বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
স্বপন
জায়দার
চতুর্থীর
ছায়া
"জায়দার বাড়ির সাতানব্বই বছরের বৃদ্ধ অমলেশ জায়দার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই বাড়ির চতুর্থ বৌমা রাধারানি, পঞ্চাশ বছর আগে চতুর্থীর রাতেই নিখোঁজ হয়েছিলেন। তখনও লাল শাড়িতে সাজানো ছিল। আজও তার দেহ মেলেনি।"
আমাকে দেখেই মা বললেন,
-কী ব্যাপার বাবু এত সকাল সকাল স্নান করলি? কোথাও বেরচ্ছিস?
আমি তোয়ালেটা মেলতে মেলতে
বললাম,
-প্রতি বছরই তো কলকাতার দুর্গাপুজোয় অবাক করা
সুন্দর শিল্পীর কারুকার্য মন্ডিত পুজো প্যান্ডেল দেখি। তাই এবার ঠিক করলাম এই
ছন্দের ব্যতিক্রম ঘটান হবে আর তারই উদ্দেশ্যে গ্রামের দুর্গাপুজোর আনন্দ উপভোগ
করব। এ কথা ভেবেই মামার বাড়ি যাচ্ছি।
-তোর কি ভাল লাগবে?
ওখানে
কিন্ত বেশি পুজো হয় না, তাবলে যেটা হয়, সেটা দশ-বারোটা গ্রামের মানুষদের প্রাণের পুজো, ভক্তির পুজো।
-আমাদের এখানে পুজোর থেকে আড়ম্বর বেশি।
-জায়দার বাড়ির দুর্গাপুজোটা মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে।
-মানে?
-সে তুই
বিশ্বাস করবি না। তুই যখন যাচ্ছিস ওখানে গিয়ে সমস্তটা জেনে নিস।
-কোন ভৌতিক বা
অলৌকিক ব্যাপার আছে নাকি?
-জানি না বাপু।
অজানা কারণ তোরা শহরের ছেলে দু-পাতা বিজ্ঞান পড়ে এসবকে বিশ্বাস করিস না। আমার
সাথে তর্ক বেধে যাবে তার থেকে তুই তো যাচ্ছিসই সেই অলৌকিক বল বা ভৌতিক বল। আর
হ্যাঁ কেউ কোথাও যেতে নিষেধ করলে মানিস। সে কথাগুলো একটু শুনিস কারণ অচেনা অজানা
জায়গা কোথায় কোন বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে।
-তোমার কোন
চিন্তা নেই মা আমি সুস্থ শরীরে তোমার সামনে একাদশীর দিন হাজির হচ্ছি।
মছলন্দপুর ষ্টেশন থেকে নেমে
ট্রলি ভ্যান চেপে পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে যে গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যাবে তার নাম
চারঘাট। হ্যাঁ এটাই আমার মামার বাড়ির গ্রাম। মামাতো ভাই চন্দর এবং দাদারা সবাই
খুব অবাক হয়ে গেল বলল,
-কী ব্যাপার! শহরের বাবু এবার দুর্গাপূজায় আমাদের গ্রামে?
আমি বললাম,
-সবরকম আনন্দই তো উপভোগ করা উচিত। তাই চলে এলাম।
মামাতো ভাই বলল,
-আমাদের এখানে একটাই পুজো হয়। জমিদার বাড়িতে। দশ-বারোটা গ্রাম
মিলে ওই জমিদার বাড়ির পুজোর আনন্দ উপভোগ করে থাকি। প্রায় একশো বছরের পুরনো পুজো।
মামা বসে বসে আমাদের কথা
শুনছিলেন সহসা বলে উঠলেন,
-জায়দার বাড়ির দুর্গাপুজো।
আসলে জায়দার কোনও পদবি নয় অনেক জমি থাকার ফলে জমিদারি
পরিচালনার জন্য এই উপাধিটা তারা পেয়েছিলেন ওদের পদবি ছিল বর্মন। সেই থেকেই ওই বংশের আসল পদবি বদলে গিয়ে
এটাই দাঁড়িয়েছে আর সেই থেকেই বলা হয়। জায়দার বাড়ির দুর্গাপুজো।
পাশ থেকে মামাতো বোন জয়া বলে
ওঠে,
-জানিস তো দাদা ঘোষপুরে এ বছর একটা পুজো হচ্ছে। আমায় নিয়ে
যাবি।
চন্দর বলল,
-সে তো অনেক দূর। দাদা অত হাঁটতে পারবে না।
আমি বললাম,
-ঠিক আছে
সাইকেল করে আমরা যাব চতুর্থীর দিন।
চন্দর বলল,
-চতুর্থীর দিন যাওয়া ঠিক হবে না, ফিরতে রাত হলে মুশকিল হবে।
আমি বললাম,
-কেন?
মামা বললেন,
-সে অনেক কথা আসলে ঘোষপুর যেতে গেলে ওই অভিশপ্ত জমিদার
বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হবে আর বেশি রাত হয়ে গেলে অসুবিধা আছে।
আমি বললাম,
-কেন কী অসুবিধা আছে বলো না মামা।
মামা বলতে শুরু করলেন,
-প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের ঘটনা। তারপর থেকেই চতুর্থীর
রাতে ওই জায়দার বাড়িতে নাকি সে আসে। তাই আমারা চতুর্থীর রাতে তাড়াতাড়ি ঘরে
চলে আসি। আর ভুলেও ওই জায়দার বাড়ির দিকে যাই না।
-মামা, সে আসে মানে কে তিনি? যদি না বলো, কাল আমি একাই ওই বাড়িতে যাব, বুজরুকি বন্ধ করতে।
-গ্রামের
মানুষদের সংস্কার বদলানো কঠিন,
তুমি এ
গ্রামে দু দিন বেড়াতে এসেছ কেন অহেতুক ঝামেলায় জড়াবে।
-অলৌকিক জিনিস
আমি বিশ্বাস করি না যত অলৌকিক আছে তার পেছনে লৌকিক কারণ থাকবেই।
-জায়দার বাড়ির
দুর্গাপুজো এখানে একটি রীতিমতো উৎসব,
যেখানে
শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন আসে,
বাজে
ঢাক, চলে আরতির সাজসজ্জা। কিন্তু সেই বছরের
চতুর্থীর রাতটা যেন কিছুটা আলাদা ছিল। শান্তিনিকেতন থেকে এসেছিল বাড়ির ছোটবউমা শ্রেয়া,
প্রথমবারের
মতো পূজোর আয়োজন দেখছিল। সেই রাতে তার ঘুম আসছিল না। হঠাৎ করেই সে বারান্দায়
দাঁড়িয়ে দেখতে পেল একটি ছায়ামূর্তি, লাল শাড়ি পরা, পুজোর সাজে,
ধীরে
ধীরে উঠোনের মধ্য দিয়ে হাঁটছে। মাথায় খোঁপা,
কিন্তু
মুখটা ঘোমটার আড়ালে। শ্রেয়া চিৎকার করে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই আর কাউকেই দেখতে পেল না। সবাই বলল, ভয়ের কিছু নেই,
হয়তো
চোখের ভুল। কিন্তু পরদিন সকালে মণ্ডপে ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা, মা দুর্গার
প্রতিমার ডান চোখে লাল রংয়ের দাগ, যেন কেউ রক্ত লাগিয়ে দিয়েছে! পুরোহিত মশাই বললেন, ‘এটা অশুভ লক্ষণ,
কারো
আত্মা মুক্তি পাচ্ছে না।’ জায়দার বাড়ির সাতানব্বই বছরের বৃদ্ধ অমলেশ জায়দার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই বাড়ির চতুর্থ বৌমা রাধারানি,
পঞ্চাশ
বছর আগে চতুর্থীর রাতেই নিখোঁজ হয়েছিলেন। তখনও লাল শাড়িতে সাজানো ছিল। আজও তার দেহ
মেলেনি। হয়তো সেই আত্মার…’ শ্রেয়া এবার বুঝতে পারল, সেই ছায়াটা কেবল কল্পনা নয়। পরদিন রাতে সে আবার বারান্দায়
দাঁড়িয়ে রইল দেখল সেই একই ছায়া। এবার সাহস করে বলল, ‘আপনি কি রাধারানি দেবী? আপনি কি কিছু বলতে
চান?’ ছায়াটা থেমে দাঁড়াল। মৃদু
গলায় ভেসে এল, ‘আমার ন্যায় বিচার প্রয়োজন…
আমাকে কে শেষ করেছিল, সেটা জানো তুমি.. যাও
দুর্গামণ্ডপের পেছনের ঘরে।’ শ্রেয়া হতভম্ব। পরদিন এক পুরনো চিঠি, যা শ্রেয়া দুর্গামণ্ডপের পেছনের ঘরে খুঁজে পায়, তাতে লেখা— ‘রাধারানি জানত আমার
গোপন কথা। তাই তাকে সরাতেই হলো।’ বুঝল, তার স্বামীর কাকা,
যারা
এখনও বাড়িতে আছে, তাদের কেউ এই রহস্যের
সঙ্গে জড়িত। শ্রেয়া সেই চিঠি নিয়ে বাড়ির বড়দের সামনে হাজির হয়। সবার সামনে পর্দা
ফাঁস হল— তার স্বামীর এক কাকা,
যিনি
তখনকার দিনে সম্পত্তির লোভে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ছিলেন। চতুর্থীর রাতের সেই ছায়া
এবার শেষবারের মতো দেখা দেয়। মা দুর্গার প্রতিমার চোখ থেকে রক্তের দাগ আপনা থেকেই
মুছে যায়। শ্রেয়া ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে নামতে নামতে বুঝল— ওই বছর
দুর্গাপুজোয় সত্যিই ‘অসুর বধ’ হয়েছিল,
কিন্তু
এক নতুন অর্থে।
মামার কথা শুনে, আর মায়ের নিষেধাজ্ঞা মনে পড়ল। তাই আর চতুর্থীর রাতে
বাড়িতেই রইলাম।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment