বাতায়ন/শারদ/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ধারাবাহিক গল্প
ইন্দ্রজিৎ
রায়
মা
যেসব চিঠি লিখে রাখেনি
[১ম পর্ব]
"বিয়ে নিয়ে এখন ভাবি না আরেকটা কথাও মনে পড়ে। আমাকে কেউ পয়সাকড়ি দিলে মা খেপে যেত, আত্মীয়স্বজন পুজো-পার্বণে পয়সা দিলে বলত পয়সা দিচ্ছ কেন, তোমাদের যদি কিছু দিতে ইচ্ছে করে, ওকে কিনে দাও। বাচ্চাদের হাতে পয়সা দেবে না।"
কুরবান আমার মার প্রেমিক ছিল, অবশ্য ছিলেন বলতেও আমি রাজি। কিন্তু কুরবান মামা বা কুরবান
কাকা এগুলো বলতে কীরকম একটা
লাগে না, কুরবান নামটার সাথে
মামা-কাকা-দাদা ঠিক যায় না। ওদিকে রূপবান পুরুষ ছিল কুরবান, আমি যে বয়সটাতে ওনাকে দেখেছি, তখনও মাকে নিয়ে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার বয়স আমার হয়নি। আর হলেও সেটা কুরবানকে নিয়ে হত না কারণ
কুরবানের মতো পুরুষের প্রেমে না পড়াটাই তো অদ্ভুত, তবে আজ বুঝতে পারি কুরবানের চোখে আমার মা-র প্রতি মুগ্ধতা ছিল ঠিকই তবে আমার মা-র চোখে ঠিক সেইরকম একটা কৃতার্থ
পোষ্যর ভাব কিন্তু ছিল না। খুব পরিষ্কার মনের মানুষ ছিলেন মা, নির্মমভাবে সৎ,
নিজের
ভাল লাগাকে কখনও আড়াল করতে দেখিনি মাকে। সাধ্যের থেকে বেশি পয়সার ইংরেজি স্কুলে আমাকে
পড়িয়ে ছিলেন (আজ লক্ষ্য করলাম যতবার আমাকে কথাটা লিখি তার মধ্যে মা ঢুকে থাকে!) এবং যথারীতি এসব স্কুলে পড়ার ফলে আমারও অল্প
বয়সে পোঙা পেকে যায়।
অল্প বয়সে পোঙা পেকে
যাওয়ার ফলে আমি মানুষদের
সম্পর্কে নানান কথা জানতে থাকি। কিন্তু সে যাইহোক কুরবান কাকা বা মামা বলে ডাকতে, আমার কখনোই ভাল লাগত না। আমাকে তিরধনুক, ক্রিকেট ব্যাট-বল, উইকেট, চকোলেট, বই, কত কী এনে দিত।
পুরুলিয়া শহরে ভাল ব্যবসা ছিল কুরবানের। একদিন মাকে বলতে শুনেছিলাম, আমার মেয়েগুলো তো বড় হয়ে গেল দেখতে দেখতে, তোমার ছেলেকে বলো তিরধনুক নিয়ে না ঘুরে, একটু বড়সড় শিকার করতে, বলে খুব হেসেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই
মা
কথাটা কেটে বলেছিলেন না না, এসবের মধ্যে ওরকম
বিয়ে তাড়াতাড়ি হবে না সোনাইর (আমার ডাকনাম)। বিয়ে নিয়ে এখন ভাবি
না আরেকটা কথাও মনে পড়ে। আমাকে কেউ পয়সাকড়ি দিলে মা খেপে যেত, আত্মীয়স্বজন পুজো-পার্বণে পয়সা দিলে বলত পয়সা দিচ্ছ কেন, তোমাদের যদি কিছু দিতে ইচ্ছে করে,
ওকে
কিনে দাও। বাচ্চাদের হাতে পয়সা দেবে না।
এই কথাটার অর্থ আজ বুঝতে পারি, আজ বুঝতে পারি কেন মা চাইতেন না কেউ পয়সা দিক। যেমন আ হা
বলে একটা ব্যান্ড ছিল তখন। ওরকম ব্যান্ড খুব কমই দেখেছি। আমি এখনো আ হা-র গান শুনি
টেক মি অন্, সিকামোর্ লীভস্। রূপবান
পুরুষ ছিল কুরবান বা এখনও আছে হয়তো, আমার তো বহুবছর ওই
শহরে যাওয়া হয় না। দুধ-সবজির ব্যবসা ছিল কুরবানদের পারিবারিক, বড় বড় স্কুল, ওই সৈনিক স্কুল,
রামকৃষ্ণ
মিশন, সেখানে দুধ-ঘি-সবজি সরবরাহ করত। ভাল ব্যবসা,
দুই
মেয়ে, আবার গ্রামেও জমিজমা ছিল।
জমিজমা আমার মামাবাড়িতেও কম ছিল না, সমস্যাটা ছিল আমার
মামাবাড়ির মানুষেরা ছিলেন আউলিয়া।
তাদের জমি ছিল কিন্তু জমির প্রতি টান ছিল না। তাদের ভাবটা ছিল
যে, ওই তো জমি আছে, আছে। ভাগচাষিকে দিয়ে চাষ করালাম, যতদিন ফসল হল, ভরা হল গোলা, খামার হল, সবটাই তারা কর্মচারী
হিসেবে করতেন। কার কর্মচারী সেটা তখন বুঝিনি,
এখন
কিছু কিছু বুঝি। ফলে অন্য জমি ও চাষবাসের মালিকদের থেকে আমার দাদামশাই অন্যরকম
মানুষ ছিলেন। ভাগ্যিস ছিলেন। আর ভাগ্যিস মা চাইতেন না আমার হাতে কেউ টাকা দিক, তাতে করে আমার financial
acumen যাকে বলে সেটা কম গজিয়েছিল, কিন্তু অন্য অনেক
সবজে, জংলা জিনিস আমি অনুভব
করেছি জীবনে সেটা না থাকার ফলে এমন প্রতিভাত হয় আজ।
আসলে একটা মন্ত্র আমরা
পেয়েছিলাম যেটা এখনকার মানুষেরা পায় না যে অল্পবয়সে ইত্যাদি তার দুঃখ চিরকাল। যাক কুরবানের কথায় ফিরে আসি।
সেটা ৭০ দশক অতিক্রান্ত সময়, নানানরকম সামাজিক
ছালবাকলা উঠে গেছে, নতুন গাছের চারা
বেরিয়েছে কোথাও। নতুন প্রজাতির ঝোপঝাড়ও গজিয়েছে, তা একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি আমাদের বাড়িতে অনেক লোক। পাঁচিলের উপরে, সামনের দরজায়। সময়টা দুর্গাপুজোর কাছাকাছি।
এত বাড়ি ছিল না তখন, এত পাঁচিল ইট-সিমেন্ট প্যারিসের বিষ এত ছিল না, জমি দেখলেই কোনক্রমে জমিটা হাতিয়ে সেখানে কতগুলো খোপ খোপ
ফ্ল্যাট বানিয়ে দেবার প্রচলন তখন ছিল না। ফলে সামনে তাকালে রাস্তা দেখতে যেত, ফাঁকা
রাস্তাগুলো যেন মেঘের ভেতরে ঢুকে গেছে, শ্রাবণ এলে মা আর আমি টাউনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতাম ছাতা নিয়ে, ছতরিওয়ালী। কখনো সিনেমা যেতাম, কখনো মা এটা-সেটা
কিনত, কাপড়গলি,
হাটের
মোড়, চকবাজার আর আমি মার পেছন পেছন
কখনও দিদার সঙ্গে, বাজারের অলিগলিতে
ঘুরে বেড়াতাম। পয়সার ওপরে কোন টান ছিল না আমার। ওই যে বললাম, আমার মামাবাড়ির দাদু,
তার
বাবা এদের অনেক চাষবাষ, ধানী জমি ছিল, কিন্তু ওদের হৃদয়টা আউলিয়া। ফকির মানুষ ছিলেন আমার মাতামহ, জীবনধারণ এত সামান্য ছিল যে লোকটার যে এত জমিজমা, তার আসা-যাওয়া দেখে বোঝা যেত না। আসলে শব্দ, অক্ষর এগুলোর যে প্রাণ থাকে,
গাছপালার
প্রাণ আছে হাঁড়িকুড়ি, খাবার টেবিল, ফ্যান তাদের প্রাণ আছে, এগুলো ওখানে না থাকলে বুঝতাম না। তার কারণ কিন্তু একটাই, মা কাউকে পয়সা দিতে দিত না আমাকে, একটা বয়স পর্যন্ত পয়সা আমাকে ছুঁতে পারেনি।
অনেকগুলো বছর পর শরতের বিষ
আমার মধ্যে ঢুকে যায়, এই শহরে এসে বুঝতে
পারি, যে শরতের পুজো প্যান্ডেল আলো
সবকিছুর সঙ্গে পুজোর কোন সম্পর্ক নেই এটা একটা অন্য খেলা। যারা পয়সা নিয়ে মায়ের
মাংস কেনে, তাকে পোড়ায়, মারে হত্যা করে তারাই,
গরদের
ধুতি-কাপড় পড়ে মাতৃবন্দনা করে। আমার ঘেন্না করে, কিন্তু ওই যে ঘেন্না আমাকে গ্রাস করার আগেই আমি ঘেন্নাকে
গ্রাস করতে শুরু করি আমার মনে পড়ে যায় শহরের সেই দিনটা স্কুল থেকে ফিরে দেখি
প্রচুর লোকজন আমাদের পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে,
গেটের
সামনে দাঁড়িয়ে আমি তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকি দেখি, দেখি কতজন চোয়াড়ে মার্কা লোকাল
নেতার সামনে, আমার রোগা চেহারার মা, বড় বড়, টানা চোখের আমার মা দাঁড়িয়ে আছে এবং শান্ত, তার একটু
দূরে কুরবান।
ক্রমশ
একে বলে গদ্যসিদ্ধ। এই গদ্যে যা লেখা হবে মানুষ তাই পড়ে ফেলবে। থামতে পারবে না।
ReplyDeleteগুরু মানলাম🙏নির্ভেজাল লেখা যাকে বলে।
ReplyDeleteএক নিশ্বাস এ পড়ে ফেললাম!!
ReplyDeleteলেখার স্টাইল অনবদ্য!!
Written by someone who has helped me become what I am today..
তাই বলা বাহুল্য.... এই লেখা থেকেও অনেক অনেক কিছু নতুন শিক্ষা লাভ করব!!
আর এই শিক্ষা not the conventional one but এটা হবে জীবন যুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখার শিক্ষা!!
🌼
Deleteঅনবদ্য, সাবলিল ভাষায় ব্যক্ত ঘটনাবলি মুগ্ধ করবে পাঠাকবৃন্দকে
Delete🙏
Deleteচলতে চলতে পড়ছি না কি পরতে পরতে চলছি, তাজা বাতাস উঁকি মারছে প্রতি ঝলকে
ReplyDeleteOdvut
ReplyDelete🌼
Delete🌼🌸
Delete