বাতায়ন/তৈমুর
খান সংখ্যা/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর
খান সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
মমিনুল পথিক
সামান্তার
অপেক্ষা
[৫ম পর্ব]
"বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে সামান্তা এসেছেন। পাঠকক্ষের ভেতরে একটু ঢুঁ মেরেও দেখেছেন। কয়েকজন পাঠক নিমগ্ন হয়ে পড়ছেন। কিন্তু মাসউদকে চিনব কীভাবে?"
পূর্বানুবৃত্তি আজিবর রহমান চৌধুরী ছেলের কথায় জানিয়ে দিলেন সে যেন পরেরদিন সকালেই এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং
তিনি তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করবেন। তারপর…
সামান্তা ক্লাস শেষ করে
টিচার্স কমনরুমে আনমনে বসে আছে। এইমাত্র টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টাধ্বনি হল। হই হুল্লোড় আর চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখরিত স্কুল প্রাঙ্গণ। কেউ কেউ খেলাধুলায় মত্ত,
কেউ
বারভাজা, ছোলা, বাদাম কিংবা আইসক্রিম খাওয়ায় ব্যস্ত কেউবা টিউবওয়েলের মুখে
মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর শুধু প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার্থীর
কোচিং ক্লাস চলছিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন সামান্তা জানালা দিয়ে
সবই অবলোকন করছে। কী নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার জীবন। তারও একসময় ছিল। কিন্তু বয়স বাড়ার
সাথে সাথে মানবমনে চিন্তা ও সিদ্ধান্তের কতই পরিবর্তন আসে।
না, আর বেশি দেরি করা যাবে না। ম্যাডাম এখন ফ্রি আছেন। কথাটি এখুনি জানাতে হবে এই ভেবে কমনরুম থেকে
বেরিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কক্ষের দিকে দুরুদুরু বুকে কচ্ছপ গতিতে অগ্রসর
হচ্ছে। প্রায় দরজার নিকটে এসেছেন সামান্তা। এমন সময় সুতীব্র শব্দে মোবাইল বেজে
উঠল। বেজেই চলেছে একমুঠোর যাদুর বাক্সটি। দেখলেন, অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করে স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে কিন্তু
বিষণ্ন মনে বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম,
হ্যালো
কে বলছেন প্লিজ?
অপরপ্রান্ত হতে সালাম জবাব
দিয়ে বললেন,
আমি মাসউদ বলছি। আপনি কি
সামান্তা ম্যাডাম বলছেন?
-জ্বি বলছিলাম, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক
চিনলাম না?
-আপনি আমাকে চিনবেন না ম্যাডাম।
-তাহলে রিং করেছেন কেন?
আর আমার
মোবাইল নম্বরইবা আপনি পেলেন কীভাবে?
রাগে শরীর রিরি করে ওঠে
সামান্তার।
-আপনার প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছ থেকে নিয়েছি। গতকাল আমি
স্কুলে আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনাকে না পেয়ে মোবাইল নম্বরটি নিয়ে
এসেছি।
-কিন্তু কেন বলুন তো?
-আপনার সাথে আমার একটি জরুরি আলাপ আছে। আপনি যদি কষ্ট করে
পাবলিক লাইব্রেরিতে আসেন তাহলে পত্রিকা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপটি সারা যাবে।
-সামান্তা এবার একটু ঘাবড়ে গিয়ে রাগের মাথায় বললেন, হোয়াট, আপনি কী বলতে চাইছেন
স্পষ্ট করে বলুন তো? দেখুন আপনি বোধহয় ভুল
নম্বরে রিং করেছেন।
-আপনি শুধু শুধুই রাগ করছেন ম্যাডাম। আমি ঠিক নম্বরেই রিং
করেছি। আমি আপনার ভালর জন্যেই বলছি। আমাকে বিশ্বাস করুন আপনারই উপকার হবে।
-ঠিক আছে আসব, কিন্তু সময়টি কখন?
একটু নরম হয়ে বললেন সামান্তা।
-ধরুন বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।
-চিনব কীভাবে?
-এই নম্বরটি আমার,
এসে
একটি কল দিলেই আমি চিনে নেব।
-ঠিক আছে, আমি আসব, তাহলে রাখি।
-ওকে বাই।
সামান্তা সালাম দেওয়ার পরপরই
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। মোবাইল হাতে নিয়েই প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সামান্তার মুখাবয়বের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
-সামান্তা তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে, শরীর খারাপ নাকি?
সামান্তা নিজেকে সামলে নিয়ে
বললেন,
-না ম্যাডাম, তেমন কিছু না।
-আচ্ছা ভাল কথা,
সামান্তা
তোমার খাতার খবর কী, দেখা শেষ করেছ?
সামান্তা একটু ঢোঁক গিলে
বললেন,
-জ্বি ম্যাডাম দেখা শেষ করেছি, এই দেব দু-একদিনের মধ্যেই।
বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথাটি বলতে
গিয়ে যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
-আগামি সপ্তাহের শেষ নাগাদ ফলাফল প্রকাশ করব ভাবছি।
ম্যাডাম জানালেন।
-ম্যাডাম আমি এবার উঠছি।
-ঠিক আছে, এসো।
বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময়
পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে সামান্তা এসেছেন। পাঠকক্ষের ভেতরে একটু ঢুঁ মেরেও
দেখেছেন। কয়েকজন পাঠক নিমগ্ন হয়ে পড়ছেন। কিন্তু মাসউদকে চিনব কীভাবে? আবার বাইরে এসে মোবাইলে রিং দিলেন সামান্তা, রিং বেজেই চলেছে...। এদিকে মাসুদও রিকশা থেকে নেমে
ফোন রিসিভ করে সামনাসামনি হতেই উভয় উভয়কে চিনতে পারলেন।
পাঠকক্ষে কথা বলা ঠিক হবে না
ভেবে লাইব্রেরি চত্বরের ফাঁকা মাঠে এসে বসেছেন তাঁরা। প্রথমেই একে অপরের পরিচয়
পর্ব শেষ করলেন। তারপর সামান্তা বললেন,
-মাসুদ সাহেব এখন বলুন তো আমাকে কী জন্যে
ডেকেছেন?
মাসুদ সাহেব বললেন,
-দেখুন ম্যাডাম কীভাবে যে কথাটি বলি?
-আ-হা ভূমিকার দরকার কী, সোজা সাপটা বলুন না কী কথা বলতে চান?
-আচ্ছা ম্যাডাম আপনার কি কিছু হারিয়ে গেছে?
মাসুদ সাহস করে কথাটি বললেন। সামান্তা
এবার রীতিমতো চমকে উঠলেন, মুহূর্তেই হৃদযন্ত্রের গতি খুব
বেড়ে গেল, উৎফুল্লচিত্তেই বললেন,
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমার স্কুলের খাতা রাস্তায় হারিয়ে গেছে, আপনি পেয়েছেন মাসুদ সাহেব?
-হ্যাঁ আমি পেয়েছি বলেই তো আপনাকে এখানে ডেকে আনা।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সামান্তা।
বললেন, উফ্ কী যে ভাল লাগছে আমার।
জানেন এই খাতার জন্যে কত খুঁজেছি, কত চিন্তা করেছি। যাক
আজ থেকে আমার চিন্তার অবসান হল। চলুন তো সামনে হোটেলে চা খাওয়া যাবে।
এই বলে দুজনে পাশের এক হোটেলে
ঢুকে একটি সিটে বসলেন এবং মাসুদ উঠে গিয়ে মিষ্টি ও চায়ের অর্ডার দিলেন।
বিল দিতে গিয়ে সামান্তার
বেলনাকার হাতটি চেপে ধরে মাসুদ বললেন,
-না ম্যাডাম, আমিই অর্ডার দিয়েছি সুতরাং বিলটি আমিই দেব।
সামান্তা আর কোন কথা বলেননি। মুহূর্তের
মধ্যে সারা অঙ্গ জুড়ে যেন এক রোমাঞ্চকর আবেশের সৃষ্টি হল। তাঁর জীবনের এ এক নতুন
অভিজ্ঞতা, এ এক অন্যরকম ভাল
লাগা।
ক্রমশ

No comments:
Post a Comment