প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Friday, September 12, 2025

মা যেসব চিঠি লিখে রাখেনি [২য় পর্ব] | ইন্দ্রজিৎ রায়

বাতায়ন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২তম সংখ্যা/৩রা আশ্বিন, ১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
ইন্দ্রজিৎ রায়
 
মা যেসব চিঠি লিখে রাখেনি
[২য় পর্ব]

"আমার মাথার ভেতরটা আজও ভাবলে ঝিমঝিম করেমা'র গলা শুনতে পাই কুরবানকে আমি বিয়ে করব কোনও সমস্যা আছে?’ আর আমি ভাবি যতগুলো রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লুমপেনকে আমার রোগাবড় বড় চোখের মা একাই ঠেকিয়ে দিয়েছে।"


পূর্বানুবৃত্তি ৭০ দশক অতিক্রান্ত সময়ে নানানরকম সামাজিক ছালবাকলা উঠে গেছে, নতুন গাছের চারা বেরিয়েছে। স্কুল থেকে ফিরে দেখি আমাদের বাড়িতে অনেক লোক। দেখি কতজন চোয়াড়ে মার্কা লোকাল নেতার সামনে, আমার রোগা চেহারার মা, বড় বড়, টানা চোখের মা দাঁড়িয়ে আছে এবং শান্ত, তার একটু দূরে কুরবান। তারপর…
 

যে সংলাপ আমি শুনেছিলাম তা কিছুটা এরকম
-এটা কিন্তু ভদ্রলোকের পাড়া। এখানে এসব চলবে না আমরা কিন্তু, এটা এসব চলতে দেবো না।

মা সেই মস্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কুরবানকে আমি বিয়ে করব, তোমাদের কোন সমস্যা আছে?
৭০ দশকের পরিবেশে, যার স্বামী মিলিটারিতে চাকরি করে, সে বাপের বাড়িতে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকে, তার কাছে এমন সংলাপ লুচি মস্তান আশা করেনি একটু তোতলে যায়।
-মানে? বিয়ে করবেন মানে?
মা আবারও স্পষ্ট উচ্চারণ করেন,
-বললাম তো কুরবানকে বিয়ে করব আমি। কোনও সমস্যা আছে?
এবারে লুচির পাশের মালপোয়া বলে ওঠে
-আমরা কিন্তু জামাইবাবুকে বলে দেব, সব খবর দিয়ে দেব।
জামাইবাবু অর্থে আমার বাবা। মা আবারও শান্ত গলায় বললেন,
-যখন আসবেন তখন বলবে
এখন কেটে পড়ো- কেটে পড়াটা মুখে বললেন না। শরীরি ভাষাতে বুঝিয়ে দিলেন।
সত্তর অতিক্রান্ত দশকের সেই ফুটো মস্তানরা পায়ে পায়ে কেটে পড়ে। আমার মাথার ভেতরটা আজও ভাবলে ঝিমঝিম করে, মা'র গলা শুনতে পাই কুরবানকে আমি বিয়ে করব কোনও সমস্যা আছে?’ আর আমি ভাবি যতগুলো রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লুমপেনকে আমার রোগা, বড় বড় চোখের মা একাই ঠেকিয়ে দিয়েছে। শরতের বিষটা কমে আসে। আমি স্বপ্নে দেখি কুরবান হয়তো কৃষ্ণবান হতে পারে, হয়তো কারিয়াপ্পা, হতে পারে কিন্তু সে বেটা মূর্তিকার - রাতের গভীরে মেঘের ভেতরে একটা কারখানা দেখতে পাই মৃন্ময়ীর কারখানা, মাটির, আর তার মাঝখানে দেখি কুরবান, কারিয়াপ্পা, কৃষ্ণবান সেই মূর্তিকার হাঁ করে আমার মার মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রোগা, বড় বড় চোখের মা, মাঝখানে দাঁড়িয়ে, চারপাশে কোন রাজনৈতিক দলের লুম্পেন, তারা মা'র দিকে তাকিয়ে এগোতে পারছে না, ত্রাসে, কুরবানের হাতে নুরুন, সে আস্তে আস্তে, কেটে কেটে আমার মায়ের আঙুলগুলো তৈরি করছে। মা'র আমার অত বড় চুল, এত সুন্দর দেখতে আঙুলগুলো কুরবান কেটে কেটে তৈরি করছে। লুমপেনগুলো বলছে এটা ভদ্রলোকের পাড়া আমরা এসব হতে দেব না, আসলে বেশি চাঁদা আদায় করার জন্যই এসব, আর মা তাদের দিকে তাকিয়ে বলছেন, আবে ফোট, কুরবানকে আমি বিয়ে করব তোর কিছু সমস্যা আছে...
 
কুরবান অথবা কৃষ্ণবান, নাকি কারিয়াপ্পা, আমার মায়ের প্রেমিক ছিল, হয়তো এখনও আছে, আমাকে চোখে হারাত মা, হয়তো এখন হারায়। মেঘ ও তারার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে, এক হাতে মা সংসার ধরে আছে, অন্য হাতে কুরবান আর আর চোখে যত লুম্পেন মাস্তান আর আমাকে পয়সা দিতে চাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের দিকে তাকিয়ে বলছে, ওকে পয়সা দেবে না, একটা বাচ্চার হৃদয়কে পয়সা দিয়ে নষ্ট করবে না একদম। হঠাৎ বুঝতে পারি যে শহর আমাকে শরতের যত বিষ দিয়েছিল, বিষগুলো গলে গেছে টপটপ করে গরম বিষ চোখ দিয়ে পড়ছে জামায়, প্যান্টে, সামনে তাকিয়ে দেখি রাস্তাটা ফাঁকা নেই আর, রাস্তাটা ফাঁকা নেই, গাদা গাদা খুপরি বাড়ি হয়েছে, জঘন্য, কিন্তু সে রাস্তা, তার শেষে... না, বাকিটা আর বলতে চাই না। বললে সেটা সিনেমার মতো শোনাবে। সেটা লিখতে আমি আসিনি।
 
শরৎ তার রূপ, তার ঢাকের বাজনা, উৎসব শেষের খাঁ খাঁ মাঠগুলোর আমার চোখের সামনে ঘুরতে থাকে, আমি বুঝি মূল্য কী এসবের- রাস্তার শেষে মেঘের, মেঘের ভেলার, ঘুমোতে দাও তরুবর, হলুদ অর্জুন, দেবদ্বার, ঘুমোতে দাও। হলুদ সরকারি দপ্তর, কালচে নীল সাইনবোর্ড কাঁদছে আমার সঙ্গেই প্রায়, চারদিকে শরীর আর শরীর, দু দিনের মাঝি, কালো জল ঘুমোতে দাও, মনিহারির দোকান ভাঙা পাঁচিল, গদাইয়ের মিষ্টি দোকান, নষ্টমেলা ক্লাব এখন লাল ছেড়ে হলুদ, ঘুমোতে দাও গদাই, দুলমির নির্জন বাতাস, যা আমার ফুসফুসে আটকে আছে কোথাও এতগুলো বছর, ঘুমোতে দাও ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩২, ঘুমোতে দাও- সোনে দে হারামজাদে--এ...
 
কে? গব্বর সিং নাকি? বোঝা যায় না। মাতৃপূজা হয় এখানে শুনতে পাই। আসলে বৌতলিক পুজোর আয়োজন। দূরে, আলো আর বাঁশ দেখতে পেয়ে, সেদিকে হাঁটতে থাকি। জানি হবে না দেখা, তবু পা আমাকে টেনে নিয়ে যায় শরতের অন্ধকার নেমে আসা জঙ্গলে। রোগা, বড় বড় চোখ মা'র জন্য।
 
সমাপ্ত

2 comments:

  1. এটা পড়ে কত লেখা যে মাথায় এলো আমার । ভীষণ স্মার্ট আপনার লেখা ইন্দ্রজিৎ রায়।

    ReplyDelete

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)