প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

দুর্গতিনাশিনী | জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
 
দুর্গতিনাশিনী

"বর্গীহানা এক কথায় বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়। মারাঠি ধনগর জাতীয় মানুষজন অভিযানে যাওয়ার সময় একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত 'বরচি'। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগিরবর্গা ধনগর বা বর্গী নামে পরিচিত হয়! এরা ছিল অশ্বারোহী।"


-তাহলে ভাস্কর, পুজোটা হচ্ছে তো?
মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের প্রশ্ন শুনে তাঁকে আশ্বস্ত করে ভাস্কর পণ্ডিত বলেন,
-অবশ্যই মহারাজ। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। বাংলার বুকে আমরা বার বার এসেছি শুধু লুটপাট করার জন্য নয়! দুর্গাপুজো বাঙালির আবেগের জায়গা! তাই পুজো আমাদের করতেই হবে! তবেই বর্গী নামের অখ্যাতি ঘুচবে!
রঘুজি ভাস্কর পণ্ডিতকে সঙ্গে নিয়ে দাঁইহাটের সমাজবাড়িকে পুজোর স্থান হিসাবে নির্বাচন করেন। গ্রামের ছেলে-বুড়ো আশঙ্কা করেছিল তাদের আবার লুটপাটের মুখে পড়তে হবে বা পুজোর জন্য অর্থ ও দানসামগ্রী দিতে হবে। কিন্তু রঘুজির সেনাপতি দোর্দণ্ড প্রতাপ ভাস্কর পণ্ডিত কোন কিছুই দাবি করেননি।

 
অন্যদিকে আলীবর্দী খান গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পান বাংলার দাঁইহাট দুর্ধর্ষ বর্গী ভাস্কর পণ্ডিতের কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছে! প্রবাদ আছে বারো ঘাট, তেরো হাট! এই নিয়ে দাঁইহাট! সম্রাট আকবরের সময় যে ইন্দ্রাণী পরগণা ছিল, তাই নিয়েই গড়ে ওঠে দাঁইহাট! বর্ধমানের রাজারা তীর্থজ্ঞানে এখানে সমাজবাড়ি স্থাপন করেন। মহারাজ কীর্তিচাঁদের দেহ এখানে সমাধিস্থ করা হয়! শুধু অস্থি নয়, জীবিতকালে কীর্তিচাঁদের যা কিছু ভাল লাগত, সবই সমাধিতে দেওয়া হয়!
 
সময়টা ১৭৪২ এর গ্রীষ্মকাল। দাবদাহে চারিদিক ভস্মীভূত হচ্ছে। সেই অবস্থায় মারাঠারা নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমান আক্রমণ করে। বাংলার মুসলিম নবাবরা তাদের শত্রু। বঙ্গবাসীদের দুর্দশার অন্ত থাকে না! এক নিষ্ঠুর আক্রোশ নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে ব্যাপক লুণ্ঠন চলে। অশান্ত অস্থির পরিস্থিতিতে চাষি, জমিদার সকলে সন্ত্রাসের শিকার হয়। তবে মারাঠারা স্ত্রীলোকের কোনও ক্ষতি করেনি। মারাঠাদের কিছু সংঘবদ্ধ লুটেরা ক্ষেতের ফসল লুট করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বর্গীহানা এক কথায় বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়। মারাঠি ধনগর জাতীয় মানুষজন অভিযানে যাওয়ার সময় একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত 'বরচি'। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির, বর্গা ধনগর বা বর্গী নামে পরিচিত হয়! এরা ছিল অশ্বারোহী।
 
কঠিন পেশিবহুল যোদ্ধার চেহারা ভাস্কর পণ্ডিতের। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা! তাঁর আদেশ যেন হুকুম। সেনারা একবাক্যে পালন করে। আলীবর্দী খান এই আক্রমণের সংবাদ পেয়ে বর্ধমান আসেন তাঁর বাহিনী নিয়ে। আলীবর্দীর বিখ্যাত গোলন্দাজ বাহিনী। বর্গীরা নবাবের রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। নবাব আলীবর্দী কোনও রকমে বর্গী বেষ্টনী ছিন্ন করে প্রাণে বাঁচেন। আলীবর্দী তাঁর সেনাদল নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের প্রধান কার্যালয় কাটোয়ায় যান। এই ফাঁকে ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করেন। সেখানে প্রথমেই বর্গীরা একটি বাজার পুড়িয়ে দেয়। সেনানায়কের নির্দেশ নির্দেশে বর্গীবাহিনী গ্রামগুলোতে লুণ্ঠন ও ভীষণ হত্যালীলা শুরু করে! নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়! বিধবা রমণীরা অসহায়ভাবে আর্তনাদ করে! যে চাষি ফসল ফলিয়ে দুমুঠো ভাত যোগাত সংসারে, তাকে মেরে ফেললে সন্তানদের নিয়ে স্ত্রীরা কোথায় দাঁড়াবে! জগৎ শেঠ নামক এক ধনী ব্যক্তির থেকে তিন লক্ষ টাকা তারা আদায় করে। আলীবর্দী খান নিজের রাজধানী বাঁচাতে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হলে ভাস্কর পণ্ডিত আবার কাটোয়া প্রস্থান করেন! এ যেন চাণক্যের খেলা! মারাঠাদের দ্রুত তৎপরতার কাছে আলীবর্দী খান হাঁপিয়ে ওঠেন কিন্তু দমেন না! সত্তরোর্ধ্ব নবাবের রক্তের তেজ তখনও আছে! তাঁর একডাকে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা সমবেত হয়। তবে সাম্রাজ্যবাদী মনটা আর নেই! নিজের সম্মান আর অধিকৃত রাজ্যের মর্যাদা রাখতেই তিনি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। একমাত্র আদরের নাতিকে চোখে হারান বৃদ্ধ নবাব। তাকে উত্তরসূরির দায়িত্ব সমর্পণ না করে তাঁর শান্তি নেই! দাঁইহাটের সমাজবাড়িটিকে বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে দখল করে মারাঠা বর্গীরা প্রধান কার্যালয় তৈরি করেন। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ং বা বড় বাজারগুলো ছিল জমজমাট। বাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে বর্গীরা আক্রমণ চালায়। অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিলে বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মানুষজন অনেকেই গঙ্গার পূর্ব দিকের জেলাগুলোতে পালিয়ে যায়।
 
দুর্গাপুজোর আয়োজনে প্রধান পুরোহিত হন দাঁইহাটের হরেন আচার্য। হরেন প্রথমে রাজি হননি।
-আপনার প্রাণের ভয় নেই?
বর্গীদের এক যুব সেনা বিরজু ভোঁসলে কোমরে দুহাত দিয়ে চোখে ক্রুর দৃষ্টি হেনে কথাটা বললে হরেন আচার্য ভীত হন! কৃশ দেহ, গৃহস্হ মানুষ। দুই সন্তানের পিতা। তাই রাজী হয়েছেন। বাংলার মানুষজন খুব একটা অবাধ্য নয় এটা মারাঠারা ভালই বোঝে! তবে মানসিক প্রতিবাদ থেকে তারা পিছিয়ে নেই!
 
গ্রামে দুর্গাপুজোর কথা শুনে অবশ্য সকলে খুশি! পুজোয় শুধু চাষিরা নয়, গ্রামের পিতল-কাঁসা বণিক সম্প্রদায় সকলেরই অবাধ আমন্ত্রণ! চারদিন পুজোর আয়োজনের জন্য হরেন আচার্য যে যে সামগ্রীর তালিকা দেন, সবই ভাস্কর পণ্ডিত ব্যবস্থা করেন! মায়ের পুজোয় যেন কোনও ত্রুটি না থাকে এ কথা সহায়কদের বার বার মনে করিয়ে দেন! ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা, পুজোর ফুলমালা কোনও কিছু বাকি থাকে না! গ্রামবাসী আড়ালে বলাবলি করে বর্গীরা মায়ের পুজো করে নিজেদের অত্যাচার, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে! ষষ্ঠীর বোধন হলে ভাস্কর পণ্ডিত হাত জোড় করে মায়ের কাছে প্রার্থনা করেন বাংলা থেকে নবাবের রাজত্ব যেন উৎখাত করতে পারেন। সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে নিজের পরিবার ছেড়ে দিনের পর দিন লড়াই করার পেছনে এই একটাই উদ্দেশ্য! সপ্তমীর পরদিন অষ্টমীর সন্ধিপুজো! সে এক এলাহি আয়োজন! সকাল থেকে ব্যস্ততা! দুপুরের পর সন্ধিপূজা। ভাস্কর পণ্ডিত শুনেছেন এই পুজোয় মা চামুণ্ডা জাগ্রত হন ও মনস্কামনা পূরণ করেন! হরেন আচার্য শুরু করেন পুজো। গুরুগম্ভীর মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হয়! পুজো ঘিরে গ্রামের মানুষের ভিড়! ভাস্কর পণ্ডিত হাতজোড় করে মৃণ্ময়ী প্রতিমার নিটোল সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভক্তি গদগদ দৃষ্টি! হঠাৎ এক গুপ্তচর এসে সেনানায়কের কানে কানে বলে আলীবর্দী খান তাঁর বাহিনী সহ এগিয়ে আসছে এদিকে। পুজোর খবর পেয়ে পুজো পন্ড করে বন্দি করতে চান ভাস্কর পণ্ডিতকে, যাঁর তুখোড় বুদ্ধির বলে বর্গীবাহিনী অপরাজেয়!
 
আলীবর্দীর কূটচাল বুঝে মুহূর্তের মধ্যে সেনানায়ক পুজো থামাতে বললেন। হরেন আচার্য প্রতিবাদ করে ওঠেন,
-এ পাপ! এ কিছুতেই সম্ভব নয়! গ্রামের অমঙ্গল হবে!
-এ পুজো থামাতেই হবে, শত্রুরা এগিয়ে আসছে! এই মুহূর্তে পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই!
ভাস্কর পন্ডিতের নির্দেশে তাঁর বাহিনী মা দুর্গার প্রতিমা তুলে নিয়ে ভাগীরথীর জলে বিসর্জন দেয়। মায়ের অকালবিসর্জন হয়। গ্রামবাসীর মনে কালো ছায়া নেমে আসে!
 
কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীবর্দী খান তাঁর বাহিনী নিয়ে বীরদর্পে গ্রামে ঢোকেন। সারা গ্রাম খুঁজে একজনও বর্গীকে তাঁরা না পেলেও পুজোর আয়োজনের প্রমাণ পান। গ্রামের মানুষজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেও বর্গীরা কোন্ পথে গেছে কোনও হদিস পেলেন না আলীবর্দী খান। তিনি আপশোশ করেন বর্গীদের আজই শেষ করতে পারতেন। এত বড় সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল! হতাশ মনে ফিরে গেলেন নবাব!
 
সেনানায়কের নেতৃত্বে বর্গীদের অশ্বারোহী দল ততক্ষণে বর্ধমান ছাড়িয়ে মেদিনীপুরের দিকে রওনা হয়েছে। ভাস্কর পণ্ডিত তার অসমাপ্ত পুজোর জন্য আশাহত মুখে বসে আছেন! শেষ বিকেলের অস্তরাগ মেখে আকাশে অন্ধকার নেমে আসে! একটু দূরেই ভাগীরথীর বুকে জোয়ার এলে ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ শোনা যায়। আবার বর্গীদের এক অজানা পথে পাড়ি! সবাই দলবদ্ধভাবেই চলেছে। এক অখণ্ড নীরবতা! অনিশ্চিত জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে ভাস্কর পণ্ডিতও স্থির নিশ্চল! বড় পরিশ্রান্ত লাগে তাঁকে! শিরস্ত্রাণবিহীন মাথায় কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত চুল। তাঁর দৃষ্টি স্থবির! খুব তাড়াতাড়িই রণকুশলী সেনানায়ককে হয়তো আবার ধরতে হবে হাল! তৈরি করতে হবে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা!
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)