প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

তৈমুর খান সংখ্যা | মগজ ও অঙ্গ

বাতায়ন/ তৈমুর খান সংখ্যা/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/ ৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ , ১৪৩২ তৈমুর খান সংখ্যা | সম্পাদকীয়   মগজ ও অঙ্গ "অপরিসীম মেধ...

Tuesday, November 25, 2025

আত্মবিশ্বাস | অরূপ কুমার দেব

বাতায়ন/তৈমুর খান সংখ্যা/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৩তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর খান সংখ্যা | ছোটগল্প
অরূপ কুমার দেব
 
আত্মবিশ্বাস

"দিব্য জানে যে সে মিথ্যে কথা বলেছেকিন্তু সেই মিথ্যের মধ্যেই তার আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে ছিল। দিব্য ভাল করে বুঝতে পেরেছিল যে, ভালবাসার মানুষ পাশে থাকলে আর নিজের আত্মবিশ্বাসটা বজায় রাখলে দুঃসময়কেও চ্যালেঞ্জ করা যায়।"

 
-শোনো-না, ঋকের ফিজটার জন্য ওদের স্কুল থেকে আজ ফোন এসেছিল।
রিমি কথাটা দিব্যকে বলতে দিব্য বলল,
-কাল চলে যাবে, আমি দিয়ে দেবো।
এরপর দিব্য আর কোনো কথা বলল না। পাশ ফিরে চোখ বোজাল। রিমিও দিব্যকে আর বিরক্ত করল না। সে জানে যে দিব্যর ব্যবসা ইদানীং তেমন ভাল চলছে না। এমনকি পুজোর সময়ও ব্যবসার কোনও উন্নতি হয়নি এই অনলাইন ব্যবসা আর শপিং মলের দৌরাত্ম্যে। কিছু ছোটখাটো দোকান আর ব্যবসা তো প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। কিন্তু, যেগুলো দিব্যর কাছে না চাইলেই নয়, সেগুলো আর না চেয়ে রিমি থাকে কী করে? দুজনেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর অভিনয় করছে, কিন্তু ঘুম কারোর চোখেই নেই। চিন্তা, আগামী দিনগুলোতে কীভাবে সংসারটা চলবে।
পরদিন দোকানে যাওয়ার আগে দিব্য মানিব্যাগটা খুলে দেখল চারটে পাঁচশো টাকার নোট ও সামান্য কিছু খুচরো অবশিষ্ট রয়েছে। তার থেকেই পাঁচশো টাকা স্কুলের ফিজ আর একটা পাঁচশো টাকা সে রিমির হাতে দিয়ে বলল,
-ঋকের স্কুলের ফিটা দিও আর তোমার বাকি ওষুধগুলো সুপ্রিয়র দোকান থেকে নিয়ে নিও।
তারপর সে মুড়ির টিফিনটা নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
 
সব ব্যবসাদারদের মতো দিব্যও আশা করেছিল পুজোর সময় ভাল উপার্জন হবে বলে। কিন্তু এই সময়ও অনলাইন যুগে ব্যবসায় মন্দা চলায় দিব্যর চোখ-মুখের অবস্থা চোখে দেখা যায় না। রিমি মনে মনে ভাবল আমরা মেয়েরা ঘরের কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠি, তাহলে একজন পুরুষের মাথায় কত চিন্তা হয়, একটা পুরো ফ্যামিলির ভরণপোষণের দায়িত্ব। তার উপর এই পুজোর সময় কত বারতি খরচ হয়ে গেছে।
রিমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ঋকের স্কুলের ফিটা সে ভরল কিন্তু নিজের ওষুধগুলো আর কিনল না এই ভেবে যে টাকাটা অন্য দরকারের সময় কাজে আসবে।
 
দিব্য সারাদিন দোকানে বসে। এক-আধটা খদ্দের এসেছিল তাও মাত্র কয়েক টাকার জিনিসপত্র ক্রয় করেছে। বেলায় টিফিনও করেনি। খাওয়াদাওয়া সব সিকেয় উঠেছে। মাথায় শুধু চিন্তা। কবে সব কিছু আগের মতো ঠিক হবে তারও কোন আশা দেখতে পাচ্ছে না চোখে। দুপুরে বাড়ি ফেরার আগে একবার সে ব্যাংকে গেল। দুটো এফডির একটা তাকে ভাঙতেই হবে, সেইজন্য দরখাস্ত লিখল। বাড়ি ফিরে চাবি আর কাগজপত্রের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে মাথার ওপর পাখাটা সাঁই সাঁই করে চালিয়ে দিল। রিমি খাবার জন্য হাঁক দিল। কোন সাড়া পেল না দিব্যর। বাধ্য হয়ে ঘরের মধ্যে এসে দেখে দিব্য জামার বোতামগুলো খুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তায় ডুবে আছে। রিমি তার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
-সব ঠিক হয়ে যাবে।
দিব্য রিমির বুকে আশ্রয় নেওয়ার মতো করে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরল। রিমি তার মাথাটা দুহাতের পরম আদর দিয়ে জড়িয়ে বলল,
-ঈশ্বর আছেন দিব্য।
দিব্য বলল,
-তিনি কবে মুখ তুলবেন? আমার অনেক বন্ধুবান্ধবরা পুজোর সময় ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে গেছে। আগামীমাসে আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে আমরা বেড়াতে যাব ভাবছিলাম। তার জায়গায় তোমাদের ঠিকমতো ভরনপোষণই করতে পারছি না। এমনকি পুজোর সময়ও তোমাদের ভাল কিছু কিনে দিতে পারিনি।
রিমি তখন আদুরে সুরে বলল,
-দুর্গাপুজো, বিবাহবার্ষিকী এসব অনুষ্ঠানগুলো আর কী আমরা পাব না, পরের বছর না হয় ভাল করে পালন করা যাবে। বেলা হয়েছে চলো এবার খেয়ে নিই। আজ তোমার জন্য তোমার পছন্দের পাঁপড়ের ঝাল রান্না করেছি।
বিকেলে দোকান বেরোনোর আগে কারেন্টের বিল এসেছে দেখল। মোট সাতশো টাকা। দিব্য ভাবল দুদিন পর এফডি ভেঙে টাকাটা পেলে তার থেকেই বিলটা মেটাবে। দোকানে গিয়ে সেই একই অবস্থা, খরিদ্দার নেই। আবার তার চিন্তা শুরু হল। মাসখানেক বা টেনেটুনে দুমাস এফডির টাকায় চলে যাবে। কিন্তু পরে কী হবে, যদি ব্যবসায় এমনভাবেই মন্দা চলতে থাকে? সংসারের নিত্য খরচ, ওষুধপত্র, ছেলের স্কুলের ফিজ, আঁকার ফিজ, ইলেকট্রিক বিল। বন্ধুদের থেকেও ধার চাইতে সম্মানে বাধে। ধার চাইলেই কী কেউ সাহায্য করতে পারবে? বরং উল্টে বন্ধুদের নানা সংকোচের মধ্যে ফেলা হবে। অতএব, ধার চাওয়া বাদ।
 
দিন সাতেক পর একদিন রাতে রিমি জানাল যে তার মাসতুতো বোনের বিয়ের নিমন্ত্র করে গেছে। দিব্য ভাবল, এই অসময়ে আবার বিয়েবাড়ি কেন? নিমন্ত্র রাখতে যাওয়া মানেই খরচ। কিন্তু, আবার এও ভাবল যদি নাও যায় তাহলে রিমির সম্মানটা কোথায় নামে। সে রিমিকে কেনাকাটির বিষয়ে কিছু বলতে যাবে, ঘুরে রিমি বলল,
-শোনো-না, আমার না পুজোর সময় কেনা নতুন একটা তাঁতের শাড়ি আছে, ভাঙিনি এখনো। ওটাই বোনকে বিয়েতে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
দিব্য চোখ তুলে বলল,
-পাগল হয়ে গেলে নাকি? তুমি তোমার স্বামীকে এতটাই সামর্থ্যহীন বলে ভাব নাকি!
রিমি তাকে থামিয়ে বলল,
-এমন কথা বলছ কেন? আমি কখনো বলেছি যে তুমি আমায় খারাপ রেখেছ? শুধু এখনের পরিস্থিতি কথা ভেবে বললাম।
দিব্য বলল,
-নাহ! তোমাকে এত ভাবতে হবে না। আমি টাকা দিয়ে দেবো, তুমি পছন্দ মতো শাড়ি কিনে আনবে।
রিমি তখন দিব্যকে আর কিছু না বলে তার কোলে মাথা রাখল। দিব্য তার কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-দেখবে একদিন এই অভাব মিটে যাবে মা দুর্গার আশীর্বাদে। তখন তোমাকে রাণীর মতন রাখব।
রিমি মুচকি হেসে বলল,
-জানি তো, তুমি যে আমার মহারাজ।
দিন-চারেক পর একদিন সন্ধেয় দিব্যর মাথার ঠিক নেই। পাশের দোকানদারের সঙ্গে মন-কষাকষি হতে সে দোকান বন্ধ করে ব্রিজের ওপর ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ইচ্ছে ছিল ড্রিঙ্ক করার, সামর্থ্য কুলোলো না। ব্রিজের ওপরের ঠান্ডা হাওয়ায় সবে তার মাথাটা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে এমন সময় লক্ষ্য করল একজন অন্ধ ভিখিরি বসে বসে আপন মনে চেনা একটা বাউল গান গাইছে। তার গান যেন অজান্তেই দিব্যকে তার দিকে টেনে নিয়ে গেল। দিব্য আশ্চর্য হয়ে দেখল ভিখিরির থালায় মাত্র ক’টা দু-পাঁচ টাকার কয়েন পড়ে আছে। ভিখিরিটা এও জানে না, আদৌ তার খাবারের অর্থটুকুও জোগা হয়েছে কিনা! সে কেবল গান গেয়ে চলেছে। তার আর কোন চিন্তাভাবনা নেই। সে তাহলে কী করে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেকে?
এসব নানান প্রশ্নে দিব্য একটা জিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে চড়াই উতড়াই নিয়েই এই জীবন। চিন্তাভাবনাকে বেশি মদত দিলে সে মাথায় চড়ে বসবে। তখন সে ভিখিরির সাথে গলা মেলাল। অনেকদিন পর তার অন্তরটা কেমন যেন অজানা এক ভাললাগায় মিশে গিয়ে বোঝামুক্ত হলো। সে ফিরে যাওয়ার আগে ওই ভিখিরির থালায় একশো টাকা দিয়ে গিয়েছিল তার কাছ থেকে জীবনের এই অসময়ে মূল্যবান শিক্ষাটা পাওয়ার জন্য। যদিও এ শিক্ষার কোন মূল্য দেওয়া যায় না। শুধু এই শিক্ষারই কেন, কোন শিক্ষারই দাম চোকানো যায় না। তবু কথায় বলে, সুখের সময়ে অন্যকে সাহায্য করতে হয়। দিব্য সেই মুহূর্তে ভীষণ সুখী মনে করছিল নিজেকে।
জীবনের প্রতিটা মোড়ে নতুন কিছু না কিছু অপেক্ষা করে থাকে। সেটা পেতে অপেক্ষা করতে হয়। সেদিন বাড়ি ফেরবার সময় দিব্য রিমির জন্য ষুধ কিনে নিয়ে গেল। কার সে জানত রিমি ষুধ কেনেনি। ছেলে চিকেন খেতে ভালবাসে তাই মুরগির মাংস কিনল। বাড়ি ফিরতেই রিমি দিব্যর কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-দোকানে কী আজ ভাল ব্যবসা হয়েছে নাকি?
দিব্য হাসি মুখে বলল,
-ধরে নাও তাই।
রিমিও স্বামীর মুখে খুশির ঝলক দেখতে পেয়ে আনন্দে তার হাতটা চেপে ধরল। দিব্য জানে যে সে মিথ্যে কথা বলেছে, কিন্তু সেই মিথ্যের মধ্যেই তার আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে ছিল। দিব্য ভাল করে বুঝতে পেরেছিল যে, ভালবাসার মানুষ পাশে থাকলে আর নিজের আত্মবিশ্বাসটা বজায় রাখলে দুঃসময়কেও চ্যালেঞ্জ করা যায়।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 8 (Last 7 days)