প্রথম বর্ষ/প্রথম সংখ্যা/১লা বৈশাখ, ১৪৩০
অন্য চোখে
মিত্রা সেনগুপ্ত
সাধ ও সাধনা
“দিদি, আপনি ডায়লগ বলতে
পারেন তো?” দীর্ঘ পঁচিশ বছর অভিনয় করতে থাকা মেয়েটার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের
কোণ চিকচিক করে ওঠে এমন প্রশ্নে, তবু শুনতে হয়েছে এমন প্রশ্ন মেগা সিরিয়ালের
ফ্লোরে। কারণ তার অভিনয় জীবনের শুরু আর সাফল্য তো মঞ্চে। সন্ধে হলেই মানুষ বসে
পরেন টিভির সামনে, অমোঘ আকর্ষণে, আর আমরা যারা রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করেও মঞ্চ সাজাই
তারা আহত হই, রক্তক্ষরণ হয় রোজ, প্রতিনিয়ত।
না না কোনো প্রতিযোগিতা, কোনো বিরোধিতা নেই এই দুটি মাধ্যম ঘিরে, দুটোই মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। দুটোই ভাল লাগার, ভালবাসার। তবু মানুষ যদি আর একটু মঞ্চমুখী হতেন আমাদের স্বপ্নের বাগিচায় ফুল ফুটত।
আমি মিত্রা, ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখেছি অভিনেত্রী হব, সেই ছোট্ট কুঁড়ির স্বপ্নে কেউ আলো ছড়ায়নি, স্বপ্নের কুঁড়িতে ভালবাসার জল দিয়ে কেউ গাছ হতে সাহায্য করেনি। বাবা-মা বরাবর চেয়েছেন হয় শিক্ষিকা হই, নয়তো উকিল বা সাহিত্যিক। একটু-আধটু লিখতাম বটে ছোটবেলায় কিন্তু মন ছুটে যেতে চাইত মঞ্চে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে যখন বসে আছি বাবার পা ধরে অনুরোধ করলাম কোথাও একটু দাও না, অভিনয় শিখব। আবার পড়াশোনার সময় ছেড়ে দেব। কী কারণে কে জানে মন ভিজল বাবার, ভর্তি হলাম একটি ইনস্টিটিউটে, মোন্তাজ ৮৫।
না না কোনো প্রতিযোগিতা, কোনো বিরোধিতা নেই এই দুটি মাধ্যম ঘিরে, দুটোই মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। দুটোই ভাল লাগার, ভালবাসার। তবু মানুষ যদি আর একটু মঞ্চমুখী হতেন আমাদের স্বপ্নের বাগিচায় ফুল ফুটত।
আমি মিত্রা, ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখেছি অভিনেত্রী হব, সেই ছোট্ট কুঁড়ির স্বপ্নে কেউ আলো ছড়ায়নি, স্বপ্নের কুঁড়িতে ভালবাসার জল দিয়ে কেউ গাছ হতে সাহায্য করেনি। বাবা-মা বরাবর চেয়েছেন হয় শিক্ষিকা হই, নয়তো উকিল বা সাহিত্যিক। একটু-আধটু লিখতাম বটে ছোটবেলায় কিন্তু মন ছুটে যেতে চাইত মঞ্চে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে যখন বসে আছি বাবার পা ধরে অনুরোধ করলাম কোথাও একটু দাও না, অভিনয় শিখব। আবার পড়াশোনার সময় ছেড়ে দেব। কী কারণে কে জানে মন ভিজল বাবার, ভর্তি হলাম একটি ইনস্টিটিউটে, মোন্তাজ ৮৫।
সান্নিধ্য পেলাম প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র নির্দেশক পার্থ প্রতিম চৌধুরীর। খুব অল্প সময়েই স্যারের খুব প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলাম। সন্তান স্নেহে আপন করে নিলেন স্যার, সে এক সোনালী সময় আমার জীবনের। স্যারের শেষ সিনেমা বৌমনি, স্যার চাইলেন আমিও ষ্টুডিয়োতে যাই, অনেক শেখার আছে সেখানে। বাধ সাধলেন বাবা, না এসব কিছু করা যাবে না। আবার শুরু পড়াশোনা, চোখের জলে স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, শেষ দিন আমায় জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করতে করতে স্যার মা-কে বলেছিলেন, মিত্রাকে অভিনয়টা করতে দেবেন প্লিজ, ওর মধ্যে স্পার্ক আছে। এটাই ছিল চরম প্রাপ্তি।
কলেজ জীবন শুরু হতেই একরকম জেদ করে, তুমুল অশান্তি করেই শুরু করলাম নাট্য জীবন। আমি যে পাড়ায় থাকতাম, থাকতাম বলা ভুল আজও থাকি সেই পাড়ায় সেই সময় ছিল নক্ষত্র সমাবেশ। বিশিষ্ট অভিনেতা, পরিচালক শ্রী বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী ছিলেন আমাদেরই পাড়ার মানুষ। পাড়ার নাটকে ওনার সান্নিধ্যে সমৃদ্ধ হয়েছি, শিখেছি অনেক কিছু। আমাদের পাড়ায় শ্যামল-মামা বলে একজন ছিলেন, ওনার ডাকে পাড়ার নাটক করেছি, স্বপ্ন লালিতপালিত হয়েছে। কলেজ শেষের মুখে কলকাতার বিখ্যাত গ্রুপ থিয়েটার নটসেনায় ডাক পেলাম। নাটকের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে নাটকের নাম সেই ‘গরুর গাড়ির হেডলাইট’ নাটকে ‘চুমকি’ চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে ধন্য হলাম। মনে হল এতদিনে বুঝি স্বপ্ন সার্থক হল আমার।
সেই সময় মঞ্চকে ভালবেসে, নটসেনাকে জড়িয়ে থাকতে চেয়ে ক্যামেরার অনেক কাজকেই ফিরিয়ে দিয়েছি অনায়াসে। কিন্তু বিধি বাম, এত সুখ সইলে তো! হয়তো অভিনয় জগৎ থেকে দূরে সরাতেই মা-বাবা বিয়ের ব্যবস্থা করলেন দিল্লিতে। মানতেই হল। থিয়েটার যে খাওয়াতে পারে না কোন ভরসায় বিদ্রোহী হয়ে গৃহত্যাগ করব অতএব ছাদনাতলা। চুপিচুপি হবু বরের সাথে চুক্তি হল সে আমায় খুব শিগগির ফিরিয়ে আনবে এই বাংলায়, এই জগতে। মোটে তো ক’দিনের বিরতি এ আর এমন কী এই ভেবেই চোখের জলে প্রাণপ্রিয় কলকাতাকে ততোধিক প্রাণপ্রিয় দলকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম। ভাবলাম সবই তো রইল আমার, ফিরে এলে সেই আমার করেই সবটা পাব। সরল ছিলাম না বোকা তা জানি না তবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম ‘আবার আসিব ফিরে’ বলা যত সোজা, করা ততটাই কঠিন। (যদিও দলের ডাকে দিল্লি থেকে উড়ে এসেও শো করে গেছি।)
ততদিনে আমি মা হয়েছি, ছোট্ট সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ফেসবুকের পাতায় নাটকের বিজ্ঞাপন দেখি আর চোখের জলে ভাসি। জানি না কোন মানসিক যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে পরলাম, সেরিব্রাল অ্যাটাক হল এক মধ্যরাতে। দু’ বছরের সন্তান রেখে যমের দুয়ারে বাড়িয়েই দিয়েছিলাম পা। ডাক্তারের চেষ্টা আর হাজব্যান্ড-এর জোরে ফিরে এলাম আবার। ফিরে এসেও স্বার্থপরের মতো মনে হতে থাকল কেন ফিরলাম? যে জীবনে আর মঞ্চ নেই, আলো নেই, থার্ড বেল নেই, সামনের কালো কালো মাথা নেই সেই জীবন থেকেই বা কী লাভ?
স্বামী বুঝলেন এই যন্ত্রণা, এ-ও পরম প্রাপ্তি আমার, দুই পরিবারের সাথে তুমুল অশান্তি করেও আমায় ফিরিয়ে দিলেন আমার বাংলায়, আমার জগতে। দীর্ঘ তেরো বছর পর আবার ফিরলাম মঞ্চে। আমার দল নটসেনা পরম মমতায়, ভালবাসায় গ্রহণ করল আমায়। এবার মঞ্চের পাশাপাশি ক্যামেরার কাজেও উৎসাহী হলাম। কিন্তু সর্বত্র শুধু পরিবর্তন আর পরিবর্তন। এ পরিবর্তন আশা জাগায় না, আলো ছড়ায় না, বঞ্চনার গল্প বলে। কাদম্বরীর মতো কানে বাজতে থাকে, “হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথা নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে” নতুনদের জায়গা ছাড়তেই হয় আর এটাই কালের নিয়ম।
কিন্তু নতুন ভাবে কলকাতায় ফিরে নতুন উপলব্ধি হল, না শুধু এই জগতেই না সমাজে, সংসারে সর্বত্র শুধু কিছু সুযোগসন্ধানী, স্বার্থপর, লোভী, অযোগ্যের ভিড়। সে ভিড়ে কোনও শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই, সততা নেই, আছে শুধু অন্য উপায়, ছিনিয়ে নেবার মানসিকতা। কিন্তু যারা শুধু একাগ্রতা বোঝে, শুধু কাজকেই ভালবাসে, কাজ নিবেদিত প্রাণ এই শহর আজ তাদের শুধু বঞ্চনার রাস্তা দেখায়। যখন আমি ফিরে আসার স্বপ্নে মশগুল তখন অনেকেই আমায় বলেছিলেন, যা ফেলে গেছিলি, ঠিক সেটাই সেজেগুজে অপেক্ষায় নেই, অনেক কিছু বদলেছে, ঠিক যেমন দেখে গেছিলি নিজের বাংলাকে, যেমন রেখে গেছিলি নিজের জগৎ ঠিক সেটাই বেঁচে থাকুক তোর স্মৃতিতে, ফিরে গিয়ে কদর্যতায় নাই বা ঢাকলি স্বপ্নকে। মানিনি সে কথা, বিশ্বাসও করিনি।
কিন্তু... তবে এ শহর কি সবটাই শুধু না পাওয়ার গল্প শোনায়, হাজার আত্মত্যাগে বিদ্রুপের হাসিতে হৃদয় ভেঙে দেয়? না না এ কথা বললে আমি চরম মিথ্যেবাদী বলে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেব। খুব ছোট্ট কাজেও যখন ফ্লোরে সবার সামনে দাঁড়িয়ে পরিচালক বলেন বাহ্ বেশ করলেন তো সে আমার পরম প্রাপ্তি। খুব ছোট্ট ছোট্ট কাজ পেলেও বেশ কিছু কাজ করেছি মেগা সিরিয়ালে, সিনেমায়। খুব কম হলেও পরিচিত হয়েছি একটু-আধটু। রাস্তাঘাটে কিছু মানুষ চিনতে পারেন, এসে আলাপ করেন, সেলফি তোলেন, এ-ও তো আমার বিশেষ প্রাপ্তি। এই ভালবাসাটুকু নিয়েই স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে পেরিয়ে যাব বাকিটা জীবন।
এখন জীবনের শেষ ইচ্ছে, শেষ চাহিদা একটাই, যতখানি এগোতে চেয়েছিলাম তা তো পারলাম না, হয়তো আমারই খামতি। শুধু জীবনের শেষ দিনটা হোক কোন শুটিং ফ্লোরে বা কোন মঞ্চে। পরিচালক কাট বলার আগেই বা মঞ্চের পর্দা পড়ার আগেই হাসিমুখে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিক আজীবন অভিনয় অন্ত প্রাণ এক ব্যর্থ, বঞ্চিত অভিনেত্রী।
[লেখিকা মঞ্চ ও সিরিয়াল
অভিনেত্রী।]
এতো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজের চেষ্টায় তুমি যে সাফল্য অর্জন করেছো সেটাও অনেকের কাছে স্বপ্ন,
ReplyDeleteচলতে থাকো সামনেই হয়তো কোন মোড় পেয়ে যাবে সাফল্যের গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার।
Porlam purota asole natok ba bola bhalo mancha jara valobase tader kache oi jaygata swarga amio poribarer chape r firte parini kintu swapna dekhi r bhabi hoyto konodin
ReplyDeleteখুব ভালো লিখেছো। লেখনী আরো সমৃদ্ধ হোক।
ReplyDeleteঅনেক শুভেচ্ছা রইল
....... জিয়া
জেদ টাই আসল, এগিয়ে চলো ❤️
ReplyDeleteপ্রতিবন্ধকতা সরিয়ে এগিয়ে চলুক জীবন।
ReplyDelete