প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

তৈমুর খান সংখ্যা | মগজ ও অঙ্গ

বাতায়ন/ তৈমুর খান সংখ্যা/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/ ৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ , ১৪৩২ তৈমুর খান সংখ্যা | সম্পাদকীয়   মগজ ও অঙ্গ "অপরিসীম মেধ...

Tuesday, November 25, 2025

ছেঁড়া ক্যানভাস [১ম পর্ব] | মোঃ মনিরুল ইসলাম

বাতায়ন/তৈমুর খান সংখ্যা/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৩তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর খান সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
মোঃ মনিরুল ইসলাম
 
ছেঁড়া ক্যানভাস
[১ম পর্ব]

"হেনা মাথা নিচু করে কাঁপা হাতে কাগজ এগিয়ে দিল। চেনা এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল তার কানে— “আপনার নাম?” অফিসারের মুখের দিকে তাকাতেই তার হৃদয় কেঁপে উঠল। সে কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।"

 
আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে। খেজুর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সাদা আলো ঝরে পড়ছে উঠোনে। চারদিকে নীরবতা, শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক রাতের অন্ধকারের নীরবতা ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। খোলা মাঠে হালকা কুয়াশা যেন জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিলেমিশে এক রূপকথার জগ সৃষ্টি করেছে।
 
কুঁড়েঘরের বারান্দায় মাটির চাটাই পেতে বসে আছে হেনা। তাঁর কোলে মাথা রেখে নীরবে ঘুমাচ্ছে তার তিনবছরের মেয়ে নীলা। বাতাসে ভেসে আসছে অঘ্রানের পাকা ধানগাছের সুবাস, পুকুর থেকে ভেসে আসছে কচুরিপানার সোঁদা গন্ধ। চারপাশে গাছের ছায়া পুকুরের জলে পড়েছে, যেন মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য শিল্পী তুলির টানে রাতকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তুলছে।
 
চাঁদের আলোয় তার ছোট্ট সোনামণির মুখটা যেন ঝলমল করছে। মা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন হাতের পরশে মা সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিতে চাইছে। মা তাকিয়ে রইল স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে, ভেসে থাকা রুপালি মেঘের দিকে। তার মনে হলো এই নির্মল আকাশ, এই আলো, এই নিস্তব্ধতা—সবই যেন তাঁর সন্তানকে ঘিরে।
 
হেনা মনে মনে ভাবছে কাল সকালসকাল তার ভাতার কাগজটি জমা দিতে হবে। আজ বাবুদের বাড়ি কাজে যেতে পারবে না। তাই আজ তাদের একবেলা না খেয়ে থাকতে হবে। গেল রাতের যে সামান্য ভাত বেশি ছিল সেটা মেয়ের জন্য একটি গামলায় আজড়ে রেখে হেনা বাসি বাসনকোনগুলি পরিষ্কার করে নিল। আজ হেনার চোখে মুখে একটা চাপা উত্তেজনা। সে মনে মনে বলল— আজ ভাতার কাগজ জমা না দিতে পারলে, তার ললাটে দুর্ভোগের রেখা আরো বেড়ে যাবে
 
আজ তাদের পাড়ায় দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প বসবে। সেখানে বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা— সব আবেদন নেওয়া হবে। গ্রামজুড়ে উচ্ছ্বাস, চারিদিকে যেন সাজোসাজো রব, কেউ দৌড়াচ্ছে নথি জোগাড় করতে, কেউ ব্যস্ত ফরম ফিলাপে, জেরক্সের দোকানে লম্বা লাইন। হেনা সকালসকাল কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। বাড়ি থেকে বার হবার আগে সে কাগজগুলো আবার একবার যাচাই করে নিল। নীলার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলল লতার বাগানে ক্যাম্পের দিকে।
 
ক্যাম্পে গ্রামের নারী-পুরুষ গিজগিজ করছে। শিশুরা এসেছে রঙিন জামা পরে। কারো হাতে বেলুন, কারো হাতে লাল হাওয়া মিঠাই। সকলের মনে একটা খুশির ছাপ। সেখানে যেন মেলা বসেছে। যেন উৎসবের আমেজ। মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে ক্যাম্প থেকে কী কী পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকরা নিরন্তর সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হেনা মাইকের ঘোষণা শুনে আর ব্যানারের লেখা দেখে লাইনে দাঁড়ায়। তার ছোট্টমেয়ে নীলা বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মেতেছে। হেনা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে একজন অফিসার টেবিলে নিরন্তর পরিষেবা দিয়ে চলেছে। গ্রামবাসীরা তার টেবিলের সামনে ভিড় করে আছে। তার গায়ে একটা নেভি ব্লু শার্ট, পরনে খাকি রংয়ের প্যান্ট। বুক পকেটে কালির দাগ। চোখে নেভি ব্লু ফ্রেমের রিমলেস চশমা।
 
হেনা প্রায় ঘণ্টা দুই পর ভিড় ঠেলে দুরুদুরু বুকে অফিসারের টেবিলের সামনে এলো। হেনা মাথা নিচু করে কাঁপা হাতে কাগজ এগিয়ে দিল। চেনা এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল তার কানে— “আপনার নাম?” অফিসারের মুখের দিকে তাকাতেই তার হৃদয় কেঁপে উঠল। সে কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। অফিসার মাথা গুঁজে এক এক করে কাগজ উলটে দেখতে লাগল। হেনা গভীর উদ্‌বেগে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার হৃদয়ের ভিতরে তখন যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। উৎকন্ঠায় তার সামনে বসা মানুষটির চোখের দিকে তাকাতে পারল না! তার মুখটা অফিসার পাছে দেখতে না পায় সেই জন্য সে মাথার ঘোমটা একটু টেনে নিল। উদ্‌বেগে তার হাত ঠকঠক করে কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। অফিসার মাথা গুঁজে এক মনে কাজ করছে তাই তার মুখের দিকে তাকানোর ফুরসৎ পায়নি। অফিসার আবেদনপত্র যাচাই করে নিয়ে বলল সব ঠিক আছে। একটা সই বাকি আছে আর আবেদনপত্রে একটা ছবি লাগাতে হবে।
 
ক্রমশ

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 7 days)