদ শোনার আশায়।
 
ষষ্ঠ দিনে এল দুঃসংবাদ। বন থেকে খবর এল, মৌমাছির আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। প্রথম খবরটা এল অসিতের। একটি বিকট চিৎকার শুনতে পেয়ে শ্যামলরা যখন ছুটে গিয়েছিল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অসিতের মুখের ওপর মৌমাছির কামড়ের চিহ্ন আর বিষে নীল হয়ে যাওয়া দেহ তার অসহায় মৃত্যুর কথা জানান দিচ্ছিল। অসিতের নাম যেন মুহূর্তেই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল, জীবনের পাতাগুলো ঝরে পড়ল অকালে। আশাপূর্ণার স্বপ্ন কাচের মতো টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। বুকের ভেতরের সব আশা যেন এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
 
বিশ্বনাথের রক্তমাখা লুঙ্গি খাঁড়িতে ভেসে উঠল, নিশ্চিত হলো তার পরিণতি। তার দেহ আর পাওয়া যায়নি। দক্ষিণরায়ের শিকার হয়েছে সে—যেন মৃত্যুর রক্তিম স্বাক্ষর আঁকা হলো নদীর জলে। আর তারপর এল বিনোদের খবর। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপ দিলেও কুমির তাকে অতলে টেনে নিয়েছিল। এই খবরটা যখন গ্রামে পৌঁছায়, কমলার বুকফাটা আর্তনাদে সুন্দরবনের বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। তার দুই শিশুসন্তান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের নিষ্পাপ চোখে ফুটে উঠেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া।
 
সেই রাতে গ্রামের শরৎ উৎসবের সব প্রস্তুতি থমকে গেল। মায়ের আগমনীর সুর যেন বিষাদের সুরে মিশে গেল। এখানকার উৎসব একটাই—শুধুমাত্র বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই আর সুদিন ফেরার অনন্ত অপেক্ষা। এই ভূমি যেন এক বিরাট শ্মশান, যেখানে জীবন কেবলই এক নিরন্তর সংগ্রাম। প্রকৃতির রোষ আর বন্য জীবনের কাছে মানুষ কতটা অসহায়, এই গল্প তারই এক মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি। শরৎ উৎসবের আনন্দ আর কোলাহল নয়, এই অমাবস্যায় নেমে এসেছিল জীবনের এক কঠিন নীরবতা।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)