বাতায়ন/শারদ/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | প্রবন্ধ
রুচিরা সাহা
বীরাঙ্গনা
"রানি লক্ষ্মীবাঈ ঘোড়ায় বসে লাগামের রশ্মি দাঁতে চেপে দু-হাতে তরোয়াল দিয়ে এক এক করে ইংরেজ সেনাদের মারতে থাকেন। অত্যন্ত পরাক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে দিশেহারা হয়ে পরে ইংরেজ সৈন্যরা।"
উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলার গঙ্গানদীর তীরে অবস্থিত মনিকর্নিকা ঘাট। ১৮২৮ সালের ১৯শে নভেম্বর করহাদ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। যেহেতু মনিকর্নিকা ঘাটের কাছে তাঁর জন্ম। সেই অনুসারে তাঁর নামকরণ করা হয় মনিকর্নিকা। পিতা মরুপান্তে তাম্বে, মাতা ভাগীরথী বাঈ।
মনিকর্নিকাকে মনু নামেই ডাকা
হত। তাঁর বয়স যখন মাত্র চার বছর মাতৃহারা হন তিনি। তাঁর পিতা বিথুরের পেশোয়ার
দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের অধীনে কাজ করতেন। সেইসময় মারাঠা মন্ত্রীসভার প্রধানকে পেশোয়ার
বলা হত। পেশোয়ার মনুকে নিজের কন্যার মতোই পালন করেন। আদর করে পেশোয়ার তাঁকে ছাবেলি
বলেও ডাকতেন। এই ছাবেলি শব্দটির অর্থ হল ক্রীড়াপ্রেমী সুন্দরী কন্যা। সেই সময়ের
সাধারণ মহিলাদের তুলনায় মনিকর্নিকা অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন। তিনি আত্মরক্ষামূলক
শিক্ষার পাশাপাশি বাল্য বন্ধু নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপীর সাথে ঘোড়া চালানো, তরবারি খেলা, তীর ছোঁড়া শেখেন। তিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখতেন।
অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। মনিকর্ণিকা তিনটি ঘোড়ায় সওয়ার করতেন সাড়েঙ্গি, পবন আর বাদল। ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়ালকারের প্রথম
স্ত্রী রমা বাঈ মারা যান। ঝাঁসির উত্তরাধিকারীর জন্য তিনি আবার দ্বিতীয় বিবাহ করতে
বাধ্য হন। ১৮৪২ সালে মনিকর্নিকার সাথে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের সম্পর্ক রাজারানির মধ্যেই
সীমাবদ্ধ ছিল। ঝাঁসি ছিল উত্তরপ্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এই ঝাঁসিকে বুন্দেল
খন্ডের দরজা বলা হত। বিবাহের পরে মনিকর্নিকার নাম হয় লক্ষ্মীবাঈ। রানি লক্ষ্মীবাঈ ১৮৫১ সালে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ঝাঁসির সেই
উত্তরাধিকারীর নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু মাত্র চার মাস বয়সে সন্তানটি মারা
যায়। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ আজও অজানা। পুত্রশোকগ্রস্থ গঙ্গাধর রাও তাঁর জ্যাঠতুতো
দাদার ছেলে আনন্দ রাওকে দত্তক নেন। কিন্তু গঙ্গাধর রাও নিজ পুত্রশোকে ধীরে ধীরে
অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর সুস্থ হলেন না। দুবছর পরে ১৮৫৩ সালের ২১শে নভেম্বর তিনি মারা
যান। গঙ্গাধর রাও মারা যাবার একদিন আগে আনন্দ রাওয়ের নামকরণ করা হয় দামোদর রাও
নামে। রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের উপরে ঝাঁসির দায়ভার এসে পড়ে। তিনি ছোট দামোদর রাওকে নিয়েই ঝাঁসির সিংহাসনে বসেন। প্রতিদিন
তিনি প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা, অভাব অভিযোগ শুনতেন।
যে-কোনো বিষয় তিনি সহজে উপলব্ধি করতে পারতেন। তাঁর সভার
লোকেরা তাঁর সাক্ষাৎ পেতেন না। কারণ তাঁর বসার ঘরটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সেটি দিয়ে
শুধু দরবারেই যাওয়া যেত। যে ক-বছর তিনি ঝাঁসির রাজপাট
সামলেছেন প্রজাদের মধ্যে সুখশান্তি বজায় ছিল। তিনি মহিলাদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন
করেন। তাঁদের অস্ত্র শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। রানি
লক্ষ্মীবাঈ খুব ভোরে উঠে সুগন্ধি জলে স্নান সেরে প্রাথর্না করে মহালক্ষী মন্দিরে
যেতন ঘোড়ায় চড়ে। এই পথেই পড়ত তাঁর স্বামী গঙ্গাধর রাওয়ের সমাধি। লক্ষ্মীবাঈ দেখতে
অসাধারণ সুন্দরী নারী ছিলেন। তিনি ছিলেন নাতিদীর্ঘ। টিকালো নাক, টানা টানা চোখ। গায়ের রং ফর্সা ছিল না তবে আবার কৃষ্ণাঙ্গীও
ছিলেন না। গঙ্গাধর মারা যাওয়ার পরে তিনি বিশেষ অলংকার পড়তেন না। কানে দুল, হাতে হীরের বালা,
গলায়
ছোট একটা মুক্তার মালা, আর কনিষ্ঠা আঙুলে
একটি হীরের আংটি। তিনি সাদা মিহি চান্দেরি শাড়ি পড়তেন। রানি লক্ষ্মীবাঈ
প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতদিন ইংরেজদের তাড়াতে না পারবেন ততদিন তিনি চুল কাটবেন না। আনন্দ
রাওকে দত্তক নেওয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বত্তবিলোপ নীতি প্রয়োগ করে ঝাঁসি
রাজ্যের উপর। ১৮৫৪ সালে রানির নামে ভারতীয় মূল্যে বার্ষিক
ষাট হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়। এবং ঝাঁসির সাম্রাজ্য ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া
হয়। এতে তিনি অত্যন্ত অসম্মান বোধ করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ পড়েছিল
ঝাঁসির উপর। পলাশী যুদ্ধের একশো বছর পূর্ণ হতেই ভারতের অনেক রাজ্য ইংরেজদের দখলে
চলে যায়। কারণ অধিকাংশ রাজাই কাপুরুষের মতো ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
প্রজাদের উপর চলত অমানবিক অত্যাচার। সেইসময় একমাত্র লক্ষ্মীবাঈ ইংরেজদের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ান। মাত্র বাইশ বছরের এই বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী বাঈ প্রথম স্বাধীনতা
সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। ইংরেজ সেনা যখন
ঝাঁসি আক্রমণ করে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন আমি আমার ঝাঁসি কাউকে দেব না, কেউ আমার কাছ থেকে
ঝাঁসি কেড়ে নিতে পারবে না, যার সাহস আছে সে
চেষ্টা করুক। হলুদ আর কুমকুম অনুষ্ঠানে মহিলারা শপথ নেন যে তাঁরা শেষ রক্ত বিন্দু
দিয়ে যুদ্ধে লড়াই করবেন। ১০ই মে ১৮৫৭ মিরাটে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে
সাদা জামা আর পাজামা পড়ে পিঠে ছোট দামোদরকে বেঁধে দু-হাতে তরোয়াল
দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের আঘাত করতে থাকেন আর রণহুংকারে মনোবল
হারানো ভারতীয় যোদ্ধাদের সাহস যোগান। কিন্তু প্রচণ্ড সূর্যের
তাপ আর ইংরেজদের উন্নত মানের অস্ত্রের কাছে ভারতীয় সেনারা পরাজিত হতে থাকেন। এদিকে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ঝাঁসির দুর্গের দরজা কামান দিয়ে ভাঙতে ব্যস্ত নিজের পরাজয়
নিশ্চিত জেনে রানি দামোদরকে পিঠে বেঁধে রাতের অন্ধকারে
দুর্গের উঁচু প্রাচীর থেকে লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চেপে কল্পিতে পৌঁছান। সেখানে অন্যান্য
বিদ্রোহী এবং তাঁতিয়া টোপীর সাথে গোয়ালিওর-এর উদ্দেশ্যে রওনা
দেন এবং গোয়ালিওর দখল করেন। কিন্তু এই জয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। ইংরেজরা তখন এক অত্যন্ত
পরাক্রমশালী হিউস রোসকে পাঠান। ১৮৫৮ সালের ১৭ই জুন কোটাহ-কি-সেরাই ফুলবাগ। প্রচণ্ড গরম, মধ্যাহ্নের সূর্যের
আলোয় অস্ত্রশস্ত্রগুলি চকচক করছে। হিউস রোসের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনারা ফুলবাগের
ছাউনিতে ঢুকে পরে। রানি লক্ষ্মীবাঈ ঘোড়ায় বসে লাগামের রশ্মি
দাঁতে চেপে দু-হাতে তরোয়াল দিয়ে এক এক করে ইংরেজ সেনাদের
মারতে থাকেন। অত্যন্ত পরাক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে দিশেহারা
হয়ে পরে ইংরেজ সৈন্যরা। তখন হিউস রোস এক দল উট ছেড়ে দেয় যুদ্ধক্ষেত্রে। সাময়িকভাবে
ভারতীয় সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রঘুনাথ সিং সেখান থেকে রানি লক্ষ্মীবাঈ ও তাঁর সহচরী মন্দারকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এগোতেই
মন্দার গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান। হঠাৎই রানির কপালে তরবারির
আঘাত এবং বুকের বাম দিকে গুলি লাগে। এই বীরাঙ্গনা তখন তাঁর ঘোড়ার উপরই উপুড় হয়ে
পড়েন। তখনও প্রাণ ছিল। গুলমোহাম্মদ,
গনপৎ
রাও রঘুনাথ সিং-এর সহায়তায় রানি লক্ষ্মীবাঈকে ফুলবাগের একটি
পরিত্যক্ত বাড়িতে আনা হয়। সেখানে একটি গাছের নিচে ঘাসের উপর তাঁকে শোয়ানো হয়।
রঘুনাথ সিংই দাহকার্য সম্পন্ন করে অনাথ দামোদর রাওকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান। রানির মৃত্যুর পরে সিপাহী বিদ্রোহের অবসান ঘটে। আজও ঝাঁসির লোকেদের বিশ্বাস রানি দুর্গের পাথরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে যদি সারা
ভারতের সব রাজ্যগুলো একসাথে যুদ্ধ বা বিদ্রোহ ঘোষণা করত তাহলে হয়তো সেইসময় স্বাধীন
হয়ে যেত ভারতবর্ষ। তবে সময়ের পরিবর্তন হবে, যুগের পরিবর্তন হবে কিন্তু, বীরাঙ্গনা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ
ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আজও তিনিই নারী জাতির
অনুপ্রেরণা।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment