বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
মৌসুমী
চক্রবর্তী
শিউলি
ফুলের মালা
"আকাশটা আজ সাদা ধবধব করছে। প্রকৃতি দেখল মুখ তুলে। নববিবাহিত দম্পতি খোলা ছাদের এক কোণে বসে শিউলির মালা গাঁথছে, মা দুর্গাকে পরাবে বলে। শরতের সোনালি রোদে চকচক করছে প্রকৃতির মুখ।"
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেই
মহামায়া নড়েচড়ে উঠল,
-কে রে? শোভন নাকি? শুনে যা একটু।
মাথার কাছে আয়া বসে বুড়িকে চকলেট খাওয়াচ্ছে। ফোকলা দাঁতে রোজই শুয়ে শুয়ে চকলেট চোষে মহামায়া। আজ তিন মাস ধরে কোমর ভেঙে বিছানায়। শোভনের সাথে অজন্তাও এসে ঢুকল শাশুড়ির ঘরে।
-দশকর্মার ফর্দ
দিতে যাচ্ছি দোকানে। ফেরার পথে একটু পটুয়া পাড়ায় যাব। বিষ্ণু-দা ডেকেছে, লক্ষ্মী, সরস্বতীর কাপড়ের রং পছন্দ করতে। বলো কী বলবে?
-এবার আর আমার অঞ্জলি দেওয়া হবে না রে।
ছেলের চোখে জল এলো।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
দেখতে দেখতে পুজো দোরগোড়ায়।
মহামায়ার বাড়ি সরগরম। নাতনি এসে আম্মাকে দেখে চমকে উঠল। একি চেহারা হয়েছ আম্মার!
অর্ধেক হয়ে গেছে তো পুরো। গায়ের চামড়া ঝুলে কী বুড়ি
দেখাচ্ছে। সব চুল সাদা, কাকাই বব-ছাঁট করে
দিয়েছে। মহামায়া নাতনির হাত চেপে ধরল।
-এসেছিস! জামাই
কোথায়? ডাক ডাক দেখি একটু তাকে, দেখে চোখ জুড়ক। প্রকৃতি ডেকে আনল আরিয়ানকে। নাতজামাইয়ের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ফোকলা হাসি হাসল মহামায়া। বালিশের তলা থেকে আলমারির
চাবিটা বের করে নাতনিকে বলল,
-খোল, আমার বিয়ের বেনারসি আর তোর ঠাকুরদার ধুতি পাঞ্জাবিটা বের
কর।
-কী হবে আম্মা?
-তোরা দুজনে পরবি, লক্ষ্মীনারায়ণ সেজে অঞ্জলি দিবি।
প্রকৃতি চোখ কপালে তুলে বলেই
ফেলল,
-খেপেছ আম্মা!
ওই একশো বছর আগেকার শাড়ি পড়ব! মা বলে আমার জন্য কতগুলো শাড়ি কিনে রেখেছে এবেলা-ওবেলা পরার জন্য।
বুড়ি দমে গেল। মুখে কিছু বলল
না। ছোটবৌমা সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল হাতে বড় বড় দুটো ব্যাগ নিয়ে। মহামায়া জিজ্ঞেস করল,
-অত কী কিনেছ পূর্বা?
বৌমা ব্যাগ খুলে দেখাল। মহামায়া
দেখল সবগুলোই কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে,
এক রংয়ের।
মহামায়া বালিশের তলা থেকে চাবিটা বের করে বলল,
-নাও আলমারি থেকে আমার কাঞ্জিভরমটা বের করে নাও। পরে অঞ্জলি দেবে।
তোমাকে সরস্বতীর মতো লাগবে। পূর্বা চোখ কপালে তুলল,
-খেপেছেন! এই
গরমে ওই চওড়া পাড় কাঞ্জিভরম,
রক্ষে
করুন। আর তাছাড়া কাঞ্জিভরম আমার ভাল লাগে না।
চতুর্থীর দিন সন্ধ্যায়, বাড়ি শুদ্ধু সবাই প্রস্তুত, ঠাকুর আনতে যাবে। ম্যাটাডোর দরজায় দাঁড়িয়ে। মহামায়া সাহস সঞ্চয় করে
অজন্তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন,
-নাও আলমারির
চাবিটা নাও, আমার বালুচরি আর তোমাদের
বাবুর সিল্কের পাঞ্জাবিটা বের করে নাও। তুমি আর শোভন পরে যাও। হরপার্বতীর মতো দেখাবে দুজনকে।
অজন্তা ঝাঁঝিয়ে উঠল।
-রাখুন চাবি।
আমার বলে মরার সময় নেই, আর দেখছেন না আমি তৈরি হয়ে গেছি।
আপনার খ্যাপামির তালে তাল দিতে পারব না।
মহামায়া এখন একটু নড়াচড়া
করতে পারে। ডাক্তার অনুমতি দিয়েছে, হুইলচেয়ারে বসার। ও
নিজেই এতদিন গা করেনি। এবারে ঠিক করল উঠবে। বসবে হুইলচেয়ারে, কাজ আছে ওর।
দিনের আয়ার নাম রুবি আর
রাতের জন গীতা। ওদের জিজ্ঞেস করল মহামায়া,
-হ্যাঁ রে
তোদের ও কি অনেক শাড়ি? আমি দিলে নিবি না?
অষ্টমীর দিন সকাল থেকে
বাড়িতে সাজ সাজ রব। বড় ছেলে বলে গেল মা যেন হুইলচেয়ারে বসে অঞ্জলিটা মনে মনে দিয়ে দেয়। মহামায়া মাথা নাড়ল, দেবে। নতুন সাদা ম্যাক্সি, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, লক্ষ্মী মেয়ের
মতো হুইলচেয়ারে বসে আছে মহামায়া।
আকাশটা আজ সাদা ধবধব করছে।
প্রকৃতি দেখল মুখ তুলে। নববিবাহিত দম্পতি খোলা ছাদের এক কোণে বসে শিউলির মালা গাঁথছে, মা দুর্গাকে পরাবে বলে। শরতের সোনালি রোদে চকচক
করছে প্রকৃতির মুখ। চারিদিকে শালা-শালি, শ্বশুর-শাশুড়িদের চোখ এড়িয়ে চোরাদৃষ্টিতে বউয়ের
চোখে চোখ রাখল আরিয়ান। চুপিচুপি বলল,
-আই নেভার নিউ অটম স্কাই ইস সো বিউটিফুল।
হঠাৎ নিচে হট্টগোল, অনেক মহিলা কণ্ঠ একসাথে। ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রপাঠ ছাপিয়ে
কানে আসছে আনন্দধ্বনি। সকলে ধুপধাপ করে নিচে নামল। মহামায়ার ঘরে এত ভিড় কিসের? করা এরা? ফোকলা দাঁতে মহামায়া
হাসল।
-এরা রুবিদের
পাড়ায় থাকে, প্রতিবেশী কাকিমা-জেঠিমা। আর
এরা গীতার বোন-বৌদি-মাসি। আর এরা তো আমাদের পাড়ায় রিকশা চালায় বিবেক, অসীম ওদের মা।
সবার হাতে আলতা-সিঁদুর, মিষ্টির বাক্স আর শাড়ি। বেনারসি, বালুচরি, তাঁত, ঢাকাই, রেশম, মুগা, জড়ি, জামদানি। মহামায়ার আলমারিটা হাট করে খোলা। রিক্ত, শূন্য। সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বুড়ি বলল,
-মায়ের কাছে যেতে পারিনি তাই মায়েরাই এসেছে আমার ঘরে, মায়ের অঞ্জলি কি খালি হাতে দেওয়া যায়!
আরিয়ান প্রকৃতির কানে কানে
বলল,
-শি ইস লুকিং
লাইক অটাম স্কাই।
প্রকৃতিও ঘাড় নাড়ল। ভিড়
ঠেলে এগিয়ে গেল। শিউলি ফুলের মালাটা আম্মার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল,
-তুমিই আমাদের
দুর্গা আম্মা। আসছে বছর আবার হবে, আরও অনেক, অঢেল হবে।
মহামায়া অসহায়ের মতো বলল,
-আসছে বছর!
কিন্তু আমি যে আমার আলমারি ফাঁকা করে ফেলেছি।
আরিয়ান আশ্বাস দিলো,
-নো প্রবলেম আম্মা আই শ্যাল সেন্ড ইউ কেরালা কটনস।
অজন্তা আর পূর্বা দুই বৌ এসে
শাশুড়ির কাঁধে হাত রাখল।
-আপনার ফাঁকা
আলমারি ভরিয়ে তোলার দায়িত্ব আমরা নিলাম, আপনি শুধু দুর্গা হবেন।
মহামায়া গলার মালাটা দু হাত
দিয়ে কপালে ঠেকাল। ফ্যানের হাওয়ায় ওর চুলগুলো কাশ ফুলের মতো উড়ছে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment