বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
সীমা ব্যানার্জি-রায়
গুলন্দাজ
"প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পাশে বসে অস্টিন টেক্সাস থেকে ডালাস টেক্সাসে আসছিল। বিজনেস ক্লাসের সিট ফুল ছিল বলে নাকি স্ট্যান্ড বাই প্যাসেঞ্জার হিসেবে ইকোনমি ক্লাসে আসছিলেন প্রেসিডেন্ট ওর ঠিক পাশের সিটে বসে।"
সাত তাড়াতাড়ি বান্ধবীর বাড়িতে পটলাক পার্টিতে হাজির হলাম। আমিই তো ড্রাইভার তাই আমি সবসময় আগেভাগে পৌঁছে যাই। ধীরে ধীরে সবাই এসে পড়ল। পুজো এসে গেছে কাজেই সবাই বেশ খুশি খুশি মেজাজে। আর কয়েকদিন বাদে প্রবাসী বাঙালিরা শারদ মেলায় মেতে উঠবে।
প্যাটিওতে ছেলেদের
খাওয়াদাওয়ার শেষের দিকে এইবার আমরা বান্ধবীরা খেতে বসলাম খাবার নিয়ে। কেউ কেউ সোফা
সেটে পা তুলে, কেউ কেউ নিচে বসে পড়ল
সেন্টার টেবিলে খাবার নিয়ে। কেউ কেউ আবার সাহেবি কেতায় চেয়ারে
পায়ের ওপর পা তুলে হাতে ফর্ক নিয়ে। সবার রান্না বেশ সুস্বাদু হয়েছিল কি...ন্তু।
বান্ধবী আগেই কিছু রান্না করে রেখেছিল। আমি খাবার মুখে দিয়েই ভুলে বলে ফেলেছি,
-যে যাই বলুক, আমাদের এনআরআই নারীরা কিন্তু দ্রৌপদীকেও হার মানায়।
ভুল করে যে গরম তেলে ফোড়ন
দিয়ে ফেলেছি তা কী করে জানব। ব্যস শুরু হল তুইথুলি মুইথুলি। কেউ বলে উঠল,
-এই সেরেছে এক হাজব্যান্ডকে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি, আবার একসাথে পাঁচ-পাঁচজন?
সবাই তখন একজোট, আমি বেচারা অত জেনে বলিনি। তাও ওদের বুঝিয়ে বললাম,
-আমি বলতে চেয়েছি যে রান্নার গুণগত বিচার নিয়ে। দ্রৌপদী কি খালি পাঁচ হাজব্যান্ডকে
সামালাতেন নাকি রে? কত সুন্দরী ছিলেন, সবচেয়ে বেশি রন্ধন পটিয়সী ছিলেন সেই সূত্রে বলতে
চেয়েছি।
আসলে আমি কলকাতার বাইরে মানুষ
হওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে উতপটাং কথা বলে ফেলি। ঠিক করে গুছিয়ে বলতে
পারি না। যাই হোক, প্রসঙ্গ চেঞ্জ হল।
সবাই খাচ্ছি আর কে কে শাড়ির
বিজনেস করবে বা বিউটি পার্লার খুলবে এইসব নিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে। আমি খাচ্ছি আর
শুনছিও। হঠাৎ তমা ওরফে বিট্টির সাত বছরের ছেলে হামাগুড়ি দিতে দিতে মম-এর কাছে
ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। সেই মম নিচে খাচ্ছিল ছেলেকে দেখেই ঘড়ির কাঁটার মতন ক্লকওয়াইজ
রাইট টার্ন করে বলে উঠল,
-তুমি চিকেন খেয়েছ?
ডিড ইউ
টেক ইয়োর লাঞ্চ?
ছেলে হামাগুড়ি অবস্থাতেই...
“নোপ” বলেই আবার হামাগুড়ি দিতে দিতেই গণেশের মতো মম-এর
চারিদিকে প্রদক্ষিণ শুরু করে দিল।
-গ্রীন! কেন শুনি?
খাওনি? ইটস ইয়ামি ফুড। আর লিশন! চিকেনের মধ্যে কিন্তু ফুল প্রোটিন
আছে, ডু ইউ নো দ্যাট? গো ব্রিং সাম চিকেন। কুইক বেবি, আদারওয়াইজ আমি নিয়ে এসে খাইয়ে দেব কিন্তু।
মায়ের মুখে সবজান্তার হাসি
সবার দিকে চেয়ে।
-প্রোটিন না
খেলে চলবে বলো?
আমি অবাক। তারপর কারুর সাথে
লেগে গেল এই নিয়ে। না খাচ্ছে না খাক...এইরকম ছুনকো ছুনকো কথাবার্তা নিয়ে হাসিমশকরা ঝগড়া
থাকবেই একসাথে হলে।
সেদিন সময়মত সবাইকে 'বাই' জানিয়ে যে যার বাড়িতে
ফিরে এলাম। পরের দিন ৫ সেপ্টেম্বর কাজেই সবার ছুটি। একটু দেরি করেই উঠলাম
সবাই। সকালের ফোটোনিয়া গাছের ফাঁক থেকে শরতের নরম সূর্যের
আলো কফি টেবিলকে গুড মর্নিং জানাচ্ছে সাথে আমাদেরও। মনমেজাজ তুঙ্গে, ফুরফুরে। আমি কিচেনে ব্রেকফাস্ট রেডি করার সময় হঠাৎ
খুব হাসির আওয়াজ পেলাম আমার হাজব্যান্ডের । তিনি কফি টেবলে বসে সকালের আমেজে পেপার পড়ছিলেন। আমি ক্রোশেন (এক
ধরণের ক্রিস্পি প্যাস্ট্রি), কন্টিনেন্টাল ওমলেট, অরেঞ্জ জ্যুস, ক্রিস্পি বেকান, ওয়াফেল উইথ সিরাপ। আর সাথে কোল্ড ক্যাপুচিনো নিয়ে হাজির
হলাম। হেভি ব্রেকফাস্ট যাকে বলে।
আমি এসে ওনাকে হাসতে দেখে
জিজ্ঞেস করলাম,
-এত জোরে হাসছ কেন?
কী হলো
আবার।
এই কথা শুনে ওনার তো হাসি আর
বন্ধ হয় না। একটু রাগ হল আমার, আবার জিজ্ঞেস করলাম,
-আশ্চর্য! কী ব্যাপার?
কী
হয়েছে বলবে তো?
তখন বলেন,
-দাঁড়াও আগে গলাটা ভিজিয়ে নিই... তারপর বলছি।
একটু ক্যাপুচিনোতে গলা ভিজিয়ে,
-জানো তো! কালকে যখন তোমার বান্ধবীর বাড়ির প্যাটিওতে
বসেছিলাম আমরা। বিটির হাজব্যান্ড বলছিল যে, চারদিন আগে সে নাকি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পাশে বসে অস্টিন টেক্সাস থেকে
ডালাস টেক্সাসে আসছিল। বিজনেস ক্লাসের সিট ফুল ছিল বলে নাকি স্ট্যান্ড বাই প্যাসেঞ্জার
হিসেবে ইকোনমি ক্লাসে আসছিলেন প্রেসিডেন্ট ওর ঠিক পাশের সিটে বসে। হা হা হা! তাও
আবার জানলার লাগোয়া সিটে।
এইটুকু শুনে আমি প্রায় চেয়ার
থেকে উলটে পড়ে যাবার জোগাড়। যে দেশে প্রেসিডেন্টের জন্য আলাদা প্লেন (এয়ারফোর্স
ওয়ান) থাকে এমনকি তাঁর ফ্যামিলিরাও সেই প্লেন ছাড়া অন্য প্লেনে চড়ার অধিকার পান
না। সেখানে ইকোনমি ক্লাসে তাও আবার স্টান্ড বাইতে যাচ্ছেন।
হাসি শেষ আর হয় না। ঠিক সেইসময় আমার ছোরদির ফোন আসাতে তাকেও যেই না বলেছি, তারও হাসির চোটে দুবার ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে
গেছিল। হাজব্যান্ড বললেন,
-উফফস, পুরোটা শোনো, ছোরদিকেও মেসেজ অন করে দাও। আমি বলি আগে- তোমরা শোনো। পরে
হেসো। খেই হারিয়ে যাচ্ছি তো।
আমি বলে উঠলাম,
-বানিয়ে বলছ না তো?
বলে,
-না, জিজ্ঞেস কোরো অন্যান্যদের। এত বুদ্ধি আমার নেই যে, এত সুন্দর করে আবহাওয়াটাকে সাইলেন্টে রাখব।
-আচ্ছা, বলো বাকিটা। খুব
ইন্টারেস্টিং তো। কেউ কোনরকম প্রশ্ন করেনি?
তোমরা
কেউ হাসছিলে না?
-না। হাসলে তো তার তাল কেটে যাবে। এয়ারহোস্টেস আসলে তার কাছে
কোক উইথ আইস চাইলেন। কিন্তু তখন কোক শেষ হয়ে গেছে তাই কোকের বদলে হার্বাল টী
চাইলেন ওবামা। তারপর আমার সাথে নানান গল্প জুড়ে দিলেন।
-কী ধরনের গল্প?
আমরা জিজ্ঞেস করলাম।
-বলছি। মুখ কাঁচুমাচু করে ওবামা আমাকে বললেন যে— এক বছর পরেই আমার টার্ণ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী যে হবে হেলথ
রিফর্ম নিয়ে।
এই শুনে আর পারিনি, ক্যাপুচিনো হাত থেকে ফোনের সারা গায়ে মাখামাখি করছে তখন।
ওদিকে নিউ ইয়র্কের থেকে ছোরদি বলে, এবার রাখছি রে। পেটে
ব্যথা করছে হাসতে হাসতে। পারে বটে বিখ্যাত গুলন্দাজ গ্রিনকার্ড
বিহিত বাঙালি। সকালটা যেন মুচমুচে করে দিল হাজব্যান্ড। এইরকম
মুচমুচে জবর খবর কে না চায়? আর এই জবর খবর পেতে
হলে গ্রুপ মিটিং, গ্রুপ ইটিং, গ্রুপ চ্যাটিংএ হাজির হতে হবে। এইভাবে বেশ টক-মিস্টি-ঝালের
গুরুত্ব এনআরআই বাঙালিরা পুজোর তিনদিন যাবৎ উপভোগ করে তুবড়ি আড্ডায়... সাথে থাকে
শাড়ি, গয়না, শেয়ার, পলিটিক্স আ...র? আর সেই সর্ব বিখ্যাত পরনিন্দা পরচর্চা! কাজেই বেশ
আনন্দমুখরিত হয় এই মিলনমেলা, তাতে সন্দেহ নেই। তে
আমো বাঙালি!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment