বাতায়ন/তৈমুর
খান সংখ্যা/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/৩২তম
সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর
খান সংখ্যা | প্রবন্ধ
নাসির
ওয়াদেন
ভাবে-অনুভবে
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যকর্ম
"বঙ্গদেশ অদ্য সেই রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না। রামমোহন বঙ্গ সাহিত্যকে গ্রানিট স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জমান দশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়া ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলি মৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন।"
বাংলা সাহিত্যে অন্যতম
অভিভাবক হিসেবে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেভাবে পেয়েছি সেই সূত্র ধরে তাঁর
কাব্যসাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদির ভেতর
দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিল্পজাত সময়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। কল্লোল
যুগের আগে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে রবীন্দ্রপ্রভা যেভাবে বিচ্ছুরিত হয়েছিল এবং
বাংলা ভাষা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল, তা নিয়ে কোন
প্রশ্নের অবতারণা নেই। যে সময়কালে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য রচনা বাঙালি পাঠকের
দরবারে পৌঁছায়; সেই রচনা তারা
গোগ্রাসে গিলতে থাকে। পরবর্তী সময়ে নবীন ও নূতন পাঠক এবং লেখকদের আগমনে বঙ্কিম
সাহিত্যে মন না ভরলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্যের
ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার অগ্রসরমান ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আধুনিক
সাহিত্য’ পুস্তকে লিখেছেন যে, “বঙ্কিম সাহিত্যের পর সাধারণ বাঙালি পাঠকের মনের মধ্যে যে
উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রগাঢ় হয়েছিল,
ক্রমে
ক্রমে তা অন্য খাতে বইতে শুরু করে।” 'বঙ্কিমচন্দ্র' প্রবন্ধে এক জায়গায়
তিনি লিখেছেন, "বঙ্গদেশ অদ্য সেই
রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না।
রামমোহন বঙ্গ সাহিত্যকে গ্রানিট স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জমান দশা হইতে
উন্নত করিয়া তুলিয়া ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া
স্তরবদ্ধ পলি মৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। আজ বাংলাভাষা কেবল দৃঢ়
বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামলা
হইয়া উঠিয়িছে।" বাংলা ভাষায় দৈনতা,
সৃজনশীলতায়
যে খামতি ছিল, সৌন্দর্যকরণে যে রঙের অভাব
তিনি পরিলক্ষিত করেছিলেন, তা যে কিছুটা পূরিত
হয়েছে, তা তিনিও স্বীকার করেছেন।
তিনি আবার লিখেছেন "পৌল
বর্জিনীতে যেমন মানুষের এবং প্রকৃতির নিকট পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম, বিহারীলালের কাব্যেও সেইরূপ একটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গ প্রাপ্ত
হইয়াছিলাম।" কবিও অনুভব করেছিলেন যে,
অসন্তোষই
মানব প্রকৃতির সহজাত। যেহেতু নানান কবিতায় অসন্তোষ-গানের বাহুল্য বেশি করে দেখা
যায়। তাই অনেকেই দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু কীভাবে এর
ব্যাখ্যা হতে পারে, যেহেতু তিনিও মনে
করতেন যে, 'অসন্তোষ ও পরিতৃপ্তি যতই
প্রার্থনীয় হোউক, তাহাতে কার্য ও কাব্য
উভয়েরই ব্যাঘাত করিয়া থাকে।' কবির কবিতাপাঠ করলে
জাগতিক ইন্দ্রিয়চেতনা, পারস্পারিক
চিন্তাভাবনা, অলংকারিক স্থপতি ও সৌন্দর্যের
গূঢ়তা অনুভব করা যায়।
আধুনিক সাহিত্যে প্রেম
অপেক্ষায় রোমান্সের উপস্থিতি বেশি বেশি করে লক্ষ করা যায়। যা, সাহিত্যের গুণ বিচারে অনেক পেছনের সারিতে
বিদ্যমান। কিন্তু আধুনিক কবি, লেখকগন মনে করেন, কাব্যের, সাহিত্যের আচ্ছাদন
অপেক্ষা অন্তর্বাস খুলে দেওয়ায় সাহিত্যের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাবে। এ
প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন যে, আদি কবি বিদ্যাপতির
প্রেমে একটু ব্যাকুলতা, একটু আশা-নৈরাশ্যের
আন্দোলনও থাকে। বিদ্যাপতির কথায়, নয়ন চকোর মোর পিতে
করে উতরোল
নিমিখে নিমিথ নাহি হয়—
এখানে যে চিত্র পরিস্ফুট
হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, নবীনা রাধার প্রতি
বিদ্যাপতির প্রেমের ব্যাকুলতায় ম্লান জমা আছে, উতলা, উতরোলে ঘাটতি লক্ষ্য করা
যায়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে, "বিদ্যাপতিতে সেরূপ উতরোল ভাব নয়, কতটা উতলা বটে। কেবল আপনাকে আধখানা প্রকাশ ও আধখানা গোপন; কেবল হঠাৎ উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা
উন্মেষিত হইয়া পড়ে। বিদ্যাপতি রাধা নবীনা নবস্ফুট। আপনাকে ও পরকে ভাল করিয়া
জানে না।" এই পরস্পরকে জানা, বোঝা থেকে যে আত্মিক
সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা রবীন্দ্র
সাহিত্যের বিভিন্ন গল্পের মধ্যে তার বিকাশ সাধিত হয়েছে।
কল্লোল যুগের অন্যতম কবি
বিষ্ণু দে। বাম মনোভাবাপন্ন কবি, রবীন্দ্রোত্তর কবি
হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন এবং রবীন্দ্র প্রভাব থেকে সাহিত্যকে মুক্ত করতে
চেয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিক দিয়ে দেখলে
দেখা যায় যে, তিনিও অনেকখানি রবীন্দ্র
অনুরাগী ছিলেন। তিনি আধুনিক বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও চিন্তাশীল
ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা কবিতাকে তিরিশের দশকে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী
প্রভাব থেকে মুক্ত করতে। যেহেতু বাংলা সাহিত্যকে কবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব সাহিত্যের
অঙ্গনে যেভাবে জড়িত করেছিলেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে বাংলাকে
সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। সেইদিক লক্ষ্য করে কবি
বিষ্ণু দে বুঝতে পারেন যে, রবীন্দ্রনাথকে
অস্বীকার করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি রবীন্দ্র
প্রভাব মুক্ত সাহিত্য সৃষ্টিও করা যেতে পারে। তাই তিনি সবকিছু বুঝতে পেরেছিলেন
বলেই এবং তাঁর নিজের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের লাইন, উদ্ধৃতি ব্যবহার করে রবীন্দ্র প্রীতি জ্ঞাপন করেন। 'নাম রেখেছি কোমল গান্ধার', 'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ' ইত্যাদি
কাব্যগ্রন্থের নামকরণ তিনি রবীন্দ্র প্রীতি থেকেই গ্রহণ করেন। তাঁর সৃষ্টিতে
রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য ও মার্ক্সীয় চেতনার আশ্চর্য মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হয়। তিনিও
রবীন্দ্র সাহিত্যে মার্কসীয় দর্শনের চিন্তাধারাকে অনুধাবন ও অনুলোকন করেন।
যাইহোক, রবীন্দ্র সাহিত্যের আধার বিশাল, মহাসমুদ্রের মতো। সেই মহাসমুদ্রের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে
চারপাশে জলরাশি ছাড়া পাড়ের সন্ধান করা দূরূহ। সেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম
আলোচনায়, অনুভবে এই বিষয়সমূহ মনের
ভেতর উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মধারায়, বিচার বিশ্লেষণে যে দিকগুলো আমাদের সম্মুখে উপনীত হয়ে পড়ে, তার মধ্যে বলা যেতে পারে যে, ভাব গভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা,
প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বজনীন প্রেম রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনা, সর্বোপরি ভাষার মাধুর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের বিভিন্ন আঙ্গিক বিচার বিশ্লেষণে দেখা
গেছে যে, তাঁর কাব্য, গদ্য উভয়ই গভীর ভাবাবেগে ও সুরে সমৃদ্ধ, যা পাঠকদের প্রভাবিত করতে সহায়ক। মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি,
আধ্যাত্মিকতায়
যেভাবে মানুষের জীবনের বিচিত্র ঘটনার চিত্রকল্প, আধ্যাত্মিক চেতনা, ঈশ্বর ভাবনা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর
ভালবাসা উপলব্ধি করা যায়, তা এক কথায় অনবদ্য।
সমাজের বাস্তব অবস্থা ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম ভাষা ছন্দ ও আঙ্গিকের
বৈচিত্রপূর্ণ আবেদন তার সাহিত্যকে উৎকৃষ্ট করে তুলেছে নিঃসন্দেহে।
ছোটগল্প প্রসঙ্গে বলা যায় যে, তাঁর ছোটগল্প বাংলাভাষাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি বিশ্বসাহিত্যের দরবারেও প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষত, কাবুলিওয়ালা, পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, ছুটি ইত্যাদি গল্পে
বাল্য ও সমাজজীবনের, মানব মননের গভীর
অনুভূতি ও মর্মার্থ তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের ভেতর দিয়ে জনজীবন সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক চিত্র তুলিত হয়েছে 'গোরা' 'ঘরে বাইরে', 'চোখের বালি', 'শেষের কবিতা' ইত্যাদিতে। 'গোরা' উপন্যাসের ভেতর স্বদেশপ্রেম, জটিল বাঙালির ধর্মীয় বৈষম্য ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য
পরিস্ফুট। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ব্যক্তিগত জীবনে নানা-সম্পর্কের
টানাপোড়েন, জটিলতাও পরিলক্ষিত
হয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীতের ভেতর খুঁজে
পাই, প্রেম, প্রকৃতি, পূজা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি
পর্যায়ের বিষয়। তার সাথে বাংলা লোকসংগীত তো উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা দর্শন তাঁর ছিল
সম্পূর্ণ ভিন্নতর। শুধু জ্ঞানার্জনই নয়,
তার
সঙ্গে প্রয়োজন মানসিক ও চারিত্রিক বিকাশের। নৈতিকতা না থাকলে মান-হুঁশ না হলে, প্রকৃত মানব হওয়া দুরূহ। তাই তিনি ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে
একটি আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের,
চিন্তার
বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। শুধু জ্ঞান লাভ করলেই হবে না, হাতে-কলমে কাজ করাও প্রয়োজন, সেইজন্যই তিনি কৃষির
উন্নতি বিকাশে শ্রীনিকেতনে কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন করেন এবং সমবায়ের সদর্থক ধারণার
উদ্ভব ঘটিয়ে কৃষক সমাজকে দুর্দশা হতে মুক্তির প্রয়াস চালান। প্রচলিত সমাজের
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নারীস্বাধীনতা ও নারী অধিকারের প্রতি
যত্নশীল হন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার
প্রদত্ত 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করে দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
চিত্রকলাও তাঁর দর্শনের অন্যতম উপাদান ছিল। তিনি মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী
ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের আত্মার
মুক্তিই সর্বোচ্চ সাধনা। তিনি আরও মনে করতেন,
মানুষের
সাথে মানুষের ভালবাসা থাকলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন।
১৮৬১ সালে তাঁর জন্ম, সেই মহান মানুষ রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে ৭ই অগাস্ট দেহত্যাগ
করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম, সংগীত, চিত্রকলা, শিক্ষাদর্শন, মানব প্রীতি মানবতার পথকে প্রশস্ততর করেছে। তাঁর চিন্তা, সৃষ্টি, দর্শন মানুষের হৃদয়ে
চিরজাগরূক থাকবে। আমার দৃষ্টিতে,
ভাবে-অনুভবে
তিনি সাহিত্যের বিশেষ করে, বাংলা সাহিত্যের
প্রকৃত রূপের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
তিনি সবার হৃদয়ে মহানায়ক ও
শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে চিরকাল অম্লান থাকবেন।
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment