প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Saturday, September 13, 2025

গুড মর্নিং | দেবদাস কুণ্ডু

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
দেবদাস কুণ্ডু
 
গুড মর্নিং

"এবার আসি চতুর্থ মেয়েটির কথায়। ওর নাম রাই। ওকে তুমি অসাধারণ একটা কথা বলেছিলে। অনেকে ভাববে অশ্লীল কথা। কিন্তু না। তুমি কোন অশ্লীল কথা বলনি। তুমি বলেছিলেরাই তোমার বুক দুটো বড় সুন্দর। যখন কোন শিশু স্তন্যপান করবেতখন তোমার বুক দুটো হয় উঠবে অপার্থিব সুন্দর। ওই স্তনে আমার ঠোঁট শোভা পাবে না।"


-তোমাকে ছাড়া কিছু ভাল লাগে না দেবযানী।
-সত্যি বলছ?
-হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। না হলে এই মধ্য রাতে তোমাকে ফোন করি?


-
আমাদের পরিচয় তো বেশি দিনের নয় অনির্বাণ। এর মধ্যে তুমি আমাকে এত ভালবেসে ফেললে?
-শিবুদার কোচিং-এ তুমি ভর্তি হলে দু-মাস আগে। একদিন কী কারণে এলাকায় আলো ছিল না। তা শিবুদা আমাকে বলল, অনি তোর বাইকে দেবযানীকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দে। ওর মা আজ আসতে পারবেন না ওকে নিতে। আর তুমিও কোন আড়ষ্ট না করে চেপে বসলে আমার বাইকের পিছনে। কি ঠিক বলছি তো?
-আমি কী করব? মা সেদিন কোন একটা কাজে আটকে গিয়েছিল, আমাকে নিতে আসবে না, সেটা ফোনে শিবুদাকে বলেছে। আমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে। পুরনো ফাঁড়ি পার হলে কবরস্থান। খুব ভয় লাগে একা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে। আর তোমার বাইকে চাপতে আড়ষ্ট হব কেন? তুমি রাক্ষস না গুন্ডা?
-অন্য মেয়ে হলে বাইকে উঠতে ইস্ততত করত। তুমি আলাদা দেবযানী।
-সে আমি বলতে পারব না। তবে সেদিন বাইক চালাতে চালাতে তুমি আমাকে পুলিশের মতো জেরা করছিলে। তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়? তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? পড়াশোনা ছাড়া আর কী কর? রবীন্দ্রসংগীত ভাল লাগে, না জীবনমুখী গান। আরো কত কী!
-আর তুমি সাবলীলভাবে উওর দিয়ে যাচ্ছিলে সেদিন। এতটুকু আড়ষ্টতা বা জড়তা ছিল না তোমার গলায়। অন্য মেয়ে হলে এত কথার জবাব দিত না। দিলেও জড়তা থাকত কিংবা বিরক্ত হত।
-বাহ্‌ রে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উওর না দেওয়াটা অভদ্রতা। আর বিরক্ত হব কেন? তুমি তো খারাপ কিছু জিজ্ঞেস করনি। এই সব প্রশ্ন আমিও তোমাকে করতে পারতাম। তাতে কি তুমি বিরক্ত হতে?
-এতটুকু না। বরং ভাল লাগত।
-তাহলে আমি কেন বিরক্ত হব? বরং আমার সেদিন ভাল লাগছিল একজন আমার সম্পর্কে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
-তাই তো বলছিলাম তুমি আলাদা দেবযানী। তুমি সম্পূর্ণ আলাদা।
-সেটা আমি নিজে বলতে পারব না।
-সৈদিন কিন্তু আমি বাইক খুব জোরে চালাছিলাম না। তবু বাতাসে তোমার সুগন্ধি চুল এসে আমার মুখে আদর করছিল।
-আমি তো চুলে কোন গন্ধ তেল মাখি না। তুমি কী করে গন্ধ পেলে?
-ফুল কি জানে তার কী গন্ধ? সেই গন্ধটা আজও আমি পাই।
-এমা তুমি এর মধ্যে চান করনি?
-করেছি তো। আমি দু’বেলা চান করি।
-তাহলে গন্ধটা থাকে কী করে?
-কিছু কিছু গন্ধ মরে না দেবযানী। তারা অমরত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে বুকের গভীরে।
-বেশ সুন্দর কথা বলতে পারো তো তুমি। অথচ তুমি কিনা বাংলায় ফেলে করেছ।
-কে বলল কথাটা?
-শিবুদা।
-হঠাৎ কেন শিবুদা আমার কথা বলতে গেলেন?
-সেদিন কে যেন জয় গোস্বামীর নুন কবিতার সারমর্ম লিখেছিল। শিবুদা তার খাতা দেখে বলেছিল, এত বানান ভুল! বাক্য ভুল! তখনই বলেছিলেন শিবুদা, আমার শিক্ষকতার কুড়ি বছরের জীবনে একটি ছাত্র বাংলায় ফেল করেছে। আমরা সবাই বললাম, কে স্যার? শিবুদা তখন বললেন, যে ফর্সা ছেলেটা মাঝ মাঝে এসে তোদের সঙ্গে বাংলা ক্লা করে, যার মাথার অর্ধেক চুল লাল, অর্ধেক চুল সবুজ। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম সেই ফেল করা ছাত্রটা আর কেউ নয় তুমি। জানলাম তোমার নাম অনির্বাণ
এখন ফোনে নিস্তদ্ধতা। বাইরে চিরাচরিত কালো রাত। একটা রাত জাগা পাঠিও ডেকে উঠল। আবার বাক্যালাপ শুরু।
-আচ্ছা তুমি চুলটাকে অমন করেছ কেন? আজকাল দেখছি অনেকেই এমন অদ্ভুত হেয়ার স্টাইল করছে। তোমরা কেন কর? আয়নায় নিজেকে দেখ না?
-ছেলেরা আয়নায় সামনে দাঁড়ায় না
-তাহলে কোথায় দাঁড়ায়?
-মেয়েদের সামনে। মেয়েরা ছেলেদের আয়না।
-ভারি সুন্দর কথা তো। কিন্তু আমার এসব হেয়ার স্টাইল এতটুকু ভাল লাগে না।
-কাল সব চুল মেঘের মতো কালো হয়ে যাবে দেখে নিও তুমি।
-বাংলাটা তো ভালই বলতে পারো। কী সুন্দর উপমা দিলে। কী করে যে বাংলায় ফেলে করলে! নাকি মেয়েদের মন ভোলানোর জন্য এসব কথা বল?
-দেখ দেবযানী গদ্যটা আমি বুঝি। কবিতা আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগে।
-আচ্ছা তুমি সত্যি আমাকে ভালবাস?
-বললাম তো হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট ভালবাসি। খাঁটি সোনার মতো। এতটুকু খাদ নেই।
-কেন বাস? আমি ইলেভেনে পড়ি। খুব ভাল ছাত্রী নই। রোগা। দেখতে আহামরি নই। গায়ের রং শ্যামলা। কী দেখলে আমার ভিতর?
-তোমার দুটো চোখ।
-মানে?
-তোমার চোখ দুটো দেখলে ভয় হয় আমার।
-ভয় হয়? এ আবার কী রকম কথা? আমার চোখ দু’টো কি কাপালিকের মতো লাল নাকি?
-না। এতটুকু নয়।
-তাহলে?
-আসলে কী জানো, আমি তো বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। গুড বয় নই। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশি। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু নেশাটেশা করি। বাবা-মা দু’জনেই বোঝে। কিন্তু কিছু বলে না। বাবা-মা কিছু বললে আজকাল অনেক ছেলে বোকার মতো আত্মহত্যা করে। আমি অবশ্য তা কোনদিন করব না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়েছে তোমার চোখদুটো না পেলে আমি মরে যাব। তোমার চোখদুটো অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। একটু কড়া চোখ আমার চাই। যে চোখ আমাকে শাসন করবে আবার সেই চোখই আমাকে ভালবাসবে।
কিছসময় চুপ করে থাকল দেবযানী।
-কী হল কথা বলছ না কেন?
-ভাবছি এত সুন্দর যে বাংলা বলতে পারে সে কি কখনো বাংলায় ফেল করে?
-দেখ দেবযানী আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি কবিতাটবিতা আমি বুঝি না। আমার মনে হয় কবিরা চায় না পাঠক কবিতা বুঝুক।
-যাহ্‌ তা হয় নাকি? আমি তো কবিতা ভাল বুঝি।
-তাই তো বলেছি তুমি আলাদা। আর পাঁচটা মেয়ের মতো ন
-আচ্ছা তুমি একটা সত্যি কথা বলবে? আমাকে ছাড়া আর কাউকে তুমি ভালবাস না?
-বাসি তো।
-কাকে?
-বাবা-মাকে।
-আর কাকে?
-আমার আদরের টাইগারকে।
-আর কাকে ভালবাস?
-বাড়ির মুনিয়া পাখিগুলিকে।
-আর কে আছে?
-আমার এক প্রতিবন্ধী মাসতুতো বোনকে।
-এছাড়া? আর কেউ?
-এ্যকোরিয়ামের গোল্ড ফিস কিসিং ফিসকে।
-আর কেউ আছে?
-আছে। বারান্দার ফুলগাছগুলি।
-আর কেউ নেই তো?
-না, আছে। আমার ঠাকুমা।
-তোমার ভালবাসার তালিকায় আর কেউ বাকি নেই তো?
কিছু সময় ভেবে নিয়ে অনির্বাণ বলল,
-না আর কেউ নেই।
-এখন নেই। কোন কালে কি ছিল? মানে আগে তুমি কি কোন মেয়েকে ভালবেসে ছিলে?
-মিথ্যে বলি কী করে?
-তার নাম মনে আছে?
-আছে। জীবনে প্রথম ভালবাসি অংকিতাকে।
-অংকিতাকে কী বলেছিলে মনে আছে?
-না। নেই। কয়েক বছর আগের কথা।
-আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুমি অংকিতাকে বলেছিলে তোমার ঠোঁটদুটো আমার ভীষ ভাল লাগে। মনে হয় ফুলের মতো নরম হালকা আর পবিত্র। এই ঠোঁটে চুম্বন করা যায় না। পুজো করা যায়।
একটু থেমে দেবযানী বলল,
-দ্বিতীয় মেয়েটি কে?
-দীপিকা।
অনির্বাণ সহজ গলায় বলে।
-ওকে কী বলেছিলে তুমি?
-মনে করতে পারছি না এখন।
-তাহলে আমি বলি। ওকে তুমি বলেছিলে দীপিকা তোমার কোমর অবধি ঘন কালো চুল আমাকে মেঘের দেশে নিয়ে যায়। আমি কত গল্প করি মেঘেদের সঙ্গে। মেঘেরা শুধু ভালবাসার কথা বলে। ওদের দুঃখ হলে ওরা হালকা হতে পৃথিবীর বুকে অশ্রু বিসর্জন করে। আমি তখন তোমাকে ভুলে যাই। এই কথাই তো বলেছিলে?
-হয়তো তাই।
অনির্বাণ ছোট্ট জবাব দেয়।
-তৃতীয় মেয়েটি হল শ্বেতা। তাই তো?
একটা শব্দ উচ্চার করে অনির্বাণ,
-হ্যাঁ।
-তাকে কী বলেছিলে নিশ্চয় এখন মনে করতে পারছ না?
অনির্বাণ চুপ।
-শ্বেতাকে বলেছিলে তোমার মুখটা সরস্বতীর মতো শুভ্র, অমলিন। তোমার কাছে বিদ্যা প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করে। যৌনতা নয়। তাই তো? আমি কি ভুল বললাম?
-এইরকম কিছু একটা বলেছি।
অনির্বাণ হালকা স্বরে বলল।
-এবার আসি চতুর্থ মেয়েটির কথায়। ওর নাম রাই। ওকে তুমি অসাধারণ একটা কথা বলেছিলে। অনেকে ভাববে অশ্লীল কথা। কিন্তু না। তুমি কোন অশ্লীল কথা বলনি। তুমি বলেছিলে, রাই তোমার বুক দুটো বড় সুন্দর। যখন কোন শিশু স্তন্যপান করবে, তখন তোমার বুক দুটো হয় উঠবে অপার্থিব সুন্দর। ওই স্তনে আমার ঠোঁট শোভা পাবে না। অনধিকার প্রবেশ হবে। তুমি কিন্তু রাইকে অনাবৃত করে এই কথা বলনি। তোমার অন্তরের চোখ এই কথা বলেছিল সেদিন।
-তুমি এত সব কথা জানলে কী করে দেবযানী? তুমি কী ওদের বন্ধু?
-হ্যাঁ। ওরা প্রত্যেকে আমার বন্ধু। ওদেরকে যখন আমি তোমার কথা বলেছি ওরা তখন আমাকে এসব কথা বলেছে।
-তাই তো আমি বলছিলাম আমি বাজে ছেলে, আমি নষ্ট ছেলে।
-না, তুমি মোটেও নষ্ট ছেলে নও। ভিজে ছেলেও নও। আসলে তোমার ভালবাসা কোন একটা নারীর ভিতর পূর্ণতা পায় না। তুমি বহু মেয়ের ভিতর তোমার প্রেম খুঁজে বেড়াও। ওরা বলেছে তুমি ওদের শরীর চাওনি। ওরা দেখেছে তুমি এক অস্থির চঞ্চল ছেলে। ওদের মনে হয়েছে তুমি একটা অসুস্থ যুবক। তুমি ঠিক ভালবাসা জানো না। বোঝ না। তাই ওরা সরে গেছে। তুমি বললে না যে তুমি কবিতা বোঝ না। তুমি কবিতা কী করে বুঝবে? তুমি নিজেই তো একটা কবিতা। কেউ কি নিজেকে নিজে চিনতে পারে? তাই তো আমরা সারাজীবন ধরে নিজেকে খুঁজে চলেছি।
-আচ্ছা দেবযানী তুমি এত কথা জানলে কী করে?
-আমার বাবা একজন গল্পকার। নাম করা গল্পকার নয়। তবে ভাল লেখে। বাবার লেখা পড়ি। বাবা অনেক বই এনে দেয়। সেসব বই পড়ি। রবীন্দ্রনাথ মানিক বিভূতি তারা সুনীল শীর্ষেন্দু শক্তি জয় আরো অনেকের লেখা পড়েছি। নিয়মিত আধুনিক কবিতা পড়ি। সাহিত্য না পড়লে মানুষকে তুমি কি করে আবিষ্কার করবে? মানুষ আসলে একটা বিস্ময়ের খনি!
-এই ছোট্ট জীবনে তুমি এত বই পড়ে ফেলেছ? আচ্ছা তোমার কী মনে হয় আমি অসুস্থ?
-হ্যাঁ। ওদের কাছে তুমি অসুস্থ। আমার কাছে নয়।
-তাহলে তুমি আমায় ভালবাসবে তো?
-কী করে বাসি? কিছুদিন পর তুমি অন্য আর একটা মেয়ের ভিতর আর একটা অন্য সৌন্দর্য খুঁজে পাবে।
-তার মানে তুমি ভালবাসবে না?
-তুমি তো কাউকে ভালবাসনি। প্রতিটা মেয়ের ভিতর তুমি একটা বিস্ময় খুঁজে পেয়েছ। আর তুমি কোনদিন কোন একটা মেয়েকে চিরদিনের জন্য ভালবাসতে পারবেও না। তুমি আসলে পৃথিবীর সব নারীর প্রেমিক।
-এ কথার মানে কী দেবযানী?
-সব নারীর ভিতর তোমার খণ্ডণ্ড প্রেম জুড়ে তবে তোমার ভালবাসা পূর্ণতা পাবে।
-তাহলে আমি কী করব?
-তুমি আবার কী করবে? ঈশ্বর তোমাকে এইভাবে সৃষ্টি করেছেন। তুমি কখনো কোন একটা নারীর ভিতর সম্পূর্ণ ডুবে যেতে পারবে না।
-তাহলে এইভাবে আমি আজীবন কাটাব?
-কী আর করবে? ভোর হতে চলল। গুড মর্নিং।
 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)