প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

সনাতন-দীননাথ— কালের ধুলোয় অমলিন | রত্নদীপ দাস (রাজু)

বাতায়ন/শারদ/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | প্রবন্ধ
রত্নদীপ দাস (রাজু)
 
সনাতন-দীননাথ কালের ধুলোয় অমলিন

"সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের অনুরাগী ছিলেন। চারণ কবি মুকুন্দ দাস স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিপ্লবাত্মক গান ও নাটক রচনা করেন। তিনি স্বদেশী যাত্রারও প্রবর্তক ছিলেন।"


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির আত্মপরিচয়’। একটি জাতির সংস্কৃতি তার আত্মপরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং চেতনার ধারক ও বাহক। সংস্কৃতি একটি জাতিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে এবং 

তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন, পরিপোষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে যাঁরা নিরন্ত্রর কর্মপরিচালনা করেন, তাঁরাই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিমনা ও এর ধারক। এমন উল্লেখযোগ্য দুই সহোদর হলেন- শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস। ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকা বিভাগের শ্রীহট্ট জেলার নবীগঞ্জ থানার গুরুত্বপূর্ণ একটা পরগণা হচ্ছে জন্তরী পরগণা। নবীগঞ্জ থানার হেডকোয়ার্টার অর্থাৎ হাট নবীগঞ্জ মৌজা এই পরগণারই অন্তর্ভুক্ত। জন্তরী পরগণার অন্তর্গত ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একগ্রামের নাম ‘মুক্তাহার’।  এই গ্রামের অনেক বীর সেনানী  ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে স্বদেশের প্রতি নিজেদের নিবিড় আত্মনিবেদনের পরিচয় দিয়েছেন। এই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শ্রীমান গঙ্গারাম দাস। তিনি তৎকালীন নবীগঞ্জ মুন্সেফ কোর্টের পেশকার বা এজাতীয় কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস।

শ্রীমান সনাতন দাস (১৮৫৫ - ১৯৩৮): শ্রীমান সনাতন দাস অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের শ্রীহট্ট জেলার নবীগঞ্জ থানার জন্তরী পরগণার মুক্তাহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঠশালা ও টোলে পড়াশোনা করেন। তৎকালীন সময়ে এই এলাকায় এমই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই দীর্ঘ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এ সময় বেশ কঠিন ছিল। পরিণত বয়সে তিনি এই অঞ্চলের একজন শৌখিন ও খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাখি শিকার ও ভ্রম ছিল তাঁর অন্যতম শখ। সুন্দর, সুঠাম ও বলিষ্ঠ গড়নের অধিকারী শ্রীমান সনাতন দাস কাঁসার তৈরি ফস্বী হোক্কায় লম্বা পাইপের (নলের) সাহায্যে তামাক সেবন খুব পছন্দ করতেন। এটি তাঁর শৌখিন বা পছন্দের জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। পড়তেন রুচিসম্মত ধুতি ও পাঞ্জাবি। শরীরের বাম পাশে একটি কারুকার্য খচিত চাদর জড়িয়ে রাখতেন। তিনি ছিলেন শৌর্যের অধিকারী ও দুর্দান্ত সাহসী ব্যক্তি। এলাকার বিচার-বৈঠকে ছিলেন সততার পরিচায়ক ও অপ্রতিদ্বন্দী। নিজের এলাকার বাইরেও তিনি বিচার বৈঠকে প্রশংসিত হন। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে কখনোই প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ থাকত না। একটা সময় তিনি নবীগঞ্জ থানার ৩৯নং সার্কেল পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ নির্বাচিত হন। শ্রীমান সনাতন দাস সরপঞ্চ (১৮৯৫-১৯০০) হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং সরপঞ্চের দায়িত্ব পালন কালে তিনি অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তৎকালীন সময়ে গ্রামীণ সালিশিতে তাই এলাকায় ‘সনাতন দাস’ ছিল এক অগ্রগণ্য নাম। সে সময়কার সমবায় সমিতি ব্যবস্থা, কৃষক উন্নয়ন ও গ্রামীণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি আমৃত্যু প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্তপ্রতীক ও সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থক। ব্যক্তিজীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। একমাত্র কন্যা সন্তানের জন্মের সময় তাঁর পত্নী ইহলোক ত্যাগ করলে সকলের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পুনরায় বিয়ে করতে রাজি হননি। মেয়েকেই একমাত্র অবলম্বন করে ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।


 
শ্রীমান দীননাথ দাস (১৮৬০ - ১৯৪৩): শ্রীমান দীননাথ দাস অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের শ্রীহট্ট জেলার নবীগঞ্জ থানার ঐতিহ্যবাহী মুক্তাহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশোনা করেন টোল ও স্থানীয় পাঠশালায়। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। শারীরিকভাবে সুদর্শন, সুঠাম ও শক্তিশালী দেহের অধিকারী দীননাথ ছিলেন সাহসিকতা ও বিচক্ষণতায় অনন্য। পড়তেন ধুতি ও পাঞ্জাবী। সে সময়ের সম্মৃদ্ধ গ্রামীন সংস্কৃতি  ছিল লোকজ সংস্কৃতির সূতিকাগার। যেখানে লোকজীবনের নানা উপাদান ছিল। দীননাথ লোকজ সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। তিনি যাত্রাদল সহ গ্রামীণ সংস্কৃতি বিকাশে কাজ ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জারি, সারি, লোকগানের আসর, যাত্রাপালা, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। এছাড়াও সামজিক কার্যক্রমে অগ্রগামী ভূমিকা ও সাহসী পদক্ষেপে তিনি মানুষের প্রিয় ও ভরসার পাত্রে পরিণত হন। বড় ভাইয়ের পরবর্তীতে তিনি নবীগঞ্জ থানার ৩৯নং সার্কেল পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ নির্বাচিত হন এবং সরপঞ্চ (১৯০০-১৯০৫) হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীমান দীননাথ দাস ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন নিরেট ভদ্রলোক। তিনি সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক এবং নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন।



পারিবারিক জীবনে শ্রীমান দীননাথ দাস স্বগ্রাম নিবাসী ডেঙ্গুরাম দাসের কন্যা শ্রীমতী পসাই রাণী দাসের সঙ্গে প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই কন্যা ও এক পুত্র, যথাক্রমে- ১) শ্রীমতী সরোজিনী বালা দাস, ) শ্রীযুক্ত দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯০৫ - ১৯৭৬) ও ৩) শ্রীমতী বিরহিনী বালা দাস (২৫.০৪.১৯১৫ - ২৬.০৫.২০০৯)। একমাত্র পুত্র শ্রীযুক্ত দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস নবীগঞ্জ যুগল-কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাইনর পাশ করেন। তিনি ফুটবল খেলায় ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি খেলার জন্য তাঁর টিম নিয়ে দূরদূরান্তের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে যাতায়াত করতেন। লোকগীতি ও যাত্রাগান তাঁর প্রিয় ছিল। পরিণত বয়সে তিনি লোকউৎসব, যাত্রাদলের উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত কর্তব্য পরায়ণ, নিষ্ঠাবান, নির্ভীক, বিচক্ষণ ও সংস্কৃতিবান লোক ছিলেন। নিজের অবস্থান থেকে সবসময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন। পূর্বজদের ন্যায় তিনিও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন। কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনের পাশাপাশি তিনি তাঁর মেধা, মনন ও সাহসিকতা দিয়ে এলাকায় সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবিক কাজের মাধ্যমে অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
 
শৌখিনতা: শৌখিন এই ভ্রাতৃদ্বয়ের নৌকা বাইচের খুব শখ ছিল। নিজেদের ছিল শখের দৌড়ের নৌকা ও একটি দুই মাইল্লা গোস্তী নৌকা (দুইজন মাঝি পরিচালিত গোস্তী নৌকা)। মুক্তাহার গ্রামের পূর্ব ধারের শ্রীমান কালী চরণ দাসেরও [কালী সাধু; বঙ্ক চন্দ্র দাসের (মাস্টার) জ্যাঠতুতো বড় ভাই] দৌড়ের নৌকা ছিল। তখনকার দিনে বর্ষাকালের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা বাইচ। বর্ষায় এই দুই দৌড়ের নৌকার প্রতিযোগিতা এলাকাবাসীদের আনন্দ দিত। আর গোস্তী নৌকায় করে তাঁরা ছয়রে (বেড়াতে) বের হতেন। তাঁদের গোস্তী নৌকায় থাকা-খাওয়া এবং গান-বাজনারও সুব্যবস্থা ছিল।
 
কৃষিতে সমৃদ্ধি: সমাজসেবার পাশাপাশি সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন সফল কৃষক। পৈতৃকসূত্রে তাঁরা ছিলেন পাট্টার মালিক (পাট্টা হচ্ছে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমির মালিকানা সনদ/দলিল)। তাঁরা বিশ্বাস করতেন মাটি ও প্রকৃতিকে ব্যবহার করে লবন ও কেরোসিন ছাড়া সবকিছুই উৎপাদন করা সম্ভব। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে বহু প্রজাতির ফল ও ফুলের চারা বাড়িতে রোপন করতেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরাগী ছিলেন তাঁরা। কবিগুরুর কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে অধিক ফসল উৎপাদনের কর্মসূচিতে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা নিজেদের জমিতে এর প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়াসী ছিলেন।
 
লোকসংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ: আদিকাল থেকেই বাঙালিরা লোকসংস্কৃতি লালন করে আসছে। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের কৃষি, গ্রামী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, জীবন প্রণালী, শিল্প ও বিনোদনের উপর ভিত্তি করে। সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন আবহমান বাংলার প্রান্তিক শ্রেণীর লোকসংস্কৃতির ধারক, বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। তখনকার সময়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের বিনোদনের উৎস ছিল যাত্রাগান, পালাগান, ঘেটুগান, নৌকা বাইচ ইত্যাদি। তাঁরা এসবের আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এক্ষেত্রে তাদের খ্যাতি আশেপাশের অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
 
স্বদেশী আন্দোলন: সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের অনুরাগী ছিলেন। চারণ কবি মুকুন্দ দাস স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিপ্লবাত্মক গান ও নাটক রচনা করেন। তিনি স্বদেশী যাত্রারও প্রবর্তক ছিলেন। সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত যাত্রাপালায় কবি মুকুন্দের বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়ন করেছেন এবং তাঁর লেখা গানও বিভিন্ন পালায় কাস্ট করতেন এলাকাবাসীকে বিনোদনের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে। এভাবেই তাঁরা স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হন। এছাড়াও সামাজিক কার্যক্রম ও বিচার বৈঠক পরিচালনা করার সুবাদে তাঁরা স্বদেশী আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেন।
 
সার্কেল পঞ্চায়েত পদ্ধতি ও সরপঞ্চ: সার্কেল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বা সরপঞ্চ পদ্ধতি হল ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রাচীনতম শাসন ব্যবস্থা। প্রাচীন ভারতের গ্রামীণ শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল পাঁচজন নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান পঞ্চায়েত। এই প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত ছিল গ্রামগুলির প্রশাসন, আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি ও উন্নয়ন। মোগল আমল পর্যন্ত ভারতবর্ষের গ্রামগুলো এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের এই সুমহান ঐতিহ্যশালী শাসন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। তার বদলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা নিজ কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ভারতের গ্রাম ও নগরাঞ্চলে ব্রিটিশ ধাঁচের এক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। ১৮৫৭ সালের পরে ব্রিটিশরা পঞ্চায়েতকে ছোটখাট অপরাধ দমন এবং গ্রামীণ জনপদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা দিয়ে প্রথাটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। তবে এই পদক্ষেপগুলো গ্রামীণ সম্প্রদায়ের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না। প্রতিটি প্রশাসনিক থানা অনেকগুলো সার্কেল পঞ্চায়েতে বিভক্ত ছিল। সার্কেলের প্রধান নির্বাহীকে বলা হত ‘সরপঞ্চ’। সরপঞ্চ বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা। সরপঞ্চের পরিষদে তিনজন সরপঞ্চায়েত বা সহকারী সরপঞ্চ (মেম্বার) থাকতেন। সার্কেলের পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ ও সহকারী সরপঞ্চরা বেশ কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। চৌকিদার নিয়োগ, ট্যাক্স কালেকশন, গ্রামী উন্নয়ন, শিক্ষা, বিচার-সালিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি। থানা সার্কেল অফিসার বা প্রশাসনিক উচ্চ পদস্থ অফিসারের তত্ত্বাবধানে সরাসরি হাত তোলার মাধ্যমে সরপঞ্চ ও সহকারী সরপঞ্চ নির্বাচিত হতেন।
 
ব্রিটিশ শাসনামলে নবীগঞ্জ থানা ৪১ টি সার্কেল পঞ্চায়েতে বিভক্ত ছিল। শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস ভ্রাতৃদ্বয় নবীগঞ্জ থানার ৩৯ নম্বর সার্কেল পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ হিসেবে সুনামের সহিত প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীগঞ্জ থানার জন্তরী পরগণার অন্তর্গত ৩৯ নম্বর সার্কেল পঞ্চায়েত- জন্তরী, মুক্তাহার, বড়সাখোয়া, করগাঁও, পুরুষোত্তমপুর, গন্ধা, কমলাপুর, বৈলাকীপুর, পাটলী-বুরুঙ্গা, রাজাপুর, মিল্লীক প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সার্কেল পঞ্চায়েত পদ্ধতি বিলুপ্ত করে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করেন। কয়েকটি সার্কেল পঞ্চায়েত নিয়ে গঠন করা হয় একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল।
 
সার্কেল পঞ্চায়েতের সরপঞ্চের প্রশাসনিক দায়িত্ব ও ক্ষমতা:  ১৮৭০ সালের বঙ্গীয় ৬নং আইনের (গ্রাম্য চৌকিদার আইন) ৩ ধারার বিধান মতে সার্কেল পঞ্চায়তের সরপঞ্চ এবং সহকারী সরপঞ্চদের (সরপঞ্চায়েত/মেম্বার) নিযুক্ত করা হত। সরপঞ্চকে ফৌজদারি কার্যবিধি -১৮৯৮ আইনের ৪৫ ধারার বিধান মতে উক্ত সার্কেল ভুক্ত সমস্ত গ্রামের ‘হেডম্যান’ নিযুক্ত করা হত। উক্ত আইনে পঞ্চায়তের যে সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট হয়েছে তাহা সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা এবং উক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন কালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের কাছ থেকে কোন আদেশ পেলে, সেই আদেশ মোতাবেক দায়িত্ব পালন করা।
 
স্মৃতিচিহ্ন: শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস ভ্রাতৃদ্বয়ের পারিবারিক ও কর্মজীবনের যা কিছু অমূল্য স্মারক ও দলিল দস্তাবেজ ছিল, তা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁদের উত্তরসূরীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া এবং পাকিস্তানের এ দেশিয় সহযোগী কর্তৃক বাড়িঘর লুটপাটের ফলে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে তাঁদের নাম এবং কর্মগুণের কথা এখন মুছে যায়নি। এখন কালের ধুলোয় অমলিন রয়েছে ক্ষণজন্মা দুই সহোদরের জীবনকথা। শ্রীমান দীননাথ দাসের প্রপুত্রদ্বয় তরু লেখক ও গবেষক রত্নদীপ দাস (রাজু) ও রত্নেশ্বর দাস (রামু) কর্তৃক তাঁদের পিতা, খ্যাতিমান শিক্ষক ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯৫৪-২০১৭) এঁর নামানুসারে নবীগঞ্জ উপজেলার মুক্তাহার গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’-এ এই দুই কীর্তিমানদের স্মরণে গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষের নাম ‘সনাতন-দীননাথ পাঠকক্ষ’ নামকর করা হয়েছে। এছাড়াও তাঁরা ‘সনাতন-দীননাথ কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করে শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
 
সংস্কৃতি ছাড়া কোন জাতি তার স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় ধরে রাখতে পারে না। সংস্কৃতি একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, রীতিনীতি, বিশ্বাস এবং জীবনযাত্রার একটি সম্মিলিত রূপ। আবহমান বাংলার মাটি ও মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুসংহত রাখতে সনাতন-দীননাথ ভ্রাতৃদ্বয় আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। বিশ্বজগতের অনন্ত কালপ্রবাহে মানুষের জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কালের আহ্বানে পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন এক বর্ণিল কর্মময় জীবন, যা আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। তাই তো মৃত্যুর বহুকাল পরেও তাঁরা আজও জীবন্ত। এখানেই তো ব্যক্তিজীবন তথা মানবজীবনের সার্থকতা। মহান এই ব্যক্তিদ্বয়ের ক্ষেত্রে তাই কবির নিম্নোক্ত চরণগুলো প্রণিধাণযোগ্য-
 
আত্মসুখ অণ্বেষণে আনন্দ নাহিরে
     বারে বারে আসে অবসাদ
পরার্থে যে করে কর্ম ঘর্ম নীড়ে
    সেই লভে স্বর্গের প্রসাদ।”
 
 
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠাগার বার্তা; সাধারণ সম্পাদক, সনাতন-দীননাথ কল্যাণ ট্রাস্ট, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ। ইমেইল : ratnadeepdasraju@gmail.com
 
তথ্য ঋণ:
১. লেখক-সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী প্রমুখ সম্পাদিত শ্রীমান সনাতন দাস ও শ্রীমান দীননাথ দাস স্মারকগ্রন্থ ‘কালের অভিজ্ঞান’;
২. যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত ও প্রাচীন পত্রিকা ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা পোস্ট (তারিখ: ১৬.০৮.২০২৪ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১৩);
৩. আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ইব্রাহিম চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকা প্রথম আলো (নিউইয়র্ক সংস্করণ, তারিখ: ২২.০৮.২০২৪ খ্রি.,);
৪. কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অগ্রদূত থেকে প্রকাশিত বইমেলা ক্রোড়পত্র ‘প্রথম আলো’ (ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৪৬-৪৭);
৫. মুকুন্দ চন্দ্র দাস (বটু দাস; ১৯১৭); মুক্তাহার গ্রামের শতবর্ষীয়ান ব্যক্তি;
৬. বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯৫৪ - ২০১৭); শিক্ষক ও শ্রীমান দীননাথ দাসের পৌত্র।
 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)